সাপ্তাহিক ‘লাঙ্গল’ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত একটি বিখ্যাত পত্রিকা। সম্পাদক হিসেবে মণিভূষণ মুখোপাধ্যায় নাম থাকলেও, সব কাজ করতে হতো নজরুলকেই। সাপ্তাহিক লাঙ্গল পত্রিকা ছিল নজরুলের রাজনৈতিক চেতনার ধারক ও বাহক। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২৬ সালের ১৫ই এপ্রিল। পরবর্তীকালে এটি মুজফ্ফর আহমদের সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘গণবাণী’র সাথে একীভূত হয়ে যায়। লাঙ্গল ছিল মেহনতি মানুষের সংগঠন ‘কৃষক–প্রজা–স্বরাজ সম্প্রদায়’ এর মুখপত্র বিশেষ। এই পত্রিকায় নজরুলের রাজনৈতিক দর্শন সাম্যবাদের প্রকাশ ঘটেছে। পত্রিকাটির প্রত্যেক সংখ্যার শুরুতে থাকতো চণ্ডীদাসের অমর বাণী, ‘শুনহ মানুষ ভাই/ সবার উপরে মানুষ সত্য/ তাহার উপরে নাই।’ ২৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত প্রথম সংখ্যাতেই ‘সাম্যবাদী’ শিরোনামে এগারোটি কবিতা ছাপা হয়। প্রথম সংখ্যা হিসেবে এটি বিশেষ আকর্ষণীয় করে প্রকাশ করা হয়েছিল। ছাপা হয়েছিল প্রায় পাঁচ হাজার কপি এবং মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সব কপি বিক্রি হয়ে যায়। পত্রিকাটির প্রচ্ছদে আঁকা থাকতো লাঙ্গল কাঁধে এক কৃষকের ছবি। সম্পাদক হিসেবে নজরুলের পরিবর্তে ছাপা হতো কবির ফৌজি বন্ধু মণিভূষণ মুখ্যোপাধ্যায়ের নাম। নজরুলের নাম ছাপা হতো মুখ্য পরিচালক হিসেবে। কৃষক–প্রজা–স্বরাজ–সম্প্রদায়ের আহ্বায়ক হিসেবে প্রথম সংখ্যাতেই নজরুল সংগঠনের একটি ঘোষণাপত্র প্রকাশ করেন। ‘সাম্যবাদী’ কবিতাগুলোতে কুলি, মজুর, নারী, কৃষক–এমন জনগোষ্ঠীর শোষণ ও বঞ্চনার চিত্র ফুলে ওঠে। লাঙ্গলের অন্যান্য সংখ্যাগুলোতেও মুখ্য ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সাম্যবাদ। নৃপেন্দ্র কিশোর চট্টোপাধ্যায় অনূদিত ম্যাঙ্মি গোর্কির ‘মা’ এই পত্রিকাতেই ধারাবাহিকভাবে ছাপা শুরু হয়েছিল। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মুজফ্ফর আহমেদ প্রমুখ এই পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। কার্ল মার্কস, লেনিন, তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনীতির বিষয়াদি ছিল পত্রিকাটিতে প্রকাশিত বিভিন্ন রচনার মুখ্য বিষয়। সেই সাথে প্রতি সংখ্যায়ই বিশেষ আকর্ষণ ছিল নজরুলের কবিতা। ‘কৃষাণের গান’, ‘সব্যসাচী’, ‘সর্বহারা’র মতো বিখ্যাত কবিতা এই পত্রিকাতেই প্রথম ছাপা হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন লিখেন, ‘লাঙ্গল পরিচালনাকালে হুগলি থেকে কলকাতায় এসে অফিস করার দুর্ভোগ পোহানো ছাড়া নজরুলের বিশেষ কোনো আর্থিক লাভ হয়নি। বরং একটিা আদর্শগত অনুভূতি তাড়নায় নিদারুণ অর্থকষ্টের মধ্যে থেকেও তিনি ‘লাঙ্গল’ পরিচালনা করতেন। অনেক সময় ‘লাঙ্গল’ অফিসে যাতায়াতের খরচও তাঁর কাছে থাকতো না।’ ১৯২৬ সালের ১৫ এপ্রিলে শেষ সংখ্যা প্রকাশের মাধ্যমে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। ‘লাঙ্গল’র মোট ১৫টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। কবি নজরুল ও সংগীতকার নজরুলের পাশাপাশি বাংলা সাংবাদিকতাতেও নজরুল ছিলেন অনন্য। ১৯২৫ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর (১লা পৌষ ১৩৩২) কলকাতার শিয়ালদার কাছে ৩৭ নম্বর হ্যারিসন রোডের (পরবর্তীকালে মহাত্মাগান্ধী রোড) ঠিকানা থেকে ‘লাঙ্গল’ এর আত্মপ্রকাশ।
নজরুলের সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি ১৯২০ সালে। তৎকালীন খিলাফত নেতা এ কে ফজলুল হকের মালিকানায় ১৯২০ সালের ১২ ই জুলাই কলকাতা থেকে সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগ’ প্রকাশিত হয় এবং সেই সংবাদপত্রের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন মুজফ্্ফর আহমদ এবং নজরুল ইসলাম। নবযুগ পত্রিকায় শুধু নজরুল নয়, মুজফ্ফর আহমদেরও সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি। ‘নবযুগ’ই প্রথম বাংলা সংবাদপত্র যেখানে শ্রমিকও কৃষকদের সমস্যা অগ্রাধিকারভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। ‘নবযুগ’ প্রকৃতই বাংলাভাষায় নবযুগের বার্তাবহ হয়ে উঠতে শুরু করে। ফলে অবশ্যম্ভাবীভাবে ব্রিটিশ সরকার পত্রিকাটির জামানত বাজেয়াপ্ত করে। কাগজের কর্ণধার হক সাহেবের সঙ্গে মতপার্থক্যের জেরে ১৯২০ সালের শেষ নাগাদ নজরুল এবং মুজফফর আহমদ দু’জনেই ‘নবযুগ’ ছেড়ে দেন। ‘নবযুগ’তারপর বন্ধ হয়ে যায়। অবশ্য প্রায় দু’দশক পর ১৯৪১ সালে সম্ভবত অক্টোবরের দ্বিতীয়ার্ধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফজলুল হক নতুন করে প্রকাশ করেন প্রভাতী দৈনিক ‘নবযুগ’। প্রধান সম্পাদক নজরুল ইসলাম।
‘লাঙ্গল’ ছিল ‘ধূমকেতু’র পর নজরুলের সাংবাদিকতা জীবনের দিকচিহ্ন। পত্রিকাটির গায়ে লেখা থাকতো– ‘প্রধান পরিচালক নজরুল ইসলাম’। প্রথম সংখ্যার প্রধান আকর্ষণ ছিল নজরুলের সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো। প্রথম পৃষ্ঠার মাঝখানে বড় করে লেখা ছিল– ‘এই সংখ্যার লাঙ্গলের সর্ব্ব প্রধান সম্পদ কবি নজরুল ইসলামের কবিতা সাম্যবাদী’। ১৬ পৃষ্ঠার পত্রিকায় ৮ পৃষ্ঠাজুড়ে ছিল নজরুলের সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থের সবগুলো কবিতা। এর কারণে পত্রিকার ৫ হাজার কপি দ্রুত শেষ হয়ে যায়। দ্বিতীয় সংখ্যায় লেখা হয়; ‘গতবার আমরা ৫ হাজার ‘লাঙ্গল’ ছেপেছিলাম– কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সমস্ত কাগজ ফুরিয়ে যাওয়াতে কলিকাতায় অনেকে কাগজ পাননি এবং মফস্বলে একবারেই কাগজ পাঠানো হয়নি। ঐ সংখ্যার প্রধান সম্পদ কবি নজরুলের ‘সাম্যবাদী’ গ্রাহকগণের আগ্রহাতিশয্যে পুস্তিকাকারে বের করা হলে, দাম করা হয়েছে মাত্র দু’আনা।’ প্রতিটি সংখ্যার শেষ পৃষ্ঠায় নজরুলের বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থের বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছে। পত্রিকা চলাকালীন নজরুলের যে কাব্যগন্থগুলো প্রকাশিত হয়েছে সবগুলোর আগাম খবর ছাপা হতো। ষোলো পাতার ‘লাঙ্গল’ ছাপা হতো কলকাতায় ১৫ নং নয়ান চাঁদ দত্ত স্ট্রিটের মেটকাফ প্রেস থেকে। ‘লাঙ্গল’ প্রকাশিত হয় ষোলটি সংখ্যা। ১৯২৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯২৬ সারের ১৫ই এপ্রিল। ‘লাঙ্গল’ বন্ধ হয়ে যায় মূলত আর্থিক সমস্যার কারণে। তার সঙ্গে ছিল কলকাতায় হিন্দু–মুসলিম দাঙ্গা। ১৯২৬ সালের কলকাতায় হিন্দু–মুসলিম দাঙ্গা চলেছিল ২ রা এপ্রিল থেকে ৯ মে। মাঝে ১৩ এপ্রিল থেকে ২১ এপ্রিল। দাঙ্গায় ১১০ জন নিহত হন; আহতের সংখ্যা ৯৭৫। দাঙ্গা তারপরও থেমে যায়নি। বছর জুড়েই কমবেশি চলে দেশের নানা এলাকায়। দাঙ্গার কারণে ‘লাঙ্গল’র মতো একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ সংবাদপত্রের পক্ষে টিকে থাকা শক্ত হয়ে ওঠে। দাঙ্গা প্রকোপ কলকাতায় একটু কমার পর বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দল নতুন একটি মুখপত্র প্রকাশের উদ্যোগে নেন। ১৯২৬ সালের ১২ আগস্ট প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ‘গণ–বাণী’। ‘গণ–বাণী’র ডিক্লারেশন নেয়া হয় মুজফ্ফর আহমদের নামে। নজরুল ইসলামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখা ‘গণ–বাণী’তে প্রকাশিত হয়। ১৯২৬–র ২৬ আগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিত হয় নজরুলের বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘মন্দির ও মসজিদ’। ২ রা সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত হয় নজরুলের প্রবন্ধ ‘হিন্দু–মুসলমান’। ‘গণ–বাণী’ শেষ পর্যন্ত প্রকাশিত হয় যতদূর সম্ভব ১৯২৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত। নজরুল তার স্বভাবোচিত স্বাধীনতা নিয়ে সংবাদপত্র সম্পাদনা ও পরিচালনায় যুক্ত থাকতে পেরেছিলেন সাপ্তাহিক ‘লাঙ্গল’ পত্রিকাতেই। ‘লাঙ্গল’ই বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম সংবাদপত্র যা সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্রবাদ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা বাংলাভাষী পাঠকের কাছে তুলে ধরে। ‘লাঙ্গল’ পত্রিকাই প্রথম বাংলা কৃষক সমাজের সংঘটিত রাজনৈতিক ভূমিকার ওপর স্পষ্টভাবে আলোকপাত করে। ‘লাঙ্গল’র মাধ্যমেই শ্রমজীবী মানুষের রাজনৈতিক ভূমিকা বাংলা সাংবাদিকতায় উচ্চারিত হয়। বাংলা সাংবাদিকতায় ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে আপসহীন দৃঢ়তার সঙ্গে তুলে ধরার জন্যও ‘লাঙ্গল’ এবং ‘গণ–বাণী’র নাম স্মরণীয়।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সম্পাদক–শিল্পশৈলী।