লবণ উৎপাদনে দেশের লবণচাষিরা উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখিয়েছেন। লবণচাষিরা লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও অধিক লবণ উৎপাদনে সক্ষম হয়েছেন। লবণ উৎপাদন বৃদ্ধির আরও সম্ভাবনা আমাদের রয়েছে। এ লক্ষ্যে দেশের সব লবণচাষির কাছে আধুনিক লবণচাষ পদ্ধতি পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। নতুন পদ্ধতিতে সমপরিমাণ জমি ব্যবহার করে দ্বিগুণ পরিমাণ লবণ উৎপাদন সম্ভব হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এতে দেশে লবণের চাহিদা মিটিয়ে প্রচুর পরিমাণে লবণ বিদেশেও রফতানি করার সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। সেই সঙ্গে দেশের প্রান্তিক লবণচাষিদের আগামীতে বিশেষ সুরক্ষা দেওয়া হবে বলে জানা গেছে।
গত ২৭ এপ্রিল দৈনিক আজাদীতে ‘দেশে লবণ উৎপাদনে ৬২ বছরের রেকর্ড, লবণ চাষিদের জন্য ‘আশীর্বাদ’ হয়ে এসেছে তাপদাহ’ শীর্ষক প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, তীব্র গরমে এখন মানুষ আর প্রাণিকুলের নাভিশ্বাস উঠলেও লবণ চাষিদের চলছে পৌষ মাস! তাপদাহের কারণে গত দুই সপ্তাহ ধরে দৈনিক রেকর্ড পরিমাণ ৩৩ থেকে ৩৬ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন হচ্ছে। এতে দেশে লবণ উৎপাদনে এ বছর ৬২ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশের একমাত্র লবণ উৎপাদন কেন্দ্র কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার সমুদ্র উপকূলীয় এলাকা। চলতি মৌসুমে গত মঙ্গলবার দেশে ৬২ বছরের লবণ উৎপাদনের রেকর্ড ভেঙেছে। গত বুধবার বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) জানিয়েছে, এ মৌসুমে মঙ্গলবার পর্যন্ত ১৮ লাখ ৩৯ হাজার মে. টন লবণ উৎপাদন হয়েছে। গত মৌসুমে সর্বোচ্চ লবণ উৎপাদন হয়েছিল ১৮ লাখ ৩২ হাজার মে. টন। বিসিকের তথ্য মতে, চলতি মৌসুমে কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া, ঈদগাঁও, টেকনাফ, রামু ও বাঁশখালী উপজেলার ৬৬ হাজার ২৯১ একর জমিতে লবণ চাষ হচ্ছে। এ বছর লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন। শুষ্ক মৌসুমে নোনা পানির সাহায্যে এখানে লবণ উৎপাদন করা হয়। একসময় সনাতন পদ্ধতিতে চাষ হলেও এখন মাঠে পলিথিনের সাহায্যে আধুনিক প্রযুক্তিতে লবণের চাষ করা হচ্ছে। লবণ চাষিরা বলছেন, লবণ উৎপাদনের মৌসুম ১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ মে পর্যন্ত ৬ মাস সময় ধরা হলেও মূলত ফাল্গুন, চৈত্র ও বৈশাখ মাসেই বেশি লবণ উৎপাদন হয়। এর মধ্যে বৈশাখ মাসের তীব্র গরমে অন্য মাসের তুলনায় দুই থেকে তিনগুন লবণ উৎপাদন হয়।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, শ্রমনিবিড় লবণশিল্প আমাদের অর্থনীতির একটি সম্ভাবনাময় খাত। লবণ উৎপাদন থেকে মিল পর্যায়ে প্যাকেটজাত হওয়া পর্যন্ত এই শিল্পের সঙ্গে প্রায় পাঁচ লাখ লোক জড়িত এবং প্রায় ২৫ লাখ লোক নির্ভরশীল। জাতীয় অর্থনীতিতে এ শিল্প প্রতিবছর ১২০০–১৫০০ কোটি টাকার অবদান রাখে, যা ফিনিশড গুডস হিসেবে প্রক্রিয়াজাত হয়ে ৩০০০–৩৫০০ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। খাবারের অনুষঙ্গ হিসেবে ছাড়াও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পসহ অন্যান্য শিল্প–কারখানায় প্রচুর পরিমাণে লবণ ব্যবহৃত হয়। তাই অন্যান্য দেশীয় শিল্পের ন্যায় লবণ শিল্পকেও সুরক্ষা দিতে সরকার তৎপর রয়েছে। লবণচাষিদের রক্ষা করা হলে লবণ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব হবে। বিশেষ করে, ধানের মতো লবণচাষিদের কাছ থেকে সরকার কর্তৃক সরাসরি লবণ ক্রয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে লবণচাষিরা বিশেষভাবে উপকৃত হবেন বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। তবে দেশে লবণের উৎপাদন বাড়াতে লবণচাষিদের দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করাও একান্ত প্রয়োজন। এজন্য লবণ চাষবিষয়ক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরি স্থাপন করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের লবণ উৎপাদন কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলাকেন্দ্রিক। কক্সবাজার জেলার কক্সবাজার সদর, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া, রামু ও টেকনাফ উপজেলা এবং চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী ও আনোয়ারা উপজেলায় লবণ চাষ করা হয়। লবণ চাষ একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে সীমিত থাকায় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সব লবণচাষির দক্ষতা বৃদ্ধি এবং ল্যাবরেটরি স্থাপনের মাধ্যমে লবণের মান বজায় রাখা সহজেই সম্ভব হবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
কোরবানি পশুর চামড়া প্রক্রিয়া করণে ট্যানারি মালিকরা স্থানীয় পর্যায় থেকে লবণ সংগ্রহ করে থাকেন। কিন্তু দেশে যে পরিমাণ লবণ উৎপাদিত হয়েছে, তাতে চাহিদার তুলনায় ঘাটতি দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। বর্তমানে রফতানি আয়ের ক্ষেত্রে গার্মেন্টের পরই চামড়াশিল্পের অবদান। শুধু লবণের কারণে সম্ভাবনাময় সেই চামড়া শিল্প যেন ক্ষতিগ্রস্ত্ত না হয়–এটা মাথায় রাখতে হবে। তাই লবণচাষি, ভোক্তা ও চামড়া শিল্পের স্বার্থ–সব কিছু বিবেচনা করেই ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশে লবণ উৎপাদনে ৬২ বছরের রেকর্ড সৃষ্টি আমাদের অর্থনীতির জন্য বড় সুখবর।