মাথায় গুলিবিদ্ধ হওয়া ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরীফ ওসমান বিন হাদিকে গতকাল শুক্রবার রাত ৮টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। এর আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ‘সরকারের সিদ্ধান্তের’ পরিপ্রেক্ষিতে তাকে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। খবর বিডিনিউজের।
শুক্রবার জুমার নামাজের পর রাজধানীর বিজয়নগরে বক্স কালভার্ট রোডে চলন্ত একটি মোটরসাইকেল থেকে হাদিকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। তখনই গুলিবিদ্ধ হাদিকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। গুলিটি হাদির কানের পাশ দিয়ে মাথায় বিদ্ধ হওয়ায় জীবন শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সড়কে ব্যাটারি রিকশায় ছিলেন ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরীফ ওসমান বিন হাদি। তার পেছনে পেছনে আসে ওই মোটরসাইকেলটি। গুলির ঘটনার একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, হাদিকে বহনকারী রিকশাটি বক্স কালভার্ট সড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় একটি মোটরসাইকেল তার অনেকটা পাশ ঘেঁষে চলতে থাকে। রিকশাটির একেবারে কাছে মোটরসাইকেল আরোহী অস্ত্র বের করে গুলি করেন। শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় দুপুরে রাস্তায় যান চলাচল ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে বেশ কম। ফাঁকা রাস্তায় মোটরসাইকেলটি দ্রুতবেগে পালিয়ে যায়।
এরপর হাদির সতীর্থরা তাকে ওই রিকশাতে করেই ঢাকা মেডিকেলের দিকে নিয়ে যায়। ঢাকা মেডিকেলে হাদির সতর্থীরা বলেছেন, ‘একটি গুলিই করেছে, যেটি হাদির মাথায় লেগেছে।’
পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপ–কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ বলেন, পল্টন থানার বক্স কালভার্ট রোডের ডিআর টাওয়ারের সামনে গুলি করা হয়। কারা কী কারণে তাকে গুলি করেছে, তা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। আমরা অপরাধীদের শনাক্তে কাজ করছি। ঘটনাস্থলে একটি গুলির খোসা পাওয়ার কথা জানিয়েছে পুলিশ।
হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বিকাল ৫টায় বলেন, ‘তার মাথার ভেতরে গুলি আছে। বর্তমানে অপারেশন থিয়েটারে তার সার্জারি চলছে।’
তিনি জানান, হাদিকে ‘লাইফ সাপোর্ট’ –এ রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, তার বুকে ও পায়েও আঘাত আছে। যেগুলো সম্ভবত রিকশা থেকে পড়ে যাওয়ার কারণে হয়েছে। অস্ত্রোপচারের পর সন্ধ্যা ৭টা ৩৫ মিনিটের দিকে হাদিকে এভারকেয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এফসিপিএস প্রশিক্ষণার্থী চিকিৎসক সাব্বির হোসেন সাগর ফেইসবুকে লিখেছেন, ‘হাদি ভাইয়ের জিসিএস–৩, বাইলেটারাল পিউপিল ডাইলেটেড। মেডিকেলের ভাষায় যেটা আসলে ব্রেইন ডেথ।’
ডিএমপির জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, ‘জুমার নামাজের পর বেলা ২টা ২৫ মিনিটে বিজয়নগর বঙ কালভার্ট এলাকায় মোটরসাইকেলে আসা হামলাকারীরা হাদিকে গুলি করে পালিয়ে যায়।’ হামলাকারীরা তিনটি মোটরসাইকেলে করে এসেছিল বলে জানান তিনি।
হাদির একজন সহযোদ্ধা বলেন, জুমার নামাজের পর মসজিদে তাদের লিফলেট বিলি কর্মসূচি ছিল। কথা ছিল লিফলেট বিলি শেষে সবাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জড়ো হয়ে দুপুরের খাবার খাবেন, আলোচনা করবেন। এর মধ্যেই হাদির ওপর হামলার খবর আসে। হাদিকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার পর জরুরি বিভাগের সামনে প্রচণ্ড ভিড় তৈরি হয়। নিরাপত্তা জোরদার করতে মোতায়েন করা হয় পুলিশ, র্যাব ও সেনাবাহিনী।
পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপ–কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ বলেন, ‘কারা কী কারণে তাকে গুলি করেছে, তা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। আমরা অপরাধীদের শনাক্তে কাজ করছি।’
জুমার নামাজের আগে বেলা ১১টা ৫২ মিনিটে হাদি ফেইসবুকে লেখেন, ‘যেহেতু ঢাকা–৮ এ আমার পোস্টার–ফেস্টুন কিছুই নাই, তাই আমার এখন ছেঁড়া–ছিঁড়িরও চাপ নাই। দুদকের সামনে থেইকা জুম্মা মোবারক।’
ঢাকা–৮ আসন মতিঝিল, শাহজাহানপুর, পল্টন, রমনা ও শাহবাগ থানা এলাকা নিয়ে গঠিত। তিনি এ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়েছেন। এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। জামায়াত থেকে এ আসনে ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছেন দলের নায়েবে আমির হেলাল উদ্দিন। আর বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পাটি থেকে সেখানে মনোনয়ন পেয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ওসমান হাদির হাত ধরে গড়ে ওঠে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্লাটফর্ম ‘ইনকিলাব মঞ্চ’। ‘সব ধরনের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা–সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ’ সংগঠনটির ঘোষিত লক্ষ্য।
তোপের মুখে মির্জা আব্বাস : হাদিকে হাসপাতালে দেখতে এসে তোপের মুখে পড়েন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। বিকাল ৪টার দিকে এই আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী মির্জা আব্বাস ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে এলে ‘ভুয়া, ভুয়া’ বলে স্লোগান শুরু করেন ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য ও হাদির সমর্থকেরা।
পরে সেনাবাহিনীর সদস্যরা মির্জা আব্বাসকে নিরাপত্তা দিয়ে হাসপাতালের ভেতরে প্রবেশ করার সুযোগ করে দেন। এ সময়ে ইনকিলাব মঞ্চের নেতাকর্মীরা আরও নানা স্লোগান দিতে থাকেন।
হাদির পরিবারের সঙ্গে দেখা করলেন জুবাইদা রহমান : এদিকে হাদির পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করে খোঁজখবর নিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্ত্রী জুবাইদা রহমান। এভারকেয়ার হাসপাতালে রাত সাড়ে ৯টায় হাদির পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। তাদের প্রতি সমর্মিতা প্রকাশ করেন। জুবাইদা রহমান সিসিইউ এর বাইরে হাদির ভাই ও বোনের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি চিকিৎসকদের কাছ থেকে হাদির সর্বশেষ অবস্থার তথ্যও নেন।
বিএনপি মিডিয়া সেলের সদস্য আতিকুর রহমান রুমন ও জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের পরিচালক শাহ মুহাম্মদ আমান উল্লাহ এসময় উপস্থিত ছিলেন।
ভারত হাদিকে ‘বাঁচতে দেবে না’ : ভারতবিরোধী ও বাংলাদেশপন্থি লেখা লিখে ইনকিলাব মঞ্চের আাহ্বায়ক শরীফ ওসমান বিন হাদি শত্রুর খাতায় নাম লিখিয়েছেন বলে দাবি করেছেন তার বোন মাসুমা বেগম। তিনি বলেছেন, ভারত হাদিকে ‘বাঁচতে দেবে না’। হাদির বাড়ি ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার হাড়ীখালী গ্রামে। তার গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর শুনেই এদিন বিকালেই ঢাকায় রওনা দেন মাসুমা।
এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলছিলেন, ‘এ দেশে দেশপ্রেমিক মানুষ থাকবে না, ভারত ওরে বাঁচতে দিবে না। ও ভারতবিরোধী লেখা লেখে, বাংলাদেশপন্থি লেখা লেখে। ওর প্রত্যেকটা শিরায় উপশিরা দেশের জন্য জীবন বিলিয়ে দিবে। এ দেশে ভারতের হাজার হাজার ‘র’ আছে, আওয়ামী লীগ আছে, শত্রুর অভাব নাই। এ দেশে জিয়াউর রহমানকেও বাঁচতে দেয়নি।
হাদির বোন জামাই মনির হোসেন বলেন, ওসমান হাদি এমন একজন ব্যক্তি যার পা থেকে মাথা পর্যন্ত সম্পূর্ণটা দেশপ্রেম। ও শাহবাগের মোড়ে যা বলেন পরিবারের সদস্যদের সাথেও একই বলে। বাংলাদেশে স্বচ্ছ মানুষের রাজনীতি ‘কেউ গ্রহণ করে না’, তাদের এমন মন্তব্যে হাদি নিরুৎসাহিত হতেন তুলে ধরে তিনি বলেন, ও বলতো কারো না করো শুরু করতে হবে, সেই থেকে শুরু করা। আমরা জানতাম এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। সে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, বাংলাদেশের সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে। হাদি বলতো, আমি শুরু করবো, আমি হয়তো থাকবো না, আমার দেখাদেখি হাজার হাজার হাদি জন্ম হবে।
হাদির বাবা প্রয়াত আব্দুল হাদি নলছিটি ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার সাবেক উপাধ্যক্ষ ছিলেন। তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে হাদি সবার ছোট।












