গত মৌসুমে দাম ভাল পাওয়ায় এবার লবণ উৎপাদনে দ্বিগুণ উৎসাহে মাঠে নেমেছেন চাষিরা। দেশের একমাত্র লবণ উৎপাদনকারী অঞ্চল কক্সবাজারের ৭টি এবং চট্টগ্রামের দুই উপজেলায় আধুনিক পদ্ধতিতে আগাম উৎপাদিত কয়েক লাখ মেট্রিক টন লবণ ইতোমধ্যে গুদামেও মজুদ করছেন তারা।
লবণ চাষিরা জানিয়েছেন, লবণ চাষে লাভ ভালো হওয়ায় শুষ্ক মৌসুম শুরুর পর থেকে দিন যতই গড়িয়েছে, উৎপাদনের পরিধিও বাড়তে শুরু করেছে। এখনো বেশকিছু লবণ মাঠ প্রস্তুত করতেও দেখা যায় মাঠের চাষিদের। সবমিলিয়ে মাঠে মাঠে লবণ উৎপাদনে চাষি ও শ্রমিকদের তোড়জোড় দেখা গেছে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিসিক) কক্সবাজার আঞ্চলিক কেন্দ্র জানায়, চলতি লবণ উৎপাদন মৌসুমে (২০২৩–২৪) দেশে ভোক্তা ও শিল্প খাতে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন। সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং দেশে লবণ উৎপাদনের সক্ষমতা দেখাতে বর্তমানে কক্সবাজারের সাত উপজেলা তথা চকরিয়া, পেকুয়া, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, কক্সবাজার সদর, ঈদগাঁও, উখিয়া, টেকনাফ এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও আনোয়ারা উপজেলার প্রায় ৪০ হাজার প্রান্তিক চাষি মাঠে তৎপর রয়েছেন।
বিসিক আরও জানায়, গত কয়েক মৌসুমে লবণ উৎপাদনের বিপরীতে দাম ভাল পাওয়ায় এবারও আগাম মাঠে নামেন চাষিরা। বিগত অর্থবছরের মতোই লাভের মুখ দেখতে ব্যাপক উৎসাহ–উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে এবারও কক্সবাজার এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলের ৬৬ হাজার ৪২৪ একর জমিতে লবণ উৎপাদন শুরু করেছেন চাষিরা।
বিসিকের লবণ শিল্পের উন্নয়ন কার্যালয় কক্সবাজারের পরিদর্শক (উন্নয়ন) মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী বলেন, গেল নভেম্বর মাসের পর পরই লবণ উৎপাদনে মাঠে নামতে শুরু করে প্রান্তিক চাষিরা। কারণ গেল মৌসুমে উৎপাদিত লবণের ন্যায্যমূল্য পেয়ে বেশ খুশি ছিল প্রান্তিক চাষি। তাই এবার প্রান্তিক চাষিরা দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে মাঠে নেমেছে। চলতি মৌসুমে উৎপাদিত একমণ লবণের বিপরীতে গড়মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৫২৬ টাকা। এতে চাষিরা বেশ খুশি।
বাংলাদেশ লবণ চাষি ও ব্যবসায়ী সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি মকছুদ আহমদ কোম্পানি, সদস্য আবু তৈয়ব, মৌলভী শহিদুল ইসলাম, শোয়াইবুল ইসলাম সবুজ, হারুনুর রশিদ দৈনিক আজাদীকে জানিয়েছেন, প্রতিবছরই সরকারের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে লবণ উৎপাদন করে থাকেন এখানকার চাষিরা। কিন্তু দেশের মধ্যস্বত্ত্বভোগী প্রভাবশালী মিল মালিকেরা সিন্ডিকেট করে এবং মন্ত্রণালয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিদেশ থেকে লবণ আমদানির পায়তারা শুরু করে। যাতে করে দেশে উৎপাদিত লবণের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে চাষিদের বঞ্চিত করা হয়।
তারা বলেন, সরকার চলতি মৌসুমে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ২৫ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদনের। যা গত মৌসুমের চেয়ে এক লাখ ৪৩ হাজার মেট্রিক টন বেশি। উৎপাদনের বাড়তি লক্ষ্যমাত্রা কেন করা হয়েছে– এমন প্রশ্ন রেখে নেতৃবৃন্দ বলেন, একবছরের ব্যবধানে এক লাখ ৪৩ হাজার মেট্রিক টন বাড়তি লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার পেছনে প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের হাত রয়েছে।
তারা বলেন, মূলত মধ্যস্বত্ত্বভোগী প্রভাবশালী মিল মালিক সিন্ডিকেট যাতে বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করতে পারে সেজন্য এবার লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এমন কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি যে, একবছরের ব্যবধানে এত বিপুল পরিমাণ লবণের চাহিদা বেড়ে যেতে পারে। তাই এই বিষয়টি সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের খতিয়ে দেখতে হবে। যদি মৌসুমে লবণ আমদানি করা হয় তাহলে দেশে উৎপাদিত লবণের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবেন, এমন আশঙ্কাও চাষিদের মাঝে রয়েছে।
কয়েক বছরের মতো এবার লবণচাষের পরিধি বেড়েছে জানিয়ে বিসিক কঙবাজারের লবণশিল্প উন্নয়ন প্রকল্পের উপমহাব্যবস্থাপক মো. জাফর ইকবাল ভূঁইয়া জানান, বিদেশ থেকে আমদানি না হওয়ায় দেশীয় চাষিরা উৎপাদনের বিপরীতে ন্যায্যমূল্য পেয়ে আসছে দুইবছর ধরে। এতে প্রান্তিক চাষিরা বেশ উৎসাহ নিয়ে এবারও লবণ উৎপাদনে নামে মৌসুম শুরুর অন্তত ১৫ দিন আগে। তিন হাজার একর বাড়তি জমিতে পরিধি বেড়েছে লবণ চাষের। তাই লক্ষ্যমাত্রা বেশি নির্ধারণ হলেও বিদেশ থেকে লবণ আমদানির সুযোগ থাকবে না। সরকার এই বিষয়ে সবকিছুই ওয়াকিবহাল রয়েছে।
বিসিকের এই কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে শতভাগ জমিতে আধুনিক পদ্ধতি (পলিথিন পদ্ধতি) অনুসরণ করে লবণ উৎপাদন হচ্ছে। সনাতন পদ্ধতির চেয়ে পলিথিন পদ্ধতিতে উৎপাদন আড়াইগুণ বৃদ্ধি পায়। এমনকি সনাতনের চেয়ে পলিথিন পদ্ধতির উৎপাদিত লবণের গুণগত মানও বেশ ভাল। তাই দামও ভাল পেয়ে থাকেন চাষিরা। এবারও সেই পদ্ধতি অনুসরণ করেই লবণ উৎপাদন করছেন চাষিরা।
চকরিয়ার পশ্চিম বড় ভেওলা ইউনিয়নের লবণ চাষি মাতামুহুরী সাংগঠনিক উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাবলা দৈনিক আজাদীকে জানান, গতবছরের মতো এবারও ভাল দাম পাওয়ার আশায় লবণ উৎপাদনে আগেভাগে মাঠে নামেন চাষিরা। ইতোমধ্যে অনেক চাষি কয়েকদফায় উৎপাদিত লবণ গুদামে মজুদ করেছেন। আবহাওয়া যদি অনুকূলে থাকে তাহলে সরকার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেই দেখিয়ে দেবে দেশীয় লবণশিল্প স্বয়ংসম্পূর্ণ।