লবিস্টদের মুখোশ উন্মোচন জরুরি

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী | শনিবার , ১২ আগস্ট, ২০২৩ at ৭:১২ পূর্বাহ্ণ

বিগত প্রায় এক দশক ধরে বিভিন্ন ব্যক্তিরাজনৈতিক দল কর্তৃক কতিপয় ক্ষমতাধর রাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগের মাধ্যমে দেশিবিদেশি অশুভ শক্তির দেশবিরোধী চক্রান্তষড়যন্ত্রঅপতৎপরতা প্রচন্ড অনুভূত। এসব কদর্য লবিস্টরা সরকারের সমালোচনার আড়ালে দেশের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রপাগান্ডায় জাতিকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। বাংলাদেশের উন্নয়নঅগ্রগতিসমৃদ্ধির পথকে বাধাগ্রস্ত করাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য বলে বিজ্ঞজনদের বদ্ধমূল ধারণা। নানা অপকৌশল অবলম্বনে অবৈধ উপার্জিত অর্থে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক হীন লবিস্টদের দিয়ে লবিংতদবিরে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অহেতুক অনধিকার চর্চায় ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে জনগণের মূল্যবোধে আঘাত বা বিভাজনের কুৎসিত প্রচেষ্টা যেকোনো সভ্য মানুষের কাছে অপ্রত্যাশিত। সম্প্রতি ইউরোপআমেরিকাসহ উন্নত দেশসমূহে বিরোধী দলগুলোর নিযুক্ত লবিস্টদের কর্মকাণ্ড এবং ভূরাজনীতিক অনৈতিক প্রভাব বিস্তারের উদ্দেশ্যে পরিচালিত কর্মযজ্ঞে সচেতন মহলসহ দেশের আপামর জনগণ যারপরনাই উদ্বিগ্নউৎকন্ঠিত। কুৎসিত পন্থায় দেশকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিতে তৎপর এসব অযাচিত লবিস্টদের মুখোশ উন্মোচন সময়ের জোরালো দবি।

সাধারণত লবিং বলতে ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট আইন অনুমোদন বা বাতিল করার জন্য সংশ্লিষ্টদের বোঝানোর চেষ্টা করা। কিছু লোক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত জোটবদ্ধ হয়ে শুধুমাত্র তাদের অবাঞ্চিত স্বার্থোদ্ধারে প্রাসঙ্গিক আইনি বিষয়গুলোতে মনোনিবেশ করে। বিশেষভাবে গঠিত গোষ্ঠী বা কর্পোরেশন দ্বারা লবিং করার জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের লবিস্ট বলা হয়। সহজ অর্থে লবিস্ট মানে তদবিরকারী। এ ধরনের ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাজ হলো যেকোনো দেশের নীতিমালাকে তাদের গ্রাহকদের স্বার্থের অনুকূলে নিয়ে আসার জন্য চেষ্টা চালানো। বিনিময়ে তারা গ্রাহকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ফি আদায় করে। গ্রাহক কোনো একজন ব্যক্তিগোষ্ঠী বা রাষ্ট্রও হতে পারে। আর্থিক পরিষেবা, স্বাস্থ্যসেবা, শক্তি, বরাদ্দকরণ, পরিবহন, প্রযুক্তি ও টেলিযোগাযোগ, প্রাকৃতিক সম্পদ, কর, বাণিজ্য, কৃষি এর যেকোনো বিষয় লবিস্টদের অনুশীলন ক্ষেত্র। আইন প্রণয়ন এবং নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বৈধঅবৈধ প্রক্রিয়ায় প্রভাবিত করার ক্ষমতা লবিস্টদের নখদর্পনে।

বৈশ্বিক এবং দেশীয় রাজনীতিতে লবিস্ট ফার্ম নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। লবিস্ট নিয়োগ নিয়ে দেশের সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ অতিশয় দৃশ্যমান। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বৈধভাবে লবিস্ট নিয়োগ দেওয়ার বিধান রয়েছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্র পরিচালনা পদ্ধতি, প্রশাসনের পরিকাঠামো এবং সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণে এটি সহজে অনুমেয় যে, যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ মোটেও অনৈতিক কোন পন্থা নয়। বরং এটিই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনে প্রচলিত ধারা। যুক্তরাষ্ট্রে এসব ফার্মকে পিআর বা জনসংযোগ ফার্ম বলা হয়। জনসংযোগ ফার্মের কাজ হলো মার্কিন নীতিনির্ধারকদের নিকট যেকোন দেশের কার্যাবলী সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্যউপাত্ত উপস্থাপন করা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোনো বিষয়ই সরাসরি কংগ্রেসম্যান বা সিনেটরদের কাছে পৌছানো যায় না বা নীতিনির্ধারকদের কাছে যাওয়া যায় না বিধায় শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের প্রায় সব দেশেরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই ধরনের পিআর ফার্ম বা জনসংযোগ ফার্মের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আমেরিকায় এই ধরনের ফার্মগুলো আইনগত বৈধ এবং তারা বৈধ লাইসেন্সের মাধ্যমে ঘোষণা দিয়েই লবিং করে থাকে। উন্নত দেশসমূহে ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটাতেও লবিস্ট নিয়োগের প্রচলন লক্ষণীয়। বাংলাদেশেরও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের বাণিজ্যের প্রয়োজনে লবিস্ট নিয়োগ করে আসছে।

বিশ্লেষকদের মতে, কোনো দল বা ব্যক্তি অভিযোগ করলেই যুক্তরাষ্ট্র যেমন কারও প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারি করে না, তেমনি কোটি কোটি টাকা দিয়ে লবিস্ট নিয়োগ করলেই সিদ্ধান্ত বাতিল হয়ে যাবে, এমন নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে এবং বাইরের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সাধারণত লবিস্টের মাধ্যমে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করে, যাতে তাদের ব্যবসায়িক ক্ষতি হয়, এমন কোন আইন তৈরি না হয়। সেজন্য লবিস্ট প্রতিষ্ঠান তাদের চুক্তিবদ্ধ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের পক্ষের তথ্য যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রণেতাদের কাছে তুলে ধরে। অন্য দেশে মানবাধিকার সংঘটনের বিষয় বা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দুর্বলতা থাকলে যুক্তরাষ্ট্রও লবিস্ট নিয়োগ করে থাকে। লবিস্ট প্রতিষ্ঠান সেই দেশের অনুকূলে তথ্যাদি যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রণেতাদের কাছে তুলে ধরে। একইসাথে তারা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গণমাধ্যম বা নাগরিক প্রতিষ্ঠান এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো মানবাধিকার সংগঠনের কাছেও সংশ্লিষ্ট দেশের পক্ষে তথ্য দিয়ে থাকে। কোন দেশ যখন তাদের সুশাসনের অভাব বা মানবাধিকার লংঘনের ব্যাপারে লবিস্টের মাধ্যমে তথ্য সরবরাহ করে, তখন সেই তথ্য কতটা সঠিকসেই প্রশ্ন থাকে এবং অনেক সময় বিভ্রান্তি তৈরি হয়।

৫ আগস্ট ২০২৩ সহ বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যউপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়, সাংবাদিকতার মুখোশে বিদেশে বসে বিরোধী দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে তৎপর রয়েছে বিরোধী দলের নেত্রীর সাবেক সহকারী প্রেস সচিব মুশফিক ফজল আনসারী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করে বাংলাদেশের জনগণ ও নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র করছে মুশফিক। ২০১৫ সাল থেকে আমেরিকার নিউইয়র্কসহ বিভিন্ন রাজ্যের বিরোধী দলের সভাসমাবেশে নিয়মিত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনের ভাষ্য, মুশফিক ফজল আনসারী জাতিসংঘের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংগুলোতে হাজির হয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করে আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে।

২৫ জানুয়ারি ২০২২ গণমাধ্যমে প্রকাশিত সূত্রমতে, ২০১৩ সালের ৩০ জানুয়ারি লন্ডনভিত্তিক মার্ক পার্সি নামক একজন এজেন্টের মাধ্যমে বিরোধী দলের নেত্রী ওয়াশিংটন টাইমসে একটি নিবন্ধ লিখিয়েছেন। ‘দ্য থ্যাংকসলেস রোল ইন সেভিং ডেমোক্রেসি ইন বাংলাদেশ; শিরোনামের নিবন্ধে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিলের অনুরোধ করা হয়। এ বিষয়ে উক্ত নিবন্ধে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের অবশ্যই শেখ হাসিনাকে বোঝাতে হবে যে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিল করা হবে যদি তার রাজনৈতিক মতাদর্শের বিরোধী ও শ্রমিক অধিকার নিয়ে সচেষ্ট ব্যক্তিদের মতামত প্রকাশের সুযোগ দেয়া না হয়। এছাড়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে ২০১৯ সালের ১৭ এপ্রিল মার্কিন সিনেট কমিটি, সাবকমিটি ও হাউজ কমিটির চেয়ারম্যানসহ পাঁচজনকে বাংলাদেশকে দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ও অনুদান বন্ধ রাখার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেয় বিরোধী দল। ১৬ জানুয়ারিতেও তাদের লবিস্ট ফার্ম ব্লুস্টার স্ট্র্যাটেজিসের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক দুইটি অধিদপ্তরকে চিঠি দেয়। চিঠিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওয়াশিংটন সফরের সময় নির্বাচন নিয়ে জবাবদিহি ও যুক্তরাষ্ট্রের অসন্তোষ জানাতে তদবির করা হয়।

১৭ জানুয়ারি ২০২২ মহান জাতীয় সংসদে সম্মানিত পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপিজামায়াত লবিস্ট নিয়োগ করে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। বিএনপিজামায়াত বিদেশি লবিস্ট নিয়োগে ৮টি চুক্তি করেছে। এর মধ্যে তিনটি চুক্তি করেছে বিএনপি। এই তিন চুক্তিতে বিএনপি ৩ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। বিএনপি অফিসের ঠিকানাও চুক্তির কপিতে উল্লেখ করা হয়েছে। জামায়াতের চুক্তির কপিতে প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা দেওয়া নেই। তবে চুক্তির কপিতে তাদের নাম রয়েছে।’ ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ প্রকাশিত গণমাধ্যম সূত্রমতে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রচলিত আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে যুক্তরাষ্ট্রে বিরোধী দল কর্তৃক লবিস্ট নিয়োগের যাবতীয় নথিপত্র এবং তথ্যপ্রমাণাদি সংগ্রহ করেছে। এসব নথিপত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিরোধী দল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা আরোপের লক্ষ্যে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার যুক্তরাষ্ট্রের লবিস্টদের দিয়েছে। এই লেনদেনগুলোতে যেসব বাংলাদেশি এবং তাদের এজেন্ট জড়িত তাদের সবারই তথ্য বাংলাদেশ সরকার পেয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। দেশবিদেশে তাদের সব ব্যাংক একাউন্ট এবং অন্যান্য তথ্যাদি ইতোমধ্যে সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব কর্মকাণ্ডে আরও কারা জড়িত সে বিষয়েও পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে। মোদ্দাকথা আমাদের সকলের অনুধাবনে এটি সুস্পষ্ট করা প্রয়োজন যে; দেশ ও সরকার একই বিষয় নয়। সরকার বিরোধী যেকোনো কর্মসূচি যেন দেশবিরোধী না হয় সেদিকে সকলেরই মনোযোগ থাকা জরুরি। এ ধরনের কর্মযজ্ঞ শুধু অন্যায় নয়; দেশবিরোধী অপরাধও বটে। যেকোন সরকারের উচিত এসব অর্থলিপ্সু পশুতুল্য দানবদের আইনের কঠিন আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া। অন্যথায় মিথ্যাগুলো একসময় মানুষের বিশ্বাসে অযাচিত চাষাবাদ বিস্তার করবেই।

লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর বিজ্ঞানচিন্তা
পরবর্তী নিবন্ধপটিয়ায় ট্রাক চাপায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত