মহান রাব্বুল আ’লামিন আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন শ্রেষ্ঠ জীব আশরাফুল মাখলুকাত হিসাবে এবং শুধুমাত্র তাঁর ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন, ‘আমি মানুষ এবং জ্বিন জাতিকে আমার এবাদত করা ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিনি’-সূরা-আয যারিয়াত- ৫৫। কিন্তু এ এবাদত যদি লোক দেখানো হয় তাহলে ঘটে যায় বিপত্তি। কারণ শুধুমাত্র আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এবাদত ও আমল ছাড়া লোক দেখানো যে কোনো পুণ্যময় কাজ আল্লাহর কাছে গৃহিত হবে না। আবু সাঈদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত-তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে আমল করবে, আল্লাহও তাকে সেটাই দেখাবেন (অর্থাৎ সে প্রদর্শনীমূলক আমল করলে তা প্রকাশ করে দেখানো হবে) এবং যে ব্যক্তি সুনাম-সুখ্যাতির অন্বেষণে আমল করবে, আল্লাহও তার আমল (দোষ-ত্রুটিগুলো) প্রচার করে দেবেন। অধিকন্তু তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) আরো বলেছেন- যে ব্যক্তি মানুষকে দয়া করে না, আল্লাহও তাকে দয়া করেন না’। আবু ঈসা বলেন, এটি হাসান হাদীস, তবে উপরোক্ত সূত্রে গরীব। মহান রাব্বুল আ’লামিন বান্দার মনের অবস্থা বুঝেন। কার কি মতলব কিংবা খেয়াল সব কিছু তাঁর আয়ত্তাধীন। অতএব আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে কল্যাণময় কাজ করতে গেলেই তাঁর মোবারক অন্তরে ধরা পড়ে। আর সেজন্যেই আমার রাসূল (সাঃ) এর একটি সহীহ হাদীস বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন। শুফাই (শাফী) আল-আসবাহী (রাঃ) থেকে বর্ণিত-একদা তিনি মদীনায় পৌঁছে দেখেন যে, এক ব্যক্তিকে ঘিরে জনতার ভিড় লেগে আছে। তিনি জিজ্ঞেস করেন, তিনি কে? উপস্থিত লোকেরা বলল, ইনি আবু হুরায়রা (রাঃ)। (শুফাই বলেন), আমি নিকটে গিয়ে তার সামনে বসে পড়লাম। তিনি তখন লোকদের হাদীস শুনাচ্ছিলেন। অতঃপর তিনি যখন নীরব ও একাকী হলেন, আমি তাকে বললাম, আমি আপনার কাছে সত্যিকারভাবে এই আবেদন করছি যে, আপনি আমাকে এমন একটি হাদীস শুনাবেন, যা আপনি সরাসরি রাসূল (সাঃ) কাছে শুনেছেন, ভালোভাবে বুঝেছেন এবং জেনেছেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, আমি তাই করব, আমি তোমার নিকট এমন একটি হাদীস বর্ণনা করব যা আমি সরাসরি রাসূল (সাঃ) এর নিকটে শুনেছি এবং আমি তা বুঝেছি ও জেনেছি। একথা বলে আবু হুরায়রা (রাঃ) কেমন যেন তন্ময়গ্রস্ত হয়ে পড়েন। আমরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। অতঃপর তন্ময়ভাব কেটে গেলে তিনি বলেন, আমি তোমার কাছে এমন একটি হাদিস বর্ণনা করব যা রাসূল (সাঃ) এই ঘরের মধ্যে আমার কাছে বর্ণনা করেছেন। আমাদের সাথে তখন আমি ও তিনি ব্যতীত আর কেউ ছিল না। পুনরায় আবু হুরায়রা (রাঃ) আরো গভীরভাবে তন্ময়গ্রস্ত হয়ে পড়েন। তিনি সম্বিত ফিরে পেয়ে মুখমন্ডল মুছলেন, অতঃপর বলেন, আমি তাই করব। আমি অবশ্যই তোমার কাছে এমন একটি হাদীস বর্ণনা করব যা রাসূল (সাঃ) আমার কাছে বর্ণনা করেছেন। তখন এই ঘরে আমাদের সাথে তিনি ও আমি ছাড়া কেউ ছিল না। পুনরায় আবু হুরায়রা (রাঃ) আরো গভীরভাবে তন্ময়াভিভূত হয়ে পড়েন এবং বোধশূন্য হয়ে উপর হয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন। আমি তাকে অনেকক্ষণ ঠেস দিয়ে রাখলাম। অতঃপর হুঁশ ফিরে এলে তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের মাঝে ফয়সালা করার জন্য তাদের কাছে উপস্থিত হবেন। সমস্ত উম্মতই তখন নতজানু হয়ে থাকবে। অতঃপর হিসাব-নিকাশের জন্য সর্বপ্রথম যাদের ডাকা হবে তারা হল কুরআনের হাফেজ, আল্লাহর পথের শহীদ এবং প্রচুর ধনৈশ্বর্যের মালিক। আল্লাহ সেই কারী (কুরআন পাঠক) কে জিজ্ঞেস করবেন, আমি আমার রাসূলের কাছে যা পাঠিয়েছি তা কি তোমাকে শিখায়নি? সে বলবে, হে রব! হ্যাঁ শিখিয়েছেন। তিনি বলবেন, তুমি যা শিখেছ তদনুযায়ী কি কি আমল করেছ? সে বলবে, আমি রাত-দিন তা তেলওয়াত করেছি। তখন আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ, ফেরেশতারাও বলবে তুমি মিথ্যা বলেছ। আল্লাহ তাকে আরো বলবেন, বরং তুমি চেয়েছিলে যে, তোমাকে বড় ক্বারী (হাফেজ) ডাকা হোক। আর তা তো ডাকা হয়েছে। অতঃপর সম্পদশালী ব্যক্তিকে হাযির করা হবে। আল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করবেন, আমি কি তোমাকে প্রচুর সম্পদ দেইনি? এমনকি তোমাকে আমি কারো মুখাপেক্ষী রাখিনি। সে বলবে, হ্যাঁ অবশ্যই হে আমার রব। তিনি বলবেন, আমার দেয়া সম্পদ থেকে তুমি কি কি (সৎ) আমল করেছ? সে বলবে, আমি এর দ্বারা আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রেখেছি এবং দান-খয়রাত করেছি।
আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ, ফেরেশতারাও বলবে, তুমি মিথ্যাবাদী। আল্লাহ আরো বলবেন, তুমি চেয়েছিলে যে, লোকমুখে তোমাকে দানশীল দানবীর বলা হোক আর এরূপ তো হয়েছেই। অতঃপর যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে শহীদ হয়েছে তাকে হাজির করা হবে। আল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করবেন, তুমি কিসে শহীদ হয়েছে? সে বলবে, আপনি তো আদেশ করেছিলেন আপনার রাস্তায় জিহাদ করতে। কাজেই আমি জিহাদ করতে করতে শাহাদাত বরণ করেছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ, আর ফেরেশতারাও তাকে বলবে, তুমি মিথ্যাবাদী। আল্লাহ আরো বলবেন, তুমি চেয়েছিলে লোকমুখে একথা ছড়িয়ে পড়ুক যে, অমুক ব্যক্তি খুব সাহসী বীর। আর তাতো বলাই হয়েছে। অতঃপর রাসূল (সাঃ) আমার হাঁটুতে হাত মেরে বলেনঃ হে আবু হুরায়রা! কিয়ামতের দিন আল্লাহর সৃষ্টির মধ্য থেকে এ তিনজন দ্বারাই প্রথমে দোযখের আগুন প্রজ্বলিত করা হবে। আবু উসমান আল-মাদাইনী বলেন, আমাকে উক্বা বলেছেন যে, উক্ত শুফাই (শাফী) হযরত মুআবিয়া (রাঃ) এর কাছে গিয়ে এ হাদীস বর্ণনা করেন। আবু উসমান আরো বলেন, আলা ইবনে আবু হাকীম আমার কাছে বর্ণনা করেছেন যে, সে (শাফী) ছিল মুআবিয়া (রাঃ) এর অসিবাহক। সে বলেছে যে, জনৈক ব্যক্তি মুআবিয়া (রাঃ) এর কাছে এসে আবু হুরায়রা (রাঃ) এর সূত্রে উক্ত হাদীস বর্ণনা করেন। তখন মুআবিয়া (রাঃ) বলেন, তাদের সাথে যদি এরূপ করা হয় তবে অন্যসব লোকের কি অবস্থা হবে? অতঃপর মুআবিয়া (রাঃ) খুব বেশি কাঁদলেন। এমনকি আমরা ধারণা করলাম যে, তিনি কাঁদতে কাঁদতে মারা যাবেন। আমরা বলাবলি করতে লাগলাম, এই লোকটিই আমাদের এখানে অনিষ্ট নিয়ে এসেছে (অর্থাৎ সে যদি এ হাদীস বর্ণনা না করত তবে এ দুর্ঘটনা ঘটত না)। ইতিমধ্যে মুআবিয়া (রাঃ) হুঁশ ফিরে পেলেন এবং তার চেহারা মুছলেন, অতঃপর বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সত্যই বলেছেন। (এই বলে তিনি নিম্নোক্ত আয়াত তিলাওয়াত করেন) “যে কেউ পার্থিব জীবন ও এর সৌন্দর্য কামনা করে, আমি তাদের কাজের পূর্ণ ফল দুনিয়াতে দিয়ে থাকি এবং তথায় তাদেরকে কম দেয়া হবে না। তাদের জন্য পরকালে দোযখ ছাড়া আর কিছু নেই এবং তারা যা করে আখেরাতে তা নিষ্ফল হবে এবং তারা যা করে থাকে তা বিফলে যাবে” সূরা হুদ- ১৫,১৬। অন্য একটি রেওয়াতে আছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, তোমরা জুব্বুল হুযন থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা কর। তারা জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ‘জুব্বুল হুযন’ কি? তিনি বলেন: তা দোযখের মধ্যকার একটি উপত্যকা; যা থেকে স্বয়ং দোযখও দৈনিক শতবার আশ্রয় প্রার্থনা করে। জিজ্ঞেস করা হল, হে আল্লাহর রাসূল! তাতে কে প্রবেশ করবে? তিনি বলেন, যেসব কুরআন পাঠক লোক দেখানো আমল করে। হে আল্লাহ তুমি আমাদেরকে লোক দেখানো আমল থেকে হেফাজত করুন। আমিন।
লেখক: সভাপতি-রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি)
রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল