শুষ্ক মৌসুমে কমছে চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি উৎপাদন। সামনের দিনগুলোতে উৎপাদন আরও কমার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে কাপ্তাই লেকের পানি কমে যায়। আর কাপ্তাই লেকে পানি কমে গেলে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রায় ইউনিট বন্ধ করে রাখা হয়। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাঁচটি ইউনিট রয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে একটির বেশি ইউনিট চালু রাখতে পারে না কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম ওয়াসার সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী এবং বিশেষজ্ঞরা জানান, শুষ্ক মৌসুমে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইউনিটগুলো পুরোদমে চালু না থাকলে কাপ্তাই লেক থেকে হালদায় পানি প্রবাহ কমে যায়; যার ফলে কাপ্তাই লেকে শ্যাওলা বা শৈবালের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে। কাপ্তাই লেকের এই শ্যাওলাগুলো হালদা হয়ে ওয়াসার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে চলে আসে। এর ফলে ওয়াসার পানিতে শ্যাওলা দেখা যায়।
অপরদিকে কাপ্তাই লেক থেকে হালদায় পানি প্রবাহ কমে গেলে কর্ণফুলীর লবণাক্ত পানি হালদায় ঢুকে হালদার পানিও লবণাক্ত হয়ে যায়। চট্টগ্রাম ওয়াসার পানিতেও লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যায় শুষ্ক মৌসুমে। যার ফলে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে উৎপাদন কমিয়ে দেয়। ওয়াসার সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরে বর্তমানে দৈনিক ৬০ কোটি লিটার পানির চাহিদা রয়েছে। ওয়াসা ৪৫ থেকে ৪৬ কোটি লিটার চাহিদা পূরণ করছে। এর মধ্যে কর্ণফুলী পানি শোধনাগার প্রকল্প ফেইজ–১–এর মাধ্যমে দৈনিক ১৪ কোটি লিটারের সক্ষমতা থাকলেও শ্যাওলার কারণে দুই কোটি লিটার কম উৎপাদন হচ্ছে। একই অবস্থা কর্ণফুলী পানি শোধনাগার প্রকল্প ফেইজ–২–এর। এ প্রকল্প থেকেও দৈনিক ১৪ কোটি লিটার সক্ষমতার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে ১২ কোটি লিটার। এছাড়া মোহরা পানি শোধনাগার প্রকল্পে দৈনিক ৯ কোটি লিটার, মদুনাঘাট পানি শোধনাগার প্রকল্পে দৈনিক ৯ কোটি লিটারের স্থলে উৎপাদন কমে গেছে। সব মিলে প্রতিদিন ১৪ থেকে ১৫ কোটি লিটার পানির সংকট থেকে যাচ্ছে নগরীতে।
শুষ্ক মৌসুমে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার ফলে উৎপাদন কমে যাওয়ায় দুশ্চিন্তার কথা জানালেন চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ আনোয়ারা পাশা। তিনি বলেন, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে পানি কম ছাড়ায় হালদা নদীতে মিঠা পানির পরিমাণ কমে গেছে। হালদায় উজানের পানির চাপ কমে যাওয়ায় কর্ণফুলী নদীর জোয়ারের লবণাক্ত পানি হালদায় প্রবেশ করছে। হালদা নদীর যে পয়েন্ট থেকে আমরা মোহরা প্রকল্পের পানি সংগ্রহ করি সেখানে বর্তমানে লবণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। হালদায় লবণাক্ততা বেড়ে গেলে ওয়াসার উৎপাদন কমে যাবে।
কাপ্তাই লেকের পানির স্তর কমেছে, পানিতে বেড়েছে শ্যাওলা : কাপ্তাই হ্রদের পানি কমে যাচ্ছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর পানি আগে থেকেই কমতে শুরু করেছে। যার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন নেমে এসেছে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। তাই শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই বিদ্যুৎ উৎপাদন নেমেছে ৪০ মেগাওয়াটে, যেখানে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা ২৪২ মেগাওয়াট। হ্রদে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় প্রায় ২০২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম উৎপাদন হচ্ছে এ কেন্দ্রে।
এদিকে কাপ্তাই লেক থেকে পানি না ছাড়ার (বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো পুরোদমে চালু না রাখায়) কারণে ওয়াসার পানি উৎপাদন কমে গেছে এবং পানিতে শ্যাওলা ও লবণাক্ততার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানাল চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্তৃপক্ষ।
কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক এটিএম আব্দুজ্জাহের আজাদীকে বলেন, বর্তমানে কাপ্তাই হ্রদে পানির স্তর রয়েছে ৯১.১১ ফুট এমএসএল (মিনস সি লেভেল)। কিন্তু রুলকার্ভ অনুযায়ী বর্তমানে পানি থাকার কথা ৯৬.০২ এমএসএল। প্রায় ৫ ফুট পানি কম থাকার কারণে বাধ্য হয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন কর্তৃপক্ষ পাঁচটি ইউনিটের মধ্যে চারটি ইউনিট বন্ধ রেখেছে। শুধু ১টি ইউনিট চালু রেখে মাত্র ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছেন। ওয়াসা বললে হবে না। আমার পানি থাকতে হবে তো। আমি তো উৎপাদন একেবারে বন্ধ করে দিইনি। একটি চালাচ্ছি।
হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, শীতকালে নদীতে পানির পরিমাণ কমে যাওয়ায় পানি প্রবাহ অনেকটা ধীর হয়, যা শ্যাওলা বা শৈবালের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে। এছাড়া শাখা খালের মাধ্যমে নদীতে আসা জৈব পদার্থ বা পুষ্টি উপাদানও (নাইট্রেট, ফসফেট) শৈবালের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। অনেকদিন ধরে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় বর্তমানে কাপ্তাই লেকে পানির স্তর অনেকটা কমে যাওয়ায় পানিতে শৈবাল উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে; যা কাপ্তাই লেক ও কর্ণফুলী নদীর শাখা নদীর মাধ্যমে কর্ণফুলী নদীতে প্রবেশ করে। এসব শ্যাওলা পানি শোধনাগারের ফিল্টারে জমে ফিল্টারকে ব্লক করে। ফলে পানি শোধনাগারে সুপেয় পানি উৎপাদন ব্যাহত হয়। বিভিন্ন রাসায়নিক পদ্ধতি যেমন সঠিক পরিমাণ ক্লোরিন, আলগিসাইড, কার্বন ফিল্টার, ফ্লোকুলেশন ও সেডিমেন্টেশন এবং শ্যাওলাখেকো মাছ (কার্প জাতীয়) ইত্যাদি ব্যবহার করে শ্যাওলা বৃদ্ধি হ্রাস করা হয়।