পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে আমরা জানতে পারি, ডলার সংকটের কারণে কয়লাসহ অন্যান্য জ্বালানি কিনতে না পারায় বসিয়ে রাখতে হচ্ছে উৎপাদনে থাকা বেশ কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র। সরবরাহে ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় লোডশেডিং ক্রমেই বাড়ছে। গত রোববার সারা দেশে লোডশেডিং ৩ হাজার ৫শ মেগাওয়াটের একটু বেশি ছিল। সোমবার বিকেল ৩টায় সেটি ছাড়িয়ে গেছে ৪ হাজার ৭৯ মেগাওয়াটে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) কয়েকজন কর্মকর্তা পত্রিকান্তরে বলেছেন, এত দিন ধরে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট থেকে ৩৫০ মেগাওয়াটের মতো যে বিদ্যুৎ পাওয়া যেত, সেটির সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নতুন করে লোডশেডিং বেড়েছে। পিজিসিবির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সোমবার বিকেল ৩টার সময় সারা দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৫ হাজার ৭৯ মেগাওয়াট। কিন্তু সরবরাহ ছিল ছিল ১১ হাজার মেগাওয়াট। লোডশেডিং করা হয়েছে ৪ হাজার ৭৯ মেগাওয়াট। অন্যদিকে রোববার দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ১৩ হাজার ৭৮১ মেগাওয়াট। কিন্তু চাহিদা ছিল ১৫ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বিদ্যুতের যে চাহিদা তার চেয়ে উৎপাদন সক্ষমতা দ্বিগুণ হওয়ার পরও প্রতিদিনই কয়েক হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হচ্ছে। প্রাথমিক জ্বালানির উৎস নিশ্চিত না করেই বিদ্যুৎকেন্দ্র বানানোয় দেখা দিয়েছে এই সংকট। দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের বড় মজুত থাকার পরও জ্বালানিকে আমদানিনির্ভর করে তোলা হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও বসিয়ে বসিয়ে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির এই ভুল এবং কিছু মানুষকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার এই নীতির কারণেই আজকে লোডশেডিংয়ের এই চরম পরিস্থিতি। গ্যাস, কয়লা আমদানি করতে না পারায় বন্ধ রাখতে হচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্র।
এদিকে, জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো অর্ধেক সক্ষমতায় চলছে স্বীকার করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, পরিস্থিতি ‘আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে’ স্বাভাবিক হয়ে আসবে। লোডশেডিংয়ের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেন, লোডশেডিং বেড়ে গেছে। আমাদের গ্যাস, কয়লা ও তেল দিতে সময় লাগছে। এ কারণে আমরা দেখছি প্রায় আড়াই হাজার মেগাওয়াটের মতো লোডশেড হচ্ছে। এটা থেকে আমরা ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে পারব। আমি জানি, এখন লোডশেডিংটা অসহনীয় হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে চেষ্টা করছি যে, কত দ্রুত সমস্যার সমাধান করা যায়।
লোডশেডিং বাড়ায় মানুষের কষ্ট বেড়েছে। লোডশেডিং অসুস্থ মানুষগুলোকে মারাত্মক কষ্টে ফেলেছে। প্রবীণ মানুষের কষ্টও অবর্ণনীয়। শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের অবস্থাও শোচনীয়। লোডশেডিংয়ের কারণে চট্টগ্রামে শিল্প কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তীব্র লোডশেডিংয়ের কারণে মানুষের মাঝে অসন্তোষ বিরাজ করছে। বিশেষ করে অসুস্থ, প্রবীণ ও শিশু রয়েছে এমন পরিবারগুলোতে কষ্টের সীমা নেই। দুর্ভোগ সহনীয় পর্যায়ে রাখতে অনেকেই রিচার্জেবল ফ্যান, লাইট ও আইপিএস কিনছেন। এদিকে চাহিদা বৃদ্ধির সুযোগে ব্যবসায়ীরা এসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। আবার বিদ্যুৎ না থাকায় ব্যাটারিও চার্জ হচ্ছে না। ফলে আইপিএস বা রিচার্জেবল ফ্যান, লাইট থেকেও পর্যাপ্ত সাপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে না।
চট্টগ্রামে পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ন্যাশনাল গ্রিড থেকে পাওয়া বিদ্যুতেই মূলত এখন চট্টগ্রামে সরবরাহ দেয়া হচ্ছে। চট্টগ্রামের বিদ্যুৎ উৎপাদন অনেকটা তলানিতে নেমে এসেছে। ভারী বর্ষণ না হলে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পুরো উৎপাদন সম্ভব নয়। গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোও পুরোদমে চলছে না। এই অবস্থায় ঠিক কখন চট্টগ্রামে বিদ্যুতের যোগান স্বাভাবিক হবে তা অনিশ্চিত বলে জানান তারা।
বলা বাহুল্য, বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান জ্বালানি। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যথেষ্ট সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় জ্বালানির অভাবে অধিক পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় না। তবুও উৎপাদিত বিদ্যুতের বেশিরভাগ নির্ভর করে আমদানি করা জ্বালানির ওপর– যার পরিমাণ ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলেছে। সমপ্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে জ্বালানি সংকটের পাশাপাশি দেশে ডলার ও রিজার্ভ সংকটের কথা শোনা যাচ্ছে। কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আমদানি–রপ্তানিবাণিজ্যের ভারসাম্য সংকটসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বা মেগাপ্রকল্পে নেওয়া বৈদেশিক ঋণের কিস্তি ডলারে পরিশোধের কারণে রিজার্ভে চাপ তৈরি হচ্ছে।
তাঁরা বলেন, আমাদের যে নিজস্ব গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়, তা চাহিদার অর্ধেকের চেয়ে কম। বাকিটা বেশিরভাগ উৎপাদন হয় জ্বালানি তেল ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্লান্টের মাধ্যমে। এখন যদি বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করতে এলএনজি এবং জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয়, তা হলে উৎপাদন খরচ তিন–চারগুণ বেড়ে যাবে। এ বিষয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় নিতে হবে নিজস্ব উদ্যোগ। লোডশেডিং পরিস্থিতির অবনতি দ্রুত রোধ করতে হবে।