আমাদের দেশের এ জনপদে গানের প্রধানতম ধারা লোকসংগীত। ভাব, বিষয়, উপস্থাপনা এবং জনপ্রিয়তায় লোকসংগীত অনন্য। আর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যুগ যুগান্তরের প্রচলিত, কিস্সা,প্রবাদ, গীত এবং সমধিক শ্রুত বা কিছু বিলুপ্তপ্রায় গান, কথা ও সুর সমূহের অন্তর্ভুক্ত বাউল গান, ভাটিয়ালি গান, পালাগান, কবি গান, কীর্তন, পালা কীর্তন, লীলাকীর্তন, সংকীর্তন, ঢপকীর্তন, ঘাটুগান, জারীগান, সারিগান, মুর্শিদী গান, ভাওয়াইয়া গান, ধামাইল গান, গম্ভীরা গান, ঢপযাত্রা, সংগযাত্রা, বিয়ের গান, মেয়েলি গান, বিচ্ছেদী গান, বারোমাইস্যা গান, পুঁথি গান, পালকীর গান, ধান কাটার গান, ধান ভানার গান, হাইট্টারা গান, গাইনের গীত, বৃষ্টির গান, ধোয়া গান, শিবগৌরীর গীত, গাজীর গান, পটগান, আদিবাসীদের গান বা পাহাড়ি গান, মরমী গান, দেহতাত্ত্বিক গান, আধ্যাত্মিক গান, তত্ত্বগান, অহীরা, ছেচড় গান, জাওয়া গান, জাগগান, ঝুমুর গান, মাইজভাণ্ডারি গান, আঞ্চলিক গান, জাপান, টুসুগান, তরজা গান, লেটো গান, হ্যাপু গান, ভাদুগান, ভাসান গান, হোলি গান আরো কত কী।
লোকসংগীতের এ গানগুলিতে লোকজীবন, লোককাহিনির নানা অনুসঙ্গ উচ্চারিত হয়। মানুষের জীবন, আবাস, জীবন প্রণালী, পরিধেয়, নানান আচার অনুষ্ঠান, আয়, অর্থ, জাত পাত, প্রেম, সুখ দুঃখ বিচ্ছেদ বেদনা, আশা নিরাশা এক কথায় লোকসংগীতে সমকাল ও সমাজ বাস্তবতা বাঙময় হয়ে ওঠে মেধাবী এ সকল লোক সংগীত শিল্পীদের অপূর্ব ও নান্দনিক পরিবেশনায়।
‘গাইনের গীত‘ লোকসংগীতের অন্তর্গত একটি সংগীত শাখা যা এক সময় বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলে খুবই জনপ্রিয় ছিল। একজন গায়েন একদল দোহার এই গাইনের গীত পরিবেশন করত বন্দনার মাধ্যমে। তারা সাধারণ মানুষের মনোরঞ্জনের পাশাপাশি হাস্যরসের আদলে সমাজের নানা অসংগতি তুলে ধরত। অপূর্ব সুর, অঙ্গভঙ্গি ও হাস্যরসাত্মক বয়ানের মাধ্যমে কখনো কখনো খণ্ড খণ্ড ঘটনা, গল্প তুলে ধরে মানুষকে প্রচুর আনন্দ দিত। কিসসা পালার মতো এ গান ময়মনসিংহের গ্রামে গঞ্জে গীত হয়ে আসছে প্রাচীন কাল থেকে। এই গানের প্রচলন প্রধানত ভাটিঞ্চল, কেন্দুয়া কিশোরগঞ্জ, নান্দাইল, ঈশ্বরগঞ্জ গৌরীপুর অঞ্চলে। হিন্দু মুসলিম সবাই শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস ভরে আল্লাহ্ এবং ঈশ্বরের কৃপা লাভের আশায় সকল অমংগল দূরীকরণের জন্য এ গান শুনতো আদরে সমাদরে।
গাইনের গীতের গায়ক বা গাইনকে বলা হত গীতালু, গাজীর গায়েন বা বয়াতী। গাইন অর্থ গায়ক বা গাইয়া। বিচিত্র পোশাকে, লম্বা চুল, গলায় মালা ও তসবীহ। হাতে একটি আশা, অগ্রভাগ ত্রিশূলের মত গীতালুর হাতে। সবার মঙ্গল কামনায়, রোগ বালাই ও বিভিন্ন অসংগতি দূরীকরণে নৃত্যে, ছন্দে, কথা ও সুরে গীত গেয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করত এবং সবার সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টা করত। কখনো গীত শেষে দর্শক, শ্রোতা নারী পুরুষ নির্বিশেষে আশীর্বাদ বা দোয়ার ছলে মাথায় হাত বুলিয়ে সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করত। নারী পুরুষ এতে অনেকটা আশান্বিত হয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করত।
গাইনের গীতের শ্রোতা দর্শক সকল শ্রেণির জনসাধারণ হলেও গাইনের দৃষ্টি থাকতো পালা কীর্তনের মতো নারী শ্রোতাদের সন্তুষ্টি লাভের দিকে।
বখশিস, সালামী, প্রণামীর আশায় নারী শ্রোতাদের সন্তুষ্ট করার চেষ্টায় তারা গীত করত। তারা গানে, সুরে, কথায় বিভিন্ন নারীর আচরণ, চাল চলন, অবয়ব, অঙ্গভঙ্গি, স্বভাব চরিত্র, সংসার কাজকর্ম, শারীরিক গঠন, সময়, কাল, ষড়ঋতুর প্রভাব ইত্যাদি নিয়ে সমালোচনা, উপদেশ, কখনো নেতিবাচক শব্দ বা উক্তি প্রকাশ করতেন। কিন্তু নারীরা তাদের মংগল বা কল্যাণের জন্য এসব বয়ান ভেবে আনন্দ চিত্তে তা মেনে নিয়ে টাকা কড়ি, চাল ডাল, বা বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করত। এ গানের আয়োজকরা সার্বিক মংগলের জন্য এ গানে আয়োজন করত।
বাংলাদেশের লোকসংগীতের ভাণ্ডারে ব্যবহৃত অনেক বিষয়ের মাঝে আমরা বহুকাল আগে গীত, প্রচলিত, শ্রুত ও জনপ্রিয় ‘গায়েনের গীত’ এ বিশেষত নারীদের বিবিধ অনুষঙ্গের নিম্নোল্লিখিত ঐশ্বর্যপূর্ণ নানা বিবরণ পাই যেমন–
নারী হাসি, নারী খুশী, নারী লক্ষ্মীর মূল / নারী দুইন্যার, নারী আখের, নারী ভেস্তের (বেহেস্তের) ফুল। মুখ আন্দাইরা ( মুখ কালা ) বেজার নারী, নারী মহাপাপ /দুষী নারী গলায় ফাঁসি, দুজখের উত্তাপ। পদ্মিনী নারীর শইলে (শরীরে) পদ্মের ঘেরান (ঘ্রাণ)/ আপন পতির বিদ্যমানে নাইকো পরের টান/ শংখনীয়া নারী ভাইরে উড়া উড়া মন/ দিবা নিশি তার খালিসাজন আর পিন্দন। হস্তিনীয়া নারী ভাইরে পায়ের গোছা মোটা / সেই না নারী রাইখ্যা যায় বংশের লাগি খোঁটা। নাগিনী যে নারী আছে গেলে তার পাশে / ছয় মাসের আয়ু কমে অঞ্চলের বাতাসে / চিন্তনীয়া নারী ভালা চিন্তায় থাকে মন / দিবা নিশি করে নারী স্বামীর ভজন। থমথমাইয়া হাডে নারী চোখ পাকাইয়া চায় / রাক্ষসিনী সেই নারী কসম আগে খায়। উচ কপালী চিরল দাঁতি পিংলা মাথার কেশ / করলে বিয়া সেই নারী ভর্মন(ভ্রমণ) নানান দেশ / এক জাইত্যা নারী আছে পাড়ায় পাড়ায় যায় / এর কথা হেরে কইয়া পান সুবারি (সুপারী) খায়। ঝামটা দিয়া কয় কথা দবদবাইয়া চলে / সেই নারীর স্বামীর সংসার যায় রসাতলে। লম্বা কাইকে ( লম্বা চরণ) চলে নারী / কথা ভাঙা সুরে / সেই নারী করলে বিয়া অসুখ যায় না দূরে। ঠ্যাস মাইরা কয় কথা মিছা ঠমক মারে / সেই নারী করলে বিয়া লক্ষ্মী পলায় দূরে। চিক্কন পায়ের গোছা ভাইরে মাথায় পাতলা চুল / সেই নারী করলে বিয়া রয়না জাতি কুল। আরেক জাইত্যা নারী সদাই গাল ফুলাইয়া রয় / ঘরের শান্তি নষ্ট করে স্বামীর দুঃখ অয়। ঘোর সন্ধ্যায় যে বা নারী হলদি বিলায় / হানজু বছর বেওয়া আইয়া (পতিহীনা) বাপের বাড়ি যায়। সন্ধ্যা বেলা যে বা নারী ঘরে দেয় না বাত্তি / লক্ষ্মী উইঠা কয় তারে তর কপালে লাত্তি। উডান হুইরা যে বা নারী দক্ষিণে দেয় ঝাড়া / লক্ষ্মী আইবার চাইলে থাকে সীমানায় খাড়া। উগারে না উইঠ্যা নারী জুরে রাও করে / লক্ষ্মীয়ে কয় শেল মারিলা আমার অন্তরে। ভর দুপুরে যে নারী জুইড়া দেয় বাড়া / লক্ষ্মীয়ে কয় হায় ভগবান ছাইড়া গেলাম পাড়া। সন্ধ্যা বেলা যে বা নারী ঢেকিতে ধান ভানে / ষাইট দিনের রুজি স্বামীর কমে একদিনে। সন্ধ্যা বেলা যে বা নারী আচড়ে মাথার চুল / ঝগড়া বিবাদ তার সংসারে সদাই গন্ডগোল। চুল ছাইড়া, পাও মেইলা, যে নারী বসে বিছানায় /লক্ষ্মী তো ভাই দূরের কথা অলক্ষ্মীও ভয় পায়। রান্না কইরা যে বা নারী স্বামীর আগে খায় / সভাত গেলে তার স্বামী জুতার বারি খায়। গোছল কইরা যে বা নারী কাপড় চিপে পায় / আতে (হাতে) ধইরা চৌদ্দ পুরুষ দুযখে ডুবায়। গোছল কইরা যে বা নারী মুখেতে দেয় পান / লক্ষ্মী মায়ে উইঠা কয় সে আমারি সমান। সতী নারীর পতি ভাইরে মসজিদের চূড়া / অসতী নারীর পতি ভাইরে ভাঙা নায়ের গুড়া।
আমরা প্রতিটি পদের কোনটিতে হাসী খুশীভরা নারী, কখনো লক্ষ্মী বা বেহেস্তের ফুল হিসেবে পাই। কখনো কিছু নারীর স্বভাব চলনে দোযখী ভাবের বয়ান পাই। নারীকে কখনো পদ্মিনী, শংখিনী, হস্তিনী, নাগিনী, চিন্তনীয়া, রাক্ষসিনী, উচ কপালী, চিরল দাঁতি হিসেবে উপস্থাপন করতে দেখি। কখনো চালচলন, অঙ্গভঙ্গি, কথা বলা, চুলের গঠন, পায়ের আকার ভেদে লক্ষ্মী বা অপয়া রূপে পাই। গোমরামুখী নারী অলক্ষ্মী, যাদের জন্য সংসারে সুখ নষ্ট হয়। কোথাও কোথাও স্বামীর মংগল অমংগলের জন্য নারীকে দায়ী করা হয়েছে। সতী নারী, অসতী নারীর বর্ণনা সুরে, ছন্দে, তাল, নৃত্যে বর্ণিত হয়েছে। বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রে এ সকল বাক্য প্রবাদের অনেকগুলোর সত্যতা পাওয়া যায় তা যতই হাস্যরসে, ঠাট্টা মশকরা রূপে, আদেশ উপদেশরূপে বয়ান করা হোক না কেন। বাংলাদেশের লোকসাহিত্য ও লোকসংগীতের অমূল্য এ ভাণ্ডারে অনেক কাহিনি, কাব্যে অজানা অচেনা তথ্য স্বর্ণ, রৌপ্য, মণিমাণিক্যের সভান রূপে অধরাই রয়ে গেছে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সংগীতশিল্পী, লোকগবেষক।