লোকসাহিত্যের অন্যতম একটি প্রধান ধারা হল লোকসংগীত। সাধারণ জনজীবনের নানাবিধ অভিব্যক্তি লোকসংগীতে সরাসরি প্রকাশ পায় বিধায় বাংলাদেশে লোকসংগীতের জনপ্রিয়তা অন্য গানের চেয়ে বেশি। বিশেষত সাধারণ জনগণের কাছে।
আধ্যাত্মিকতা জীবন যাপনের একটা ধরণ–বাড়ির বাগানের মত। সেখানে ফুল ফোটাতে হলে যত্ন নিতে হবে সেইরকম ভাবেই। আপনার শরীর মন আবেগ শক্তিগুলোকে যদি বিশেষভাবে পরিচর্যা করেন তাহলে আপনার মধ্যে আলাদা কিছু একটা প্রস্ফুটিত হবে। সেটাই আধ্যাত্মিকতা। আধ্যাত্মিক মানুষ হল সেই ব্যক্তি যিনি সত্যের অনুসন্ধানে থাকেন।
শিরোনামের গ্রন্থটির লেখক ইকবাল হায়দার। নামের সাথে গ্রন্থকারের চিন্তার সাযুয্য লক্ষণীয় অর্থাৎ এতে আধ্যাত্মিকতার অনুসন্ধান আছে। ১৫টি প্রবন্ধের সমন্বয়ে এ গ্রন্থ। এতে প্রচুর পঠন পাঠনের সাথে যুক্ত হয়েছে সমীক্ষার তথ্য উপাত্ত। সে কারণে প্রবন্ধগুলি হয়ে উঠেছে আরও বহুল সত্যনিষ্ঠ। লোক সাহিত্যের বিশেষ মাধ্যম লোকগান। এ সকল গানে আধ্যাত্মিকতার অনুসন্ধানে লেখক ইকবাল হায়দার ব্রতী হয়েছেন গভীর ভালোবাসায়। আর তিনি এ বিষয়ে নিয়মিত বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লিখছেনও।
আধ্যাত্মিকতার অনুসন্ধানে লেখক লোক সংগীতের উৎস, গতি প্রকৃতি, বাহিরানা বিষয়ে তিনটি প্রবন্ধে আলোকপাত করেছেন গভীর নিষ্ঠার সংগে ও বর্ণিল ছন্দে। তার লেখায় ছোট ছোট বাক্য, সহজ, সরল এবং একেবারে কবিতার মতো সকল উপমা, নান্দনিক শব্দ মানুষের মনে এক ধরনের ঝংকার তোলে।
উৎসে তিনি এনেছেন প্রকৃতি, মানুষের যাবতীয় অনুভূতি, লোকসংগীত সৃষ্টির উপাদান, গায়কী, বিভিন্ন সুরের মিশ্রণ, লোকসংগীতের ভাণ্ডার এবং লোক গানের বিভিন্ন ধরন। যেমন–কবি গান, জারীগান, সারিগান, গম্ভীরা, বাউল গান, ভাওয়াইয়া, পল্লী গীতি, আধ্যাত্মিক, মরমী, বিচ্ছেদী, দেহতেত্ত্ব, মাইজভাণ্ডারি, অহীরা গান সহ আরো বিভিন্ন গান যা মানব মনের চিরন্তন ব্যথা, বেদনা, আবেগ, উচ্ছ্বাস থেকে উৎসারিত।
লোকসংগীতের গতি প্রকৃতি প্রবন্ধে লেখক তাঁর দৃষ্টিকোণ থেকে যে বৈশিষ্ট্যগুলো আলোকপাত করা হয়েছে এভাবে– ১.সংগীতের শুরু, ২.লোকসংগীত সংগীতের চৌষট্টি কলার একটি, ৩.বিরহ, মিলন, অনুরাগ, বিরাগ, হৃদয়ের আকুতি, আবেগ উচ্ছ্বাসের উৎস, ৪.লোকসংগীতের সুরবিন্যাস, ৫.কিভাবে গীত হয়, ৬ লোকসংগীতের গঠন ও বিন্যাস ইত্যাদি ।
একই সঙ্গে উদ্ধৃত হয়েছে বিভিন্ন মনীষীর সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা। বলা যায় একেবারে অনুসন্ধানী আলোচনা যা পাঠক মনকে ঋদ্ধ করে।
শাস্ত্রীয় সংগীতে আছে ‘ঘরানা’ যা নিয়ম নীতির কঠোর বাঁধনে আবদ্ধ। কিন্তু লোকসংগীতে আছে বাহিরানা যার আছে নিয়ম বহির্ভূত অবারিত সীমাহীনতার পরিধি। মুক্ত অবারিত কণ্ঠে সবাই গাইতে পারে। নানা ধারায়, নানা বিশ্লেষণে, চর্চায় এই বাহিরানা বিষয়টি বিশেষত হেমাঙ্গ বিশ্বাসের উদ্ধৃতিতে সহজ সরল ভাষায় বিশ্লেষণ করেছেন ইকবাল হায়দার।
একই সংগে লোকসংগীতের ভান্ডার নিয়ে চমৎকার কথনে এসেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন লোকসংগীতের বিষয় আশয়, বিশেষত লোকসংগীতের সাথে বাঙালির প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর গভীর সম্পৃক্ততার কথা আছে তার কাব্যিক বর্ণনায়। তিনি শেষ করেন বাতাসে, বৃষ্টিতে, ঢেউয়ের তালে, সবুজের গাঢ়তায়, রোদে, ঝড়ে, ধূলার পথে তা আরো পরিব্যাপ্ত, এই সংগীতের বিস্তৃতিই লোকসংগীতের বাহিরানা।
জনপ্রিয় লোকসংগীত হল বাউল গান। এই গানে আধ্যাত্মিকতা আছে, প্রেম আছে, দেহতত্ত্ব আছে এবং এতে বৈষ্ণব ও সুফী উভয় ধারার প্রভাব লক্ষণীয়। এ বিষয়টি গভীর অধ্যয়নে বর্ণনা করেছেন ইকবাল হায়দার।
যৌক্তিকভাবে রবীন্দ্রনাথের কথা এসেছে। যেহেতু লালন সাঁইজীর গানের মধ্য দিয়ে বাউল গান ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে সেই লালন গানের সংগ্রাহক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কথিত আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখার টেবিলে বেদ, পুরাণ, কোরান, বাইবেল ও লালনের জীবনী গ্রন্থ সব সময় থাকতো। তার রবি চিত্তে বাউল গানের প্রভাব ছিল। ‘খাচার ভিতর অচিন পাখী কেমনে আসে যায়’ এ গান তরুণ রবীন্দ্রনাথের মনে দীক্ষা মন্ত্রের মতো দারুণ কাজ করেছিল।
লেখকের এই প্রবন্ধে বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক গানের অনেক গানের নামের সাথে এসেছে চট্টগ্রামের মাইজভাণ্ডারি গান। আধ্যাত্মিক পর্বকে বিভিন্ন ভাবে ভাগ করে যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি। বাউল তত্ত্বের গভীর বিশ্লেষণ আছে এই অধ্যায়ে।
‘রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিকতা’ প্রবন্ধটির শুরুটা খুব মনোগ্রাহী। কবির ভেতর এই আধ্যাত্মিকতার প্রবেশ কিভাবে, কেমন করে করেছে তার অনেকটা বিস্তৃত বিশ্লেষণ এবং উপসংহারে তিনি বলেন ‘রবীন্দ্রনাথ নিরক্ষর হলে লালন ফকিরের মত মরমী কবি হতেন, আর লালন শাহ শিক্ষিত হলে হতেন রবীন্দ্রনাথের মত বিদগ্ধ কবি’।
‘বাউলের রূপময়তা’ প্রবন্ধে ছোট ছোট বাক্যে, রূপকের ব্যবহারে, মাধুর্যমণ্ডিত ব্যাখ্যায় তিনি বাউলে দর্শনের বিশ্লেষণ করেছেন। পাখির মত বাউলরা মিলনের, বিচ্ছেদের, বিরহের গান করেন। বাউল আমাদের আবেগের আশ্রয়ের শেষ স্থল, ঐতিহ্যের শেকড়। প্রাচীন কাল থেকে আজ অবধি বাঙালির সাথে বিভিন্ন মত, পথ ও জাতের উদ্ভব হয়েছে, সৃষ্টি হয়েছে নানা তত্ত্ব। কিন্তু শান্তিপ্রিয় মানুষ বেছে নিয়েছে সুফিবাদ, চৈতন্যবাদ, বৈষ্ণববাদ অথবা বাউল মতবাদ। তবে বাউলদের জীবন, দর্শন, মন, চলন, বলন বড়ই রহস্যময়। মত ভিন্ন, কিন্তু পথ বা দর্শন অভিন্ন।
বাউল পাঠে জানা যায়, তার মূলে আছে মানবিকতা, অসামপ্রদায়িকতা, আত্মশুদ্ধি, আহ্বান ইত্যাদি। তবে মূল হচ্ছে নিজেকে চেনা ‘কহড় িঞযুংবষভ’ আত্মাকে বাউলরা বলেছে, অচিন পাখি, মনের মানুষ। মানবতাই আসল দর্শন। ‘বাউলের রূপময়তায়’ ইকবাল হায়দার বাউলের বিভিন্ন দিকের ব্যাখ্যা দিয়েছেন গভীর সাধকের সাধনার মতো। মাইজভাণ্ডারি গান মাইজভাণ্ডারি ধারার অনুসারীদের গাওয়া মরমী গান। এর প্রবর্তক সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারি। প্রায় একশত বছরেরও আগে চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলায় এ ধারার উদ্ভব হয়।
আলোচ্য গ্রন্থে লেখক কীভাবে এর বিস্তার, বিখ্যাত গীতিকারদের লেখা গানে গায়করা কীভাবে ইসলাম ধর্মে গানের অনুমোদন ও তাকে জনপ্রিয় করে মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন এবং মাইজভাণ্ডারি গানের মৌলিকত্ব ও বিকৃতি বিষয়ে অসাধারণ বর্ণনা দিয়েছেন।
শেষটা বড় সুন্দরভাবে লিখলেন,
মাইজভাণ্ডার ভক্তির ভাণ্ডার / মাইজভাণ্ডার ভাবের ভাণ্ডার/ মাইজভাণ্ডার সুরের ভাণ্ডার/ মাইজভাণ্ডার রসের ভাণ্ডার/ মাইজভাণ্ডার দয়ার ভাণ্ডার/ মাইজভাণ্ডার গুণের ভাণ্ডার/ মাইজভাণ্ডার প্রেমের ভাণ্ডার/ এভাবে চমৎকার উপসংহার টেনেছেন।
‘সুফীবাদ: মাইজভাণ্ডারি ত্বরীকা’ প্রবন্ধে তার বিশ্লেষণ গবেষণা ধর্মী। সুফীবাদ একটি আধ্যাত্মিক দর্শন। ‘সুফ’ অর্থ পশম আর তাসাউফ অর্থ পশমী বস্ত্র পরিধানের অভ্যাস। মরমী তত্ত্বের সাধনায় করো জীবনকে নিয়োজিত করার কাজকে বলা হয় তাসাউফ। যিনি নিজেকে এরূপ সাধনায় সমর্পিত করেন তিনিই সুফী। সুফীবাদের পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা, সুফী সাধনার ভিত্তি, মাইজভাণ্ডারি দর্শন, সেমা ইত্যাদি বিষয়ে এমন তথ্য উপাত্ত হাযির করেছেন যা পাঠককে ঋদ্ধ করেছে। এখানে একটু বলতে হয় আমাদের নবীজী (দ.) বলেছেন, ‘মানবদেহে একটি বিশেষ অঙ্গ আছে যা সুস্থ থাকলে সমগ্র দেহ পরিশুদ্ধ থাকে, আর অসুস্থ থাকলে দেহ অপরিশোধিত হয়ে যায়’। জেনে রাখা ভালো এটি হল ‘কলব বা হৃদয়‘। আল্লাহর জিকির বা স্মরণে কলব কলুষমুক্ত হয়।
সুফীবাদের উদ্দেশ্যই এটি। আর এর উৎকর্ষ লাভ করে পারস্যে সুফীবাদ ভিত্তিক চারটি ত্বরীকা সর্বাধিক প্রসিদ্ধি লাভ করে।
যেমন :
১। হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (র.) প্রতিষ্ঠিত ‘কাদেরীয়া ত্বরীকা’। ২। সুলতানুল হিন্দ হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশতি (রঃ) প্রবর্তিত ‘চিশতিয়া ত্বরীকা’। ৩। হযরত খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দী (র.) প্রবর্তিত ‘নকশবন্দীয়া ত্বরীকা‘। ৪। হযরত শেখ আহমদ মোজাদ্দিদ – ই আলফেছানী সারহিন্দ(র.) প্রতিষ্ঠিত ‘মুজাদ্দিয়া ত্বরীকা’। আর মরমী সুরে, তালে, ছন্দে রসুলের বাণীর প্রতি আকর্ষণ করার কৌশলই ‘মাইজভাণ্ডারি ত্বরীকা‘।
প্রেমে, বিচ্ছেদে, সংগ্রামে পুণ্যভূমি চট্টগ্রাম ‘ এ প্রবন্ধের শুরু লেখকের গান দিয়ে। এর পরে উড়ন্ত পাখির মতো বাংলাদেশের মানচিত্রে মায়াবী পুচ্ছের মতো চট্টগ্রামের কি মোহময়, মায়াময়, ছন্দোময় বর্ণনা লেখকের অপূর্ব!
এভাবে বিখ্যাত গায়কদের গানে গানে ও সুরে বিধৃত হয়েছে চট্টগ্রামের কাব্যিক বর্ণনা, যে সকল গানে উঠে এসেছে চট্টগ্রামের প্রেম, বিচ্ছেদ ও সংগ্রামের কথা। এভাবে ‘চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানে মৃত্যু চিন্তা‘র বিষয়টিও তিনি তুলে ধরেছেন গভীর সাধকের মতো।
‘মরমীবাদের সহজ তত্ত্ব ও রবীন্দ্রনাথের অরূপ সাধনা’ এ প্রবন্ধে বিশেষত তুলে ধরা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের মরমী সাধনার কথা। লেখকের ভাষায়, ‘কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপলব্ধিতে, জ্ঞানে, গভীর নিমগ্ন চিন্তায়, অনুরঞ্জনে, মনোরঞ্জনে, সহজ সাবলীল মনোগ্রাহী ভাষায় ব্যবহারে, অনুধাবনে, অনুরক্তিতে, অনুভবে সেই অরূপ সাধনার কথা অবলীলাক্রমে বিবৃত হয়েছে। এভাবে তার মরমী গানের প্রথম লাইনে চমৎকার উপস্থাপনা অনুধাবন করলেই উপলব্ধি করা যাবে রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিক অনুভবকে। ‘রামকৃষ্ণ, রবিবাউল ও মহাত্মা লালন’ আধ্যাত্মিক অনুভবের বিষয়টি পাঠকের মনোজগতকে সমৃদ্ধ ও আলোকিত করেছে এই প্রবন্ধের বিষদ ব্যাখ্যায়।
‘মাইজভাণ্ডারি ত্বরীকায় সুফী সংগীত: মাইজভাণ্ডারি গান ও সামা’। এ প্রবন্ধে লেখকের কয়েকটি বাক্য যেন ‘অনেক কথা যায় যে বলি‘র মতো।’ মাইজভাণ্ডারি গানের মাহাত্ম্য তার শব্দ সৌন্দর্য, বাক্য সৌন্দর্য, ভাব সৌন্দর্য, সুর সৌন্দর্য, নিপুন গঠনশৈলী সম্বৃদ্ধ হৃদয় গ্রাহী গান।
সুফীজম– বিষয়ে শেষ প্রবন্ধ ইংরেজীতে লেখা। সুফীবাদ কি অর্থাৎ আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন সম্পর্কে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এটি পূর্বে আলোচিত প্রবন্ধ ‘সুফীবাদ ও মাইজভাণ্ডারি ত্বরীকা’র ইংরেজি অনুবাদ।
শেষ প্রবন্ধ সংগীত, আধ্যাত্মিকতা ও শিল্পীর দায়‘-এই তিন বিষয়ের গভীর সম্পর্ক তুলে ধরেছেন চমৎকারভাবে। যে সকল শিল্পী আধ্যাত্মিক গানের সাধনা করছেন তাদের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ গ্রন্থটির প্রকাশক ‘কালধারা প্রকাশনী’র স্বত্বাধিকারী মহিউদ্দিন শাহ আলম নিপু। স্বল্প বাক্যে সুন্দর মূল্যায়ন করেছেন তিনি লেখককে। ছাপা ঝকঝকে, বানানে ভুল চোখে পড়েনি। সুন্দর ও নান্দনিক প্রচ্ছদ করেছেন লেখককে মেয়ে হায়দারী আন্দালুসিয়া। প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারী – ২০২২। মূল্য– ২৫০ টাকা। অভিনন্দন কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার, সুরকার, লেখক ও গবেষক ইকবাল হায়দারকে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক; সাবেক অধ্যক্ষ, আগ্রাবাদ মহিলা কলেজ।