লালখানবাজারের নাম শহীদনগর করার উদ্যোগকে জানাই স্বাগত

আ.ফ.ম. মোদাচ্ছের আলী | রবিবার , ২ জানুয়ারি, ২০২২ at ১০:৪০ পূর্বাহ্ণ

পঁচিশ মার্চ বিকেল থেকেই সারা শহরে এমন যেন থমথমে ভাব বিরাজ করছিল। শহরে নানারকম গুজব ছড়িয়ে পড়ছিল। অনেকে বলছিলেন মুজিব ইয়াহিয়া বৈঠক ব্যর্থ হয়েছে। আবার গুজব রটছিল, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া মুজিবের সব দাবী মেনে নিয়েছেন-অল্প সময়ের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। উত্তেজিত শঙ্কিত ও অসহযোগ আন্দোলনরত সংগ্রামী জনতা উদ্ভূত যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত ছিল।
রাত সাড়ে আটটার দিকে চট্টগ্রামের সেক্টর এডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন রফিক তার বাসা থেকে ‘এম্বারকেশন’ হেডকোয়ার্টারে কর্মরত ক্যাপ্টেন মুসলিমের সঙ্গে আলাপ আলোচনা শেষে রাতের খাবার খেতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ডা. জাফর একজন কর্মীকে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ক্যাপ্টেন রফিকের বাসায় এসে বললেন, ‘ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা বেরিয়ে পড়েছে। এই বিষয়কে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ কর্মীদের রুদ্ধদ্বার বৈঠক চলছে’। ক্যাপ্টেন রফিক কয়েক সেকেন্ড ভাবলেন- তারপরেই বললেন, ‘আমি আমার ট্রুপস নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো ষোলশহর এবং সেনানিবাসে গিয়ে সমস্ত বাঙালি সৈনিকদের আমার সঙ্গে যোগ দিতে বলুন।
ক্যাপ্টেন রফিক এর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ক্যাপ্টেন মুসলিম তার সাক্ষাৎকারে বলেছেন ‘রফিকের কিছু কোর্ড ওয়ার্ড ছিল যা ২৪ মার্চ আমাকে বলেছিল। একটি কোর্ড ওয়ার্ড ছিল ‘Bring some wood for me’ অর্থ ছিল পাকিস্তানিদের বন্দি কর এবং অস্ত্র গোলাবারুদ সহ চট্টগ্রামের শহর রণাঙ্গনে যোগ দাও। পঁচিশে মার্চ সম্ভবত ক্যাপ্টেন রফিক চেয়েছিলেন বিনারক্তপাতে নিঃশব্দে পাকিস্তানিদের বন্দি করতে। তাই প্রথম টার্গেট হিসেবে ক্যাপ্টেন হায়াতকে বেছে নেন। ক্যাপ্টেন রফিকের ডাকে হায়াত উঠে দু এক কথা বলতেই ক্যাপ্টেন রফিক তার স্টেনগান দিয়ে ক্যাপ্টেন হায়াতকে আঘাত করেন। ক্যাপ্টেন হায়াত তার জামার পকেট থেকে পিস্তল বের করবার চেষ্টা করলে রফিকের দেহরক্ষী তার রাইফেল দিয়ে ক্যাপ্টেন হায়াতকে পুনরায় জোরে আঘাত করেন। তিনি মেঝেতে পড়ে যান এবং বন্দি হন। স্বাধীনতার প্রথম প্রহরে জ্বলে ওঠা চট্টগ্রাম নিয়ে ‘প্রতিরোধের প্রথম প্রহর’ মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসির লেখা গ্রন্থ থেকে এই ইতিহাস নেয়া।
‘বেলাল সাহেব আপনারা দেরি করছেন কেন? যা পারেন প্রচার শুরু করে দিন। এখন সাড়ে সাতটা। লোকেরা রেডিওর কাঁটা ঘোরাচ্ছে। পৌনে আটটা বাজলেই আকাশ বাণী ধরবে আপনাদেরটা কেউ শুনবে না। বলেছিলেন বার্তা সম্পাদক সুলতান আলী। তিনি দু একটি সংবাদ তথ্য ও বলে দিয়েছিলেন। ঠিক সন্ধ্যা ৭ টা ৪০ মিনিটে প্রচারিত হয়েছিল ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ থেকে বলছি।
চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ এর সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান। তাঁকে আমি চিনতামনা। ২৬ মার্চ দুপুরে তিনি আঞ্চলিক প্রকৌশলী মির্জা নাসিরউদ্দিন এবং বেতার প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান, দেলোয়ার হোসেন ও মোছলেম খানের প্রকৌশলিক সহায়তা আদায় করেছিলেন। পাঁচ মিনিট স্থায়ী একটি বিক্ষিপ্ত অধিবেশন। ওতে তিনি নিজের নাম পরিচয়সহ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করেছিলেন’। বেলাল মোহাম্মদ লিখিত ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ গ্রন্থ থেকে ২৫ মার্চ একাত্তরে সিভিলিয়ান ও রাজনৈতিক নেতাদের কার্যক্রম এইভাবেই উঠে এসেছে। প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল দামপাড়া পুলিশ লাইনের বীর বাঙালি পুলিশরা, যে ঘটনা নিয়ে নির্মিত হচ্ছে চলচ্চিত্র।
এই ইতিহাস পাঠকের হয়তো জানা আছে। কিন্ত তুলে ধরলাম অতি সমপ্রতি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এর একটি প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে যা গণমাধ্যমে এসেছে।
নগরের লালখানবাজারের নাম শহীদনগর করার উদ্যোগ নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এর মেয়র। লালখানবাজার ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল হাসনাত বেলাল লালখানবাজারের নাম শহীদনগর করার প্রস্তাব করেন। এসময় ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ এ দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত ‘লালখানবাজার কেন শহীদনগর হলোনা’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে বলেন, চট্টগ্রাম শহরে একাত্তরে সবচে বেশি হত্যাযজ্ঞ চলে এই লালখানবাজারে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধে লালখানবাজারের জনসাধারণের ঐতিহাসিক ভূমিকা ও আত্মত্যাগকে মহিমান্বিত করতে এলাকার নাম শহীদ নগর করা এবং শুধু মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক মঞ্চায়নের অঙ্গীকার নিয়ে ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘শহীদনগর থিয়েটার’। গণস্বাক্ষর, মতবিনিময়সহ বিভিন্ন কার্যক্রম তারা করেছিল যার ধারাবাহিকতায় বর্তমান কাউন্সিলর একটি সময়োপযোগী প্রস্তাব দিয়েছেন যার জন্য তাকে সাধুবাদ জানাই।
শুরুতেই আমি মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহর থেকেই প্রতিরোধ এবং সমপ্রচারে গর্জে ওঠা বীর চট্টগ্রাম এর কিছু ইতিহাস তুলে ধরেছি। বেশ কবছর পূর্বে দৈনিক আজাদী চট্টগ্রাম শহরে মুক্তিযোদ্ধাদের নামে সড়কের নামকরণ নিয়ে আমার একটি লেখা ছেপেছিল। কিন্ত হা হতোস্মি। আলো ঝলমল স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করলেও চট্টগ্রামে ঢাকার মতো মুক্তিযোদ্ধাদের নামে সড়কের নামকরণ করা হয়নি। বরঞ্চ ছোটবেলায় যে শহীদ সাইফুদ্দীন খালেদ সড়ক আমরা দেখেছিলাম কাল পরিক্রমায় সেটি এস এস খালেদ সড়কে পরিণত হয়েছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। এ নিয়ে বিভিন্ন সভা সেমিনারে বার বার বলা সত্ত্বেও কোনো কাজ হয়নি। শহীদ সাইফুদ্দীন খালেদ পরিণত হয়েছেন ‘এস এস খালেদ’। এবার মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। পাকিস্তান আমলের জিন্নাহ এভিনিউ মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু এভিনিউ’। আর চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের কায়েদে আজম সড়ক হয়েছে ‘শেখ মুজিব’ সড়ক। পঞ্চাশ বছরেও এটি বঙ্গবন্ধু সড়ক হলোনা! চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এর মেয়র একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাই মুক্তিযুদ্ধের যেকোনো বিষয় নিয়ে তিনি অগ্রণী ভূমিকা রাখবেন এটি জনপ্রত্যাশা। চট্টগ্রাম এর সড়কগুলোর নাম ঢাকার মতো বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নামকরণ এখন সময়ের দাবি। এই শহরের বীরেরা অনেকেই লোকান্তরিত হয়েছেন।এই শহরে গুড সাহেব রোড, উর্দু লেইন, পান ওয়ালা পাড়া, মিস্ত্রী পাড়া, বাদুরতলা, ওয়াসা মোড়, কাটা পাহাড় (কুখ্যাত ডালিম হোটেল সংলগ্ন)সহ অসংখ্য ব্রিটিশ আমলের দেয়া নামের সড়ক রয়েছে যার নাম পরিবর্তন জরুরি। সি আর দত্ত বীর উওমরা নিজের বীরত্বের জন্য সড়কের ইতিহাসে লিপিবদ্ধ নাম দেখে পরলোকে যেতে পেরেছেন। কিন্ত স্বাধীনতার প্রথম প্রহরে জ্বলে উঠে মার্চ মাস দখলদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত রেখে ইথারে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার বীর চট্টগ্রামের বীর রইসুল হক বাহারসহ অনেকে আজ লোকান্তরিত।
মুক্তিযোদ্ধা মেয়র পাওয়া সৌভাগ্যের। তাই চট্টগ্রাম এর বীর মুক্তিযোদ্ধা মেয়রের কাছে প্রত্যাশা থাকবে ‘শহীদনগর’ দিয়েই আপনি শুরু করুন চট্টগ্রামের সড়কগুলোতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামকরণ। চট্টগ্রামের সকল মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয় করে এই বিষয় নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে দিতে পারেন। নতুন বছর শুরু হোক এই মহান কাজ দিয়ে। তথাকথিত বিপ্লব উদ্যান এর নাম পরিবর্তন করে ‘জয় বাংলা’ উদ্যান করুন। ইতিহাস বলবে ‘মুক্তির মন্দিরে কত প্রাণ হলো বলিদান
লেখা আছে অশ্রুজলে’।
লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতারুণ্য হোক প্রাণচঞ্চলতাময়
পরবর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে