কাজটা করতে স্বেচ্ছায় রাজি হয়েছে সিদ্দিক। সোলাইমান বলেছিল, কাজ শেষে নগদ আট হাজার টাকা দেবে। কিন্তু সিদ্দিক আসলে কোনো প্রলোভনে টলেনি, ওকে জোর-জবরদস্তিও করেনি কেউ। তবু কী যেন কী হচ্ছে। ওর বুকের ঠিক মাঝখানে কিছুুর বিস্ফূরণ ঘটেছে যেন, ছেঁড়া-ফাঁড়া খাঁ খাঁ করা অদ্ভূত একটা অনুভূতি হৃদপিণ্ডে চেপে বসছে ক্রমশ।
অশ্বত্থ গাছের গায়ে শরীর লেপ্টে দাঁড়িয়ে আছে সিদ্দিক। এক দুপা এগোলেই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য। কিন্তু কী করে এই দূরত্বটুকু অতিক্রম করবে কিছুতেই মাথায় আসছে না। বেশি ভাবলেই বুকে চাপ বাড়ছে, শ্বাস ভারি হয়ে আসছে। ভাবতে ভাবতে তবু অন্যমনস্ক হয়ে ওঠে সিদ্দিক আর তখনই পিঁপড়ার দল সুযোগটা নেয়।
পিঁপড়ের সারি দেখলেই সিদ্দিকের শরীর রি রি করে ওঠে। তার ওপরে এ হলো লাল পিঁপড়ের সারি। একটু ছোঁয়া লাগলেই তোলপাড় শুরু করে দেয়। এখন যেমন সিদ্দিকের পায়ের সঙ্গে টোকা লাগতেই একসঙ্গে ছয় সাতটা পিঁপড়া ওর বৃদ্ধাঙ্গুলি খামচে ধরেছে। জায়গামতো হাত পৌঁছানোর আগেই চামড়ার অভ্যন্তরে বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছে।
কথা শুনছে না অভিযোগ তুলে চাচা যেমন ওকে ছেঁচড়ে টেনে দেয়ালের সঙ্গে ঠেসে ধরে তেমনি করে দলের শেষের দিকের পিঁপড়া কয়টিকে গাছের গায়ে চেপে ধরে সিদ্দিক। অতটুকু প্রাণীদের আটকে রাখার জন্য এতটা শক্তির প্রয়োজন নেই জেনেও বৃথা শক্তিক্ষয় করে। পিঁপড়েরাও কম যায় না, স্যান্ডেলের তলা গলে বেরিয়ে আক্রমণকারীর পায়ের পাতায় উঠে পড়ে আলতো করে কামড়ে ধরে। বিষে নয়, অপমানে কপালের রগ চিড়িক করে ওঠে সিদ্দিকের। চাচার মতো উন্মত্ত হয়ে ওঠে ও। তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুলির চাপে ওদেরকে পিষে মারতে শুরু করে। মৃত পিঁপড়েদের আঙুল থেকে ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে সিদ্দিকের মনে পড়ে ওর কানের লতিকে এভাবেই আঙুলে পিষে চাচা। সিদ্দিক কিছুতেই স্বস্তি পায় না, ঘুরেফিরে চাচাকে মনে পড়ে বলে মাকেও মনে পড়ে।
যে কয়টা দিন সঙ্গে ছিল ওকে গাল না দিয়ে একবেলাও মুখে ভাত তোলেনি মা। শেষটায় তো এমন হলো যে হাতের কাছে হাতপাখা বা ডাল ঘুটনি যা পেতো তাই দিয়েই সিদ্দিককে মারতো সিদ্দিকের মা ফরিদা।
একদিন সকালে ঘুম ভেঙে উঠে সিদ্দিক দেখে, মা নেই।
মা পালিয়েছিল। ওদের দু’ঘর পরের বাসিন্দা নন্দলালও পালিয়েছিল। তেরো বছরের সিদ্দিক তখন ঘুমিয়ে ছিল। প্রতিদিন সকালে মায়ের অশ্রাব্য খিস্তিতে সকাল শুরু হলেও সেদিনের সকাল ছিল নিরবচ্ছিন্ন নীরবতার। ঘরজুড়ে থাকা অবিশ্বাস্য নীরবতায় সিদ্দিকের ঘুম গভীর হতে হতে একেবারে অতলে ডুবিয়ে দিয়েছিল ওকে। ঘুম আর ঘরের সুমসাম নৈঃশব্দ্য ভেঙেছিল চাচার ডাকচিৎকারে। খবরটা শুনে বাড়ির সকলের মতো আহাম্মক বনে গেলেও নিত্য গালিগালাজ শুনতে হবে না, মারও খেতে হবে না ভেবে স্বস্তি পাচ্ছিল সিদ্দিক। সেই অনুভূতির ক্ষণ স্থায়ী হয়নি। আধঘন্টার মধ্যেই মায়ের না থাকা সুদে-আসলে পুষিয়ে দিয়েছিল চাচা।
মা যাওয়ার আগে নাকি চাচা-চাচীর কাঠের বাকশের ভেতরের সোনাদানা, টাকা-পয়সা লুট করে নিয়ে গেছে। ক্ষতিপূরণস্বরূপ সিদ্দিকের কাছ থেকে ফাঁকা স্ট্যাম্প পেপারে টিপসই নিয়ে রেখেছে চাচা। এর আগে মায়ের কাছ থেকেও চাচা এমন সই-স্বাক্ষর নেওয়ার চেষ্টা করেছিল, মা কিছুতেই রাজি হয়নি।
বাবা গাড়ি চাপা পড়ে মরে যাওয়ার পরেও এই বাড়ি ছাড়েনি সিদ্দিকের মা, একবার বাড়ি ছাড়লে এই বাড়িঘরে আর পা রাখতে পারবে না মা তা জানতো। মৃত স্বামীর ভাগের স্থাবর সম্পত্তি দখলে রাখার জন্য মা এই বাড়ির মাটি পিঁপড়ার মতোই কামড়ে ধরে ছিল। শেষ পর্যন্ত পারেনি। চাচী বলে, শরীরের গরমে পারেনি।
সিদ্দিকও খেয়াল করেছে, মায়ের শরীরে গরম বেশি। বারোয়ারি কলপাড়ে ফরিদা গোসলে গেলে সহজে ফিরতো না। রাতে শাড়ি খুলে ব্লাউজ পেটিকোট আলগা করে প্রায় উদোম হয়ে ঘুমাতো। চাচী দিনে অন্তত একশ বার সেসব করা মনে করাতো।
এইসব যন্ত্রণাময় স্মৃতি আজও সিদ্দিকের শরীরে বিষ পিঁপড়ার হুল ফোটায়।
মা চলে গেছে। মা এখন হিন্দু না মুসলমান সিদ্দিক জানে না। এ পাড়ার কেউই জানে না। সকলে তাই কথা বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে ওর কাছেই সব জানতে চায়।
সিদ্দিক আবার মন্দিরের পেছনের প্রাচীর ঘেঁষা অশ্বত্থের আড়ালে চলে যায়। দূর থেকে কেউ দেখলে ঠিক বুঝে নেবে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে ঘাপটি মেরে আছে ও। অবশ্য এদিকে এখন নজর নেই কারও। চারদিকে উটকো লোকের ভিড়। ঐ ভিড়ে সোলাইমানও মিশে আছে। সিদ্দিক কাজটা করতে না পারলে ও করবে। উরুসন্ধির ফাঁকে লুকিয়ে রাখা জিনিসটা সময়মতো বের করে ভিড়ের মধ্যে ফেলে দেওয়াই ওর কাজ।
ভিড় বাড়ছে। কেউ কাউকে দেখেও দেখছে না। উৎসব জমে উঠেছে। বর্ণাঢ্য সাজে সেজে উঠেছে মন্দির। মরিচবাতির ঝলকানি দেখা যাবে দিনের আলো কমে এলেই। একটু পর গাড়ি ভরে পুলিশও আসবে। পূজা মণ্ডপ পাহারা দেবে। সারাদিন দুএকজন এখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। এখন নেই, বিড়ি ফুঁকতে গেছে বোধহয়।
সিদ্দিক একটা বিড়ি ধরায়। চারপাশের কোলাহল ছাপিয়ে ঠিক তখনই ওর কাছাকাছি একটা গাড়ি থামে। দেখতে দেখতে কালো রঙের সরকারি পোশাক পরা বাহিনি মন্ডপের চারধার মালার মতো ঘিরে ফেলে। চারপাশের কোলাহলও স্তিমিত হয়ে আসে। ভিড়ে উদ্বেলিত মানুষগুলো একে-অন্যের দিকে সতর্ক চোখে তাকায়।
‘আইজ আর হইব না’ পেছন থেকে ভেসে আসা সোলাইমানের খরখরে কণ্ঠস্বরে সিদ্দিকের শরীরে উত্তেজনার একটা তরঙ্গ পাক খেতে খেতে দ্রুত মন্দীভূত হয়ে আসে। স্খলিত পায়ে ও পুনরায় মন্দিরের পেছনের অশ্বথ গাছের কাছে চলে যায়। তারপর গাছের গোড়ায় দলবদ্ধ লাল পিঁপড়েদের পায়ের নিচে পিষে মারতে মারতে প্রবল রোষে বলে, ‘মর শালার হিন্দু পিঁপড়া।’