গত কিছুদিন ধরে লোকমান ভাইয়ের সাথে যত বার কথা হয়েছে, তিনি বলতেন, আমি আসব, তোমাকে সাথে নিয়ে চট্টগ্রামে আমি কিছু কাজ করতে চাই। তাঁর আর আসা হলো না চট্টগ্রামে। আমাকে নিয়ে কোন কাজও করা হল না। গত বৃহস্পতিবার (৯ আগস্ট ২৩) সকাল সাতটার দিকে তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। কেউ বলতেন প্রফেসর লোকমান হাকিম, কেউ বলতেন অধ্যাপক লোকমান। দুই নামে তিনি সমধিক পরিচিত ছিলেন রাউজানের মানুষের কাছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে অনার্সসহ এম.এস.সি পাস করার পর তিনি যোগদান করেন চট্টগ্রাম সিটি কলেজে। সম্ভবত সেটা ১৯৬৮ সালে। এর পাশাপাশি তিনি এনায়েত বাজার মহিলা কলেজেও অধ্যাপনা করেছেন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার আগ পর্যন্ত। লোকমান সাহেবের রাউজানের জনগণের সাথে পরিচিত শুরু হয় ১৯৭০ সালে দৈনিক আজাদী সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের এম. এন এ নির্বাচনের সময় চট্টগ্রাম কলেজে পড়াকালীন তিনি শিক্ষা, শান্তি প্রগতির ছাত্রলীগের সংগঠন যাত্রিক এর সভাপতি ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্রলীগের সকল কর্মকান্ডের সাথে জড়িত হন এবং এক সময় এস এম হলের ছাত্রলীগের সভাপতির পদ অলংকৃত করেন। সে সময় তিনি ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমদ, আবদুর রাজ্জাক, মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেননসহ সকল রাজনীতিবিদদের সাথে সকল সংগ্রামে অংশগ্রহণের সুযোগ পান।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি অধ্যাপক খালেদ সাহেবের প্রধান নির্বাচনী এজেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। সেই থেকে তিনি অধ্যাপক খালেদের ডান হাত হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন এবং পরবর্তী বঙ্গবন্ধুর ৭১ সালের ৭ ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর তিনি রাউজান আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার কাজ করেন। ২৫ শে মার্চ কাল রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার ও বাঙালি জাতির উপর হামলার পর তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের অনেককে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন এবং পরবর্তীতে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং রাউজান থানার সাউত্তর এলাকা কনুপাড়ায় পাক হানাদার বাহিনীর একটি হামলায় সরাসরি যুদ্ধে অবর্তীন হন। সেদিনের যুদ্ধের ডাবুয়ায় শহীদ হন। ২৫ শে মার্চের পরে যখন চট্টগ্রাম শহর থেকে হাজার হাজার মানুষ কাপ্তাই রোড ধরে পাহাড়তলী হয়ে হাফেজ বজলুর রহমান রোড ধরে ভারতের দিকে যেতে থাকে তখন আমরা অধ্যাপক লোকমান হাকিমের নির্দেশে প্রায় দশদিন ধরে ঢেউয়া হাজীপাড়া সরকারি স্কুলে জনগণের খাবারের ব্যবস্থা করি। স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে অর্থ, চাষীদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের সবজি নিয়ে খিচুড়ি রান্না করে খাইয়েছি।
দেশ স্বাধীন হবার পর খালেদ সাহেবের নেতৃত্বে রাউজানের চৌদ্দটি ইউনিয়নে আলাদা আলাদা পুনর্বাসন কমিটি গঠন করা হয়। কারণ মুক্তিযুদ্ধের আগ পর্যন্ত রাউজানের অনেকগুলো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন মুসলিম লীগপন্থী। স্বাধীনতার পর এই পুনর্বাসন কমিটি অঘোষিতভাবে প্রত্যেকটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান–মেম্বারদের দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক লোকমান খালেদ সাহেবের ছায়াসঙ্গী হিসেবে এই পুনর্বাসন কমিটিগুলোর সমন্বয় সাধন করেন।
স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এসে দেশের প্রত্যেকটি পুকুরকে পানির আধারে পরিণত করে শুকনো মওসুমে চাষাবাদের নির্দেশ দেন। সেই সময়ও খালেদ সাহেবের সহযোগী হিসেবে অধ্যাপক লোকমান রাউজানের অনেকগুলো পুকুর খননের উদ্যোগ নিয়ে জলাধার তৈরী করেন। বঙ্গবন্ধুর আর একটি ঘোষণা ছিল তেভাগা আন্দোলন। এই তেভাগা আন্দোলনে শরীক হয়ে রাউজান পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান এ তৎকালীন আওয়ামীলীগের সভাপতি শফিকুল ইসলাম চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর হাত থেকে জাতীয় পুরস্কার গ্রহণ করেন।
১৯৭৩ সালের প্রথম দিকে আওয়ামীলীগের প্রার্থী হিসেবে এমপি নির্বাচনের প্রার্থী হলে সেই সময়ও অধ্যাপক লোকমান হাকিম প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারা রাউজানের আনাচে কানাচে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন। সাধারণ মানুষের সাথে খুব অল্প সময়ের মধ্যে খাতির জমিয়ে ফেলার অনন্য সাধারণ জ্ঞান ছিল অধ্যাপক লোকমান হাকিমের। ১৯৭৩ সনের দিকে লোকমান হাকিম শর্ট কোর্সের বিসিএস এর মাধ্যমে বিডিআরএ সহকারী পরিচালকের পদপ্রাণ। কিন্তু অধ্যাপক খালেদ সাহেবের কথা আপনারা চাকরি করবেন কেন? আপনারা মানুষকে চাকরি দেবেন। রাজনীতি করবেন, এমপি, মন্ত্রী হবেন এবং মানুষকে সাহায্য করবেন। খালেদ সাহেবের কথায় সায় দিয়ে তিনি রাজনীতি করে যান।
অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ এমপি থাকাকালীন কিছু কিছু পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে উন্নত জীবন দেয়ার জন্যে চিকদাইর ইউনিয়নের কসাই পাড়াকে আদর্শ গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। এসময় তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করানো, গৃহকর্তাদের গরু ও ছাগল কেনার জন্য অর্থের যোগান দেয়া, তাদের পুকুর খনন করে মাছ চাষের ব্যবস্থা করেন। এ সব কাজগুলোর বিষয়ে খালেদ সাহেবের পক্ষে লোকমান সাহেব সবগুলো বিষয়ে দেখাশুনা করতেন।
অধ্যাপক লোকমান হাকিম অত্যন্ত আড্ডাবাজ এবং বন্ধু বৎসল ছিলেন। আমাদের বাড়ির পার্শ্বে বাড়ির লোক হিসেবে আমরা এক সাথে বের হয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি সামাজিক কাজেও জড়িত থাকতাম। স্বাধীনতার পরে হলেও দেশের শান্তি শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল খুব শান্ত। আমরা এক সাথে কয়েকজন বিশেষ করে আমাদের সাথে আর্টিস্ট সোলায়মান, বন্ধু শামসুল আলম, শফিকুল আলম চৌধুরী (বেবী চৌধুরী) মুক্তিযোদ্ধা ইয়াছিন নগরের কামাল আড্ডায় মেতে থাকতাম। আড্ডার কারণে আমাদের অনেক সময় সার্কেল অফিসারের বাসায় ও স্থানীয় বিচারকের বাসায় রাত কাটাতে হতো। একবার ডিসেম্বর মাসে আমরা আবদুল হাই নামক বিচারকের বাসায় রাত কাটাই। ঐ রাতে আড্ডার এক ফাঁকে কথা উঠল কেউ যদি পুকুরে গোসল করতে পারে পরদিন ভোরে নেহারী আর নান দিয়ে খাওয়ানো হবে। প্রস্তাবটা ছিল মুক্তিযোদ্ধা ইয়াসিন নগরের কামাল উদ্দিনের। যথা কথা তথা কাজ। লোকমান সাহেব তৈরী হয়ে গেলেন গোসল করতে। তখন ঠান্ডায় সবাই জমে যাচ্ছে। সবাই পুকুর পাড়ে জমায়েত হলাম। লোকমান সাহেব নির্দ্বিধায় পুকুরে নেমে গোসল করে পরদিন সকালে সবাইর জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতের পর খালেদ সাহেব অনেকটা শহরমুখি হয়ে গেলেও লোকমান সাহেব রাউজান থানা আওয়ামীলীগের সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রাখার চেষ্টা চালিয়ে যান। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং এরশাদ সরকারের সময়েও তিনি আওয়ামী লীগের পতাকা হাতে দলের প্রতিটি নির্দেশনা পালন করেন। প্রেসিডেন্ট এরশাদের শাসনকালের শেষের দিকে উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে প্রথম উপজেলা পরিষদের প্রথম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এই ঘটনা তার রাজনৈতিক জীবনে একটি ভয়াবহ দুঃখ ডেকে আনে।
বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে অধ্যাপক লোকমান হাকিম ছয় মাস রাশিয়ার মস্কোতে সমবায়ের উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এরপর রাউজানে এসে তিনি একটি বেসরকারী সংস্থা (এনজিও) প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংস্থা নিয়ে কাজ করার সময় তিনি প্রশিকার চট্টগ্রামস্থ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে অংশ গ্রহণ না করার জন্য প্রশিকা থেকেও পরামর্শ দেয়া হয়। কিন্তু কিছু নিকট আত্মীয়ের চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত আওয়ামীলীগের সিদ্ধান্তের বাইরে উপজেলা নির্বাচন করেন। এরশাদের পতনের পর পর উপজেলা পরিষদগুলো অকার্যকর হয়ে গেলে তিনি রাউজান থেকে সপরিবারে কুমিল্লায় থিতু হন। সেখানে গিয়ে তিনি ‘পেইজ’ নামে একটি এনজিও গঠন করেন। কুমিল্লা পেইজ এর প্রধান কার্যালয় হলেও কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চাঁদপুরে তার কার্যক্রমে ব্যাপ্তি ঘটান অধ্যাপক লোকমান হাকিম। কুমিল্লায় অবস্থানকালে তিনি দিন বদলের পালা শিরোনামে দৈনিক আজাদীতে এবং অপর একটি নামে পূর্বকোণে দীর্ঘদিন লেখালেখি করেন। কুমিল্লায় অবস্থানকালে তিনি রোটারি ক্লাবের সাথে জড়িত হন। এছাড়াও তিনি কুমিল্লার চট্টগ্রাম সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক লোকমান হাকিম একজন সার্থক পিতা। তার দুইপুত্র ইঞ্জিনিয়ার এবং দুই কন্যার মধ্যে একজন গৃহিনী হলেও দ্বিতীয় কন্যা বর্তমানে পেইজ এর প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব পালন করছেন। আল্লাহ তাকে বেহেস্ত দান করুন এটাই আমাদের কাম্য।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক