সেন্ট্রাল লন্ডনের একটি অ্যাপার্টমেন্ট নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা আর চাপের মুখে পড়েছেন যুক্তরাজ্য সরকারের আর্থিক সেবাবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক। দুর্নীতির অভিযোগের পর তাকে সিটি মিনিস্টারের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি উঠেছে, যদিও টিউলিপ সেসব অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছেন। গতকাল রোববার ডেইলি মেইল এক প্রতিবেদনে লিখেছে, ওই ফ্ল্যাট নিয়ে দুই বছর আগে তাদের ‘অসত্য তথ্য দিয়েছিলেন’ টিউলিপ সিদ্দিক। বলেছিলেন, তার বাবা–মা ওই ফ্ল্যাট তাকে কিনে দিয়েছেন। কিন্তু এখন লেবার পার্টির সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে যে, দুই রুমের ওই ফ্ল্যাটটি এক আবাসন ব্যবসায়ী ‘কৃতজ্ঞতার নিদর্শন’ হিসেবে টিউলিপকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন, যার বর্তমান মূল্য ৭ লাখ পাউন্ড। খবর বিডিনিউজের।
ব্রিটিশ সরকারের আর্থিক সেবাবিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর যে দায়িত্ব পালন করছেন ৪২ বছর বয়সী টিউলিপ, তাতে আর্থিক খাতের দুর্নীতি দমন করাও তার কাজের অংশ। কিন্তু বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধেই দুর্নীতি অভিযোগ ওঠার পর তাকে ওই দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি তুলেছে পার্লামেন্টের বিরোধী দল কনজারভেটিভ পার্টি।
হ্যারো ইস্টের টোরি এমপি বব ব্ল্যাকম্যান বলেন, ‘টিউলিপকে তার অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। তাকে ব্যাখ্যা করতে হবে আসলে কী বলা হয়েছে আর কেন বলা হয়েছে। যদি তা না করেন, তবে মন্ত্রী হিসেবে অক্ষম।’
হান্টিংডনের টোরি এমপি বেন ওবেস–জেক্টি বলেন, ‘টিউলিপ সম্পর্কে এই নতুন তথ্য উদ্বেগজনক। এখন যা দেখা যাচ্ছে, ফ্ল্যাটটি তাকে উপহার দেওয়া হয়েছে, কেনা হয়নি। টিউলিপের কাছে আরও কিছু প্রশ্নের উত্তর জানা বাকি।’
লেবার পার্টির সূত্রের বরাত দিয়ে ডেইলি মেইল লিখেছে, ২০২২ সালে যখন প্রথম বিষয়টি নিয়ে তারা অনুসন্ধানে নামে, টিউলিপের পরিবার বলেছিল, ফ্ল্যাটটি একটি আবাসন কোম্পানির কাছ থেকে কেনা। কিন্তু গত সপ্তাহে সেই বয়ান বদলে গেছে। সম্পত্তি নিবন্ধকের দপ্তরের এক নথির বরাত দিয়ে ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস শুক্রবার এক প্রতিবেদনে লিখেছে, টিউলিপ ২০০৪ সালে কিংস ক্রসের কাছে দুই বেডরুমের ওই ফ্ল্যাট বুঝে নেন এবং সেজন্য তাকে কোনো অর্থ দিতে হয়নি।
আবদুল মোতালিফ নামের এক আবাসন ব্যবসায়ী ২০০১ সালে ফ্ল্যাটটি যখন কেনেন, তখন দাম পড়েছিল ১ লাখ ৯৫ হাজার পাউন্ড। ওই ফ্ল্যাট এখনো টিউলিপের মালিকানায় রয়েছে। তিনি নিজে না থাকলেও সেখান থেকে নিয়মিত ভাড়া পান।
ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, যার কাছ থেকে টিউলিপ ওই ফ্ল্যাট পেয়েছেন, সেই আবদুল মোতালিফের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী, টিউলিপের খালা শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে।
আর বাংলাদেশে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুদক যো তদন্ত শুরু করেছে, সেখানে টিউলিপের নামও এসেছে।
টিউলিপের বিরুদ্ধে অভিযোগ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ২০১৩ সালে তিনি রাশিয়ার সঙ্গে মধ্যস্থতা করেছিলেন। বাজারদরের চেয়ে বেশি খরচের ওই চুক্তির মধ্য দিয়ে তিনি ৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন পাউন্ড (প্রায় ৫৭ হাজার কোটি টাকা) ‘আত্মসাৎ’ করেছেন।
ব্রিটেনের মন্ত্রিপরিষদ দপ্তরের প্রোপ্রাইটি অ্যান্ড ইথিকস দলের একজন ওই অভিযোগ নিয়ে ইতোমধ্যে টিউলিপকে জিজ্ঞাসাবাদও করেছেন। সেখানে ওই অভিযোগকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলেছেন শেখ হাসিনার ভাগ্নি।
আর টিউলিপের একজন মুখপাত্র অবশ্য দাবি করেছেন, ওই ফ্ল্যাট বা তার কোনো সম্পত্তির সঙ্গে শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের কোনো যোগসূত্র থাকার কথা কেউ বললে তা হবে একেবারেই ‘ভুল’।
ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস লিখেছে, কিংস ক্রসের ওই ফ্ল্যাট কেনার বিষয়টি আবদুল মোতালিফ স্বীকার করেছেন। তবে তারপর সেটি নিয়ে কী হয়েছে, সে ব্যাপারে কেনো মন্তব্য তিনি করতে চাননি।
আর বিষয়টি সম্পর্কে অবগত, এমন এক ব্যক্তি ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেছেন, মোতালিফ ওই ফ্ল্যাট টিউলিপকে উপহার দিয়েছেন ‘কৃতজ্ঞতার নিদর্শন’ হিসেবে, কারণ তিনি নিজে যখন দুর্দশার মধ্যে ছিলেন, টিউলিপের বাবা–মা তাকে আর্থিকভাবে সহায়তা দিয়েছিলেন। ডেইলি মেইল লিখেছে, টিউলিপের ওই ফ্ল্যাট নিয়ে তারা ২০২২ সালেই অনুসন্ধান শুরু করেছিল। সে সময় তারা জানতে চেয়েছিল, টিউলিপ ওই ফ্ল্যাট উপহার হিসেবে পেয়েছেন কি না। সে সময় লেবার পার্টির পক্ষ থেকে ইমেইলে বলা হয়েছিল, ২০ বছর আগে টিউলিপের বাবা–মা যখন আলাদা হয়ে যান, তারা নিজেদের পারিবারিক বাড়ি বিক্রি করে কিংস ক্রসের ওই ফ্ল্যাট কেনেন। অন্য কোনো উৎস থেকে ওই অর্থ আসার কথা কেউ বললে, সেটা হবে ‘পুরোপুরি ভুল ও মান হানিকর’।
সে সময় টিউলিপের পারিবারিক লেনদেন খতিয়ে দেখার কথা তুলে ধরে ডেইলি মেইল বলেছে, তার পরিবারের বাড়ি বিক্রির কোনো তথ্য তখন কোথাও মেলেনি।
এরপর আবারও বক্তব্যের জন্য যোগাযোগ করলে টিউলিপ মামলা করার হুমকি দেন বলে ডেইলি মেইলের ভাষ্য।
পার্লামেন্টারি অ্যাকাউন্ট থেকে পাঠানো এক ই মেইলে সে সময় ডেইলি মেইলকে বলা হয়, টিউলিপের বাবা–মায়ের বাড়ি কেনার টাকা দিয়েই কিংস ক্রসের ওই ফ্ল্যাট কেনা হয়েছে। কিন্তু এখন ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে আবদুল মোতালিফের কাছ থেকে টিউলিপের ওই ফ্ল্যাট উপহার পাওয়ার বিষয়টি উঠে আসায় লেবার নেতারাও তাদের বক্তব্য পাল্টে ফেলেছেন বলে লিখেছে ডেইলি মেইল।