লাইটারেজ জাহাজ সেক্টরে বিশৃঙ্খলা, সংকট

বহির্নোঙরে পণ্য খালাস ব্যাহত, ১২ লাখ টন পণ্য নিয়ে ৪৭ মাদার ভ্যাসেলের অবস্থান ‘পরিস্থিতির উন্নতি না হলে সংকট বাড়বে’

হাসান আকবর | রবিবার , ৯ নভেম্বর, ২০২৫ at ৪:১৯ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পণ্য হ্যান্ডলিংয়ে সংকট দেখা দিয়েছে। লাইটারেজ জাহাজ সেক্টরের বিশৃঙ্খলায় এই অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছে। প্রয়োজনীয় লাইটারেজ জাহাজের অভাবে মাদার ভ্যাসেল থেকে পণ্য খালাস ব্যাহত হচ্ছে অস্বাভাবিকভাবে। রেশনিং করে জাহাজ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে মাদার ভ্যাসেলগুলোতে। বিদেশ থেকে হাজার হাজার টন পণ্য নিয়ে আসা মাদার ভ্যাসেলগুলো চাহিদা অনুযায়ী লাইটারেজ জাহাজ পাচ্ছে না। একেকটি মাদার ভ্যাসেলের চাহিদা যেখানে তিনচারটি করে লাইটারেজ জাহাজ, সেখানে একটি দিতেও হিমশিম খাচ্ছে। এতে চট্টগ্রাম বন্দরের ইমেজ ক্ষুণ্ন হচ্ছে, আমদানি বাণিজ্যের ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। অলস বসে থাকা জাহাজগুলোর বিপরীতে দেশ থেকে লাখ লাখ ডলার চলে যাচ্ছে। বহির্নোঙরে জাহাজজট দেখা দেয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। গতকাল বহির্নোঙরে ৪৭টি মাদার ভ্যাসেল ১২ লাখ টনের বেশি পণ্য নিয়ে অবস্থান করছিল বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। এর মধ্যে ২০ অক্টোবর বহির্নোঙরে পৌঁছেছে এমন জাহাজও রয়েছে।

সূত্রে জানা যায়, বছরে আমদানি বাণিজ্যের ১০ কোটি টনের বেশি পণ্য হ্যান্ডলিং হয় চট্টগ্রাম বন্দরে। প্রতি বছর এর পরিমাণ বাড়ছে। প্রবৃদ্ধি ১৫ শতাংশের বেশি। চট্টগ্রাম বন্দরের হ্যান্ডলিংকৃত পণ্যের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ভোগ্যপণ্যসহ অন্তত ৫ কোটি টন পণ্য হ্যান্ডলিং করা হয় বহির্নোঙরে। বিশ্বের নানা দেশ থেকে লাখ লাখ টন পণ্য নিয়ে আসা বড় বড় মাদার ভ্যাসেল বন্দরের জেটিতে ভিড়তে পারে না। এসব বড় জাহাজ থেকে পণ্যগুলো বহির্নোঙরে লাইটারেজ জাহাজে খালাস করা হয়। মাদার ভ্যাসেলের ক্রেনের সাথে গ্রাভ ব্যবহার করে লাখ লাখ টন পণ্য নামানো হয় লাইটারেজ জাহাজে। একেকটি মাদার ভ্যাসেলে একই সাথে তিনচারটি লাইটারেজ জাহাজে পণ্য খালাস করার সুবিধা থাকে। মাদার ভ্যাসেল থেকে নামানো পণ্য কর্ণফুলী নদীর ষোলটি ঘাটের পাশাপাশি দেশের ৩০টির বেশি গন্তব্যে প্রেরণ করা হয়। অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন সেক্টরের নির্দিষ্ট রুট অনুসরণ করে লাইটারেজ জাহাজগুলো পণ্য পরিবহন করে।

চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত লাইটারেজ জাহাজগুলোর সিংহভাগ বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কোঅর্ডিনেশন সেল (বিডব্লিউটিসিসি) নিয়ন্ত্রণ করে। প্রতিদিন বার্থিং সভা করে বিডব্লিউটিসিসি মাদার ভ্যাসেলের বিপরীতে চাহিদা অনুযায়ী লাইটারেজ জাহাজ বরাদ্দ দেয়। যেগুলো বহির্নোঙরে গিয়ে মাদার ভ্যাসেল থেকে পণ্য খালাস করে। অপরদিকে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন জাহাজগুলো বিডব্লিউটিসিসির সিরিয়ালভুক্ত না হয়ে নিজেদের পণ্য নিজেরাই পরিবহন করে। বহির্নোঙরের পাশাপাশি বন্দরের ভেতরেও জাহাজের ওভারসাইড থেকে পণ্য পরিবহন করে লাইটারেজ জাহাজগুলো। আবার বহির্নোঙরে ড্রাফট কমানোর জন্যও কিছু পণ্য লাইটারেজ জাহাজে খালাস করা হয়। পরবর্তীতে ড্রাফট কমানোর পর ওই জাহাজটি বাকি পণ্য বন্দরের জেটিতে এসে খালাস করে।

সবকিছু মিলে অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন রুটে পণ্য পরিবহন এবং দেশব্যাপী সাপ্লাই চেইন ঠিক রাখার জন্য লাইটারেজ জাহাজ সেক্টর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে বহু বছর ধরে। প্রয়োজনীয় লাইটারেজ জাহাজ পাওয়া না গেলে বহির্নোঙরে বিদেশ থেকে আসা মাদার ভ্যাসেলের অবস্থানকাল বেড়ে যায়। একেকটি মাদার ভ্যাসেল একদিন অলস বসে থাকলে ১৫ থেকে ২০ হাজার ডলার ফিঙড অপারেটিং কস্ট বা এফওসি গচ্ছা দিতে হয়। যার যোগান দিতে হয় আমদানিকারককে। ঘুরপথে তা সাধারণ ভোক্তাদের ওপরই পড়ে। তাছাড়া জাহাজজট সৃষ্টি হলে বিশ্বের শিপিং সেক্টরে বন্দরের ইমেজ সংকটে পড়ে। এসব বন্দরে আনার জন্য বাড়তি ভাড়া দিয়ে জাহাজ ভাড়া করতে হয়।

বেশ কিছুদিন ধরে বহির্নোঙরে মাদার ভ্যাসেলগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী লাইটারেজ জাহাজ বরাদ্দ পাচ্ছে না। দিনের পর দিন মাদার ভ্যাসেল সীমিত পরিসরে কাজ করছে বা অলস বসে থাকছে। এতে জাহাজের অবস্থানকাল বেড়ে যাচ্ছে। একটি মাদার ভ্যাসেলের বিপরীতে ৩/৪টি করে জাহাজ বরাদ্দ চাওয়া হলেও দেয়া হচ্ছে একটি করে। অনেক সময় মাদার ভ্যাসেলের চেয়ে লাইটারেজ জাহাজ কম থাকলে কোনো কোনো জাহাজকে বরাদ্দই দেয়া হচ্ছে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, চট্টগ্রাম থেকে অনেক জাহাজ মালিক পায়রা এবং মোংলা অঞ্চলে জাহাজ নিয়ে গেছেন। সেখান থেকে বাংলাদেশভারত জাহাজ পরিচালনা করছে। আবার অনেক জাহাজ মালিক বিডব্লিউটিসিসির সিরিয়ালে না এসে নিজেরা সরাসরি জাহাজ চালাচ্ছেন। এতে করে প্রয়োজনীয় জাহাজ পাওয়া যাচ্ছে না। আবার গত কয়েক বছরে নানা অনিয়মের শিকার হয়ে অনেক জাহাজ মালিক জাহাজ কেটে স্ক্র্যাপ লোহা বিক্রি করে দিয়েছেন, যার প্রভাব পড়েছে পুরো সেক্টরে।

গতকাল ৪৭টি মাদার ভ্যাসেলের বিপরীতে লাইটারেজ জাহাজ চাওয়া হয়। প্রতিটি জাহাজকে একটি করে জাহাজ দেয়া হয়েছে বলে বিডব্লিউটিসি সূত্র জানিয়েছে। অধিকাংশ পণ্যের এজেন্ট অভিযোগ করেছেন, প্রয়োজনীয় লাইটারেজ জাহাজের অভাবে পণ্য হ্যান্ডলিং মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এতে চট্টগ্রাম বন্দরের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। কিছু জাহাজ মালিক পরিকল্পিতভাবে চট্টগ্রাম বন্দরের ইমেজ ক্ষুণ্ন করার জন্য ষড়যন্ত্র করছে। বিশেষ করে ঢাকার অনেক জাহাজ মালিক চট্টগ্রাম থেকে জাহাজ সরিয়ে নিয়ে এখানে সংকট সৃষ্টি করছেন বলেও তারা মন্তব্য করেন।

লাইটারেজ জাহাজের সংকটের কথা স্বীকার করে বিডব্লিউটিসিসির নির্বাহী পরিচালক মেজর (অব.) জি এম খান বলেন, অনেকগুলো জাহাজ পণ্যবোঝাই অবস্থায় দেশের নানা স্থানে ভাসছে। আমদানিকারকরা পণ্যগুলো খালাস করছেন না। আবার কোনো কোনো জাহাজ পছন্দের পণ্য না পেলে লোড করতে চায় না। চট্টগ্রাম থেকে বহু জাহাজ সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এতে করে বরাদ্দ দেয়ার মতো জাহাজ সিরিয়ালে আসছে না। তাই আমরা রেশনিং করে জাহাজ বরাদ্দ দিতে বাধ্য হচ্ছি। প্রয়োজনীয় জাহাজের যোগান দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। জাহাজ সিরিয়ালে না এলে আমাদের কিছু করার নেই।

রেশনিং পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি না ঘটলে সংকট বাড়বে উল্লেখ করে একাধিক আমদানিকারক বলেছেন, লাইটারেজ জাহাজের সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। এটিকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। আমরা সময়মতো পণ্য খালাস করতে পারছি না। বিদেশি জাহাজগুলো সাগরে অলস ভাসছে। এগুলোর পেছনে আমাদেরকে কোটি কোটি টাকার ডলার গচ্ছা দিতে হচ্ছে। যার নেতিবাচক প্রভাব আমাদের ব্যবসার ওপর পড়বে। এতে বন্দরের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেটি দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে। জরুরি ভিত্তিতে এই সেক্টরে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আনার আহ্বান জানান তারা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএজাহারভুক্ত আসামি নন, তদন্তে নাম এসেছে
পরবর্তী নিবন্ধএই সংবিধানে গণভোট নিয়ে কিছু নেই : খসরু