খাদ্য ঘাটতি মোকাবেলায় দেশের প্রতি ইঞ্চি জমি চাষাবাদের আওতায় নিয়ে আসতে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা থাকলেও কক্সবাজারের চকরিয়ার উপকূলীয় সাতটি ইউনিয়নে অনাবাদী পড়ে রয়েছে শত শত একর জমি। এসব জমিতে ফসল উৎপাদন একেবারেই বন্ধ রয়েছে। এই অবস্থায় আর্থিকভাবে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন ভুক্তভোগী কৃষকেরা। এসব জমি কেন অনাবাদী এমন প্রশ্নে উপকূলীয় পশ্চিম বড় ভেওলা ইউনিয়নের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব পাড়ার কৃষক মো. ইসলাম (৬৭) দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘বাড়ির কাছে বড়দিয়া বিলটি হচ্ছে ১০ দ্রোনের বা ১৬০ কানির। বিপুল এই জমি বর্তমানে পড়ে রয়েছে একেবারেই অনাবাদী। কারণ এসব জমিতে ধান চাষসহ রকমারি ফসল ফলাতে মিঠাপানির একমাত্র উৎস হচ্ছে ঢেমুশিয়া বদ্ধ জলমহাল। সেই জলমহালের চারিদিকে থাকা সমুদ্র উপকূলের স্লুইসগেটগুলোর মধ্যে পাঁচটি স্লুইস গেট দিয়ে প্রতিনিয়ত ঢোকানো হচ্ছে লবণ পানি। এতে প্রায় ২০০ একর বিশিষ্ট ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই জলমহালটির সব পানিই এখন লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। এতেই কপাল পুড়েছে প্রান্তিক কৃষকের।’ ঢেমুশিয়া জলমহালের লবণ পানির কারণে কৃষক মো. ইসলাম তাঁর জমিতে এবার আবাদই করেননি। অপরদিকে উপকূলীয় সাত ইউনিয়ন সাহারবিল, পশ্চিম বড় ভেওলা, ঢেমুশিয়া, কোনাখালী, পূর্ব বড় ভেওলা, বিএমচর ও বদরখালী ইউনিয়নের অন্তত ৩০ হাজার কৃষক পরিবার এসব ইউনিয়নের অন্তত সাত হাজার একর জমিতে ধানের চারা রোপণ করার পর বেকায়দায় পড়েছেন। মিঠাপানির আঁধার ঢেমুশিয়া জলমহালটি লবণপানিতে টইটম্বুর হয়ে পড়ায় গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে রোপিত ফসল।
সরজমিন উপকূলীয় একাধিক ইউনিয়ন ও ঢেমুশিয়া বদ্ধ জলমহাল ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি ইউনিয়নে দিগন্তজোড়া ধানের জমিতে রোপিত চারা মিঠা পানি না পেয়ে পুড়ে বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। লবণ পানির কারণে গবাদি পশুসহ ১০টি গ্রামের লোকজন সুপেয় পানি থেকেও বঞ্চিত আছে। লবণাক্ত পানির কারণে খোদ জলমহালের পানিতে ভাসতে থাকা কচুরিপানাও পুড়ে লাল–কালচে হয়ে মরে যাচ্ছে।
উপকূলীয় সাত ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, দুর্বৃত্তরা মাছ ধরতে রাতের আঁধারে জলমহালের কপাট খুলে দিচ্ছে।
প্রতি তিন বছর পর পর ঢেমুশিয়া জলমহালটি ইজারা দেওয়া হয় মৎস্যজীবীদের। সর্বশেষ ১৪২৭ বাংলা সনে (২০২০ ইংরেজি) জলমহালটি তিন বছরের জন্য ইজারা পায় জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতি। আগামী বৈশাখ মাস পর্যন্ত এই ইজারার মেয়াদ বিদ্যমান রয়েছে। এটির পরিচালক হচ্ছেন মাতামুহুরী সাংগঠনিক উপজেলা আওয়ামী লীগের সদ্য সাবেক কমিটির সদস্য দলিলুর রহমান।
জেলা প্রশাসনের দেওয়া ইজারায় শর্ত রয়েছে–এই জলমহালে কোনোভাবেই সামুদ্রিক লবণ পানি ঢোকানো যাবে না। কিন্তু প্রতিবছর আমন মৌসুমে ইজারাদার শর্ত অমান্য করে বেশি লাভের আশায় স্লুইস গেটের জলকপাট খুলে দেন। এতে সামুদ্রিক লবণ পানিতে টইটম্বুর হয়ে যায়। তবে ইজারার শর্ত ভঙ্গ করে জলমহালে লবণ পানি ঢোকাচ্ছেন না দাবি করে ইজারাপ্রাপ্ত জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির পরিচালক দলিলুর রহমান বলেন, ‘আমি কোনোসময় ইজারার শর্ত ভঙ্গ করিনি।’
উপকূলীয় ইউনিয়ন বদরখালীর সাতডালিয়া পাড়ার কৃষক নেজাম উদ্দিন, কোনাখালীর জাফর আলম, পূর্ব বড় ভেওলার ছিদ্দিক আহমদ, পশ্চিম বড় ভেওলার সফকাত হোসেন সহ অসংখ্য কৃষকের ভাষ্য– আগে জলমহালটি সর্বসাধারণের জন্য একেবারেই উন্মুক্ত ছিল। কিন্তু প্রায় এক যুগ আগে থেকে নামেমাত্র রাজস্ব নিয়ে এই জলমহালটি তিন বছরের জন্য ইজারা দেওয়ায় কৃষকের কপাল পোড়া শুরু হয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এস এম নাসিম হোসেন দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘একদিকে অনাবৃষ্টি, অন্যদিকে সামুদ্রিক লবণ পানির প্রভাবে এমনিতেই কৃষকের দুর্বিষহ অবস্থায়। সেখানে পরিকল্পিতভাবে ঢেমুশিয়া জলমহালে লবণ পানি ঢোকানো খুবই দুঃখজনক। এটি জানার পর সরজমিন বিভিন্ন ইউনিয়নের ধানক্ষেত পরিদর্শন করেছি। মিঠাপানির সংস্থান কীভাবে নিশ্চিত করা যায় এ নিয়ে করণীয় ঠিক করে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। পাশাপাশি জলমহাল ইজারা না দিতে এবং স্লুইসগেটের নিয়ন্ত্রণ প্রশাসনের হাতে রাখতে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসনে পত্র দেওয়া হবে।’
এ ব্যাপারে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেপি দেওয়ান বলেন, ‘মাছ ধরার জন্য রাতের আঁধারে ডাকাত সাহাব উদ্দিন স্লুইসগেটের জলকপাট খুলে দিচ্ছে বলে অভিযোগ পেয়েছি। এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য নেওয়া হচ্ছে। তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। একইসাথে কৃষকের সমস্যা দূর করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।’