টুপু এমন জায়গায় লুকায় কেউ আর খুঁজে পায় না। এরা এখানে সেখানে সবখানে খুঁজে দেখে। কোথাও পায় না। ছাদের খোলামেলা জায়গায় লুকানোর সুযোগ নেই। তবে পিলারের পাশে গা ঘেষে দাঁড়ালে এদিক থেকে দেখা যায় না। ফুলের টবের আঁড়ালে বসে থাকলেও সহজে খুঁজে পেয়ে যায়। বয়েডের ওপাশটায় লুকালেও এরা খুঁজে বের করে ফেলে। ছাদের দরজাটা অনেক বড়। খোলাই থাকে। দরজার আড়ালে লুকালে পা দুটো দেখা যায়। এখানেও বেশিক্ষণ লুকিয়ে থাকা যায় না। পা নামালে চোখে পড়ে যায়। দরজায় এরা কয়েকটা বাড়ি দেয়। লোহার দরজার, ঝম ঝম আওয়াজ হয়। ‘তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসো’। ‘তোমার পা কতক্ষণ লুকিয়ে রাখবে’। না কোন সাড়া শব্দ নেই। ‘এখানেও লুকায়নি’।
ওপাশটায় ছুটে যায় এরা। এপাশে ফ্লাটের অফিস রুম আর ইবাদত খানা। অফিস রুমটা বড়সড়। এখানে ফ্ল্যাট মালিকদের মাঝে মাঝে মিটিং হয়। সারি করে অনেক চেয়ার রাখা আছে। সেক্রেটারি টেবিল, ফাইল কেবিনেট, রেকও আছে। রুম খোলা থাকলে এখানে এসেও লুকাতে পারে। টেবিলের পা দানিতে বসে থাকলে সহজে চোখে পড়ে না। ফাইল কেবিনেটের পেছনে লুকালে একেবারে দেখা যায় না। তবে যেখানে লুকিয়ে থাকুক না কেন এরা এসব জায়গা থেকে খুঁজে খুঁজে বের করে ফেলে। যে প্রথমে দেখে সে চিল্লায়ে ওঠে। সাথে সাথে অন্যরা দৌঁড়ে এসে জড়ো হয়। বের করতে পারলে আনন্দের সীমা থাকে না। সবাই ‘পেয়েছি পেয়েছি’ বলে চিৎকার করতে থাকে। কখনো চেয়ারগুলো কোনায় একটার ওপর আরেকটা তুলে রাখা হয়। সেখানেও লুকানোর জায়গা হয়ে যায়। কিন্তু বেশিক্ষণ লুকিয়ে থাকতে পারে না। এরা খুঁজে বের করে নিয়ে আসে।
ইবাদত খানার পেছনে লুকানোর চিপা জায়গা আছে। তবে ওখানে যাওয়াটা মুসকিল। একটা দেয়াল টপকিয়ে যেতে হয়। দেয়ালটা থাকায় ওখানে লুকালে সহজে চোখে পড়ে না। ইবাদতখানার সাথে গা লাগিয়ে দিয়ে বসে থাকলে কেউ টের পায় না। টুপু এখানে একবার লুকিয়েছে। অনেক খোঁজাখুঁজি করে বের করতে পারে নি। সে চুপচাপ বসে থেকেছে। কেউ খুঁজতে এলে অনেকটা শুয়ে পড়েছে। যেন তাকে দেখা না যায়। তবে এ জায়গাটা পরিষ্কার না। বসতে মন চায় না। শুইলে কেমন যেন লাগে। আশে পাশে টিস্যু আর পাখির পালক। কার্নিসে জালালী কবুতর চুপ করে বসে থাকে। মেঘের মতো পালক, চোখ দুটি কেমন তামাটে। ভয়ও লাগে। তারপরও নিঃশব্দে বসে থাকে। নড়াচড়া করে না। এখানে এরা টুপুকে কোনমতে খুঁজে পায়নি। খুঁজতে খুঁজতে সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। দুই একজন দেয়ালের ওপর উঁকি দিয়ে দেখে। জায়গাটা অনেকটা আলো আধাঁরে ঢাকা থাকে। তারা আর খেয়াল করতে পারে নি। তাদের অনেকের চেয়ে দেয়ালটা উঁচু। তারা কেউ দেয়ালের ওপাশটা দেখতে পায় না। এখন তারা কি করবে? সবখানে খুঁজে দেখেছে। কোথাও তাকে খুঁজে পায়নি। খেলার নিয়ম হলো কোথাও খুঁজে না পেলে লুক ভাংগার জন্য শব্দ করতে বলা হয়। এদের একজন বলে, ‘তুমি কোথায় লুকিয়ে আছো, শব্দ কর। এখন তুমিই জয়ী’। তখন সে শব্দ করে ওঠে। ‘আমি এখানে আছি’। এরা প্রথমে বুঝতে পারেনি। ভাবতে পারেনি সে এখানে লুকাতে পারে। সে আবারও শব্দ করে। যে দুজন দেয়ালের ওপর দিয়ে দেখেছে তারা অবাক হয়ে যায়। টুপু শব্দ করে দেয়াল টপকে বাহিরে এসে দাঁড়ায়। তখন সবাই তাকে ঘিরে ধরে চিল্লাতে থাকে।
ছাদের দক্ষিণ পূর্ব কোনায় কাপড় শুকানোর সারি সারি স্ট্যান্ড। তার টানানো স্ট্যান্ডগুলো ছাদের সাথে ফিক্সড করা। এসব তারে অনেকে কাপড়ে শুকায়। কাথা কম্বল পর্দার মতো ভারি কিছুও এসব তারে শুকানো যায়। এখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কোন না কোন কাপড় ঝুলতে থাকে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কাপড়ের আড়ালে লুকিয়ে খেলা করে। অনেকে আবার ছাদে নানা রকম শস্য দানা রোদে দেয়। তখন পাখিদের আনাগোনা দেখা যায়। পাখিরা উড়ে এসে ছাদের গ্রীলে বসে। সুযোগ পেলে নিচে নেমে শস্য দানায় ঠোঁট দেয়। ছেলে মেয়েরা এতে খুব আনন্দ পায়। তারা পাখিদের কাছে ছুটে এসে দাঁড়ায়। পাখিরা এদিকে ওদিকে তাকায়। এদের তেমন পাত্তা দেয় না। তাড়াতাড়ি ঠোঁট চালায়। একটু বড় কেউ এলে আবার থমকে দাঁড়ায়। নড়াচড়া দেখলে উড়ে গিয়ে গ্রিলে বসে। দুই তারের মাঝখানের জায়গাটায় কেউ কেউ লুকায়। কাপড়ের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। ফাঁকা জায়গাটা সরু তবে এদের মাথার চেয়ে অনেক উঁচু। লুকালে সহজে চোখে পড়ে না। কাপড় পেঁছিয়ে দাঁড়ালে একেবারে বোঝা যায় না। নীরা দুই কম্বলের মাঝে এমন করে লুকায় কেউ আর টের পায় না। কম্বল দুটি নিচ বরাবর ঝুলে থাকায় তার পা আর চোখে পড়ে না। বড় কম্পলটা এপাশটাকেও আড়াল করে দিয়েছে। দুই তারের ফাঁকে আর কিছু দেখা যায় না। সে এমন করে দাঁড়িয়ে থাকে কোন নড়াচড়া করে না। বড় করে নিঃশ্বাসও ফেলে না। তারা কম্বলের আশে পাশে কয়েকবার ঘুরে দেখে। কিন্তু কিছু দেখতে পায় না। পুরু কম্বল দুটির ফাঁকা জায়গাটায় সে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকে। শীতকালেও তার গরম লাগে। সে চুপ করে থাকে। তারা খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে যায়। তাদের শীত ছুটে যায়। তারা এবার তাকে বেরিয়ে আসতে বলে। শব্দ করতে বলে। সে আর দেরি না করে তাদের চোখের সামনে কম্বল থেকে বেরিয়ে আসে। তারা সবাই অবাক নয়নে তার দিকে তাকায়। এ সময় কবুতরগুলো শব্দ করে ডেকে ওঠে। তখন তারাও ‘পেয়েছি পেয়েছি’ শব্দ করে একসাথে আনন্দে নাঁচতে শুরু করে।