লঞ্চটিকে চাপা দিয়েও গতি কমায়নি জাহাজ

শীতলক্ষ্যায় ডুবল লঞ্চ, ৬ জনের লাশ উদ্ধার

আজাদী ডেস্ক | সোমবার , ২১ মার্চ, ২০২২ at ৮:০৮ পূর্বাহ্ণ

নারায়ণগঞ্জের সোনাকান্দা এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীতে জাহাজের ধাক্কায় অর্ধশত যাত্রী নিয়ে মাঝ নদীতে ডুবে গেছে একটি লঞ্চ। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ছয়জনে। মৃত ছয়জনের মধ্যে দুজন নারী, দুজন পুরুষ ও দুই শিশু রয়েছে। তবে
তাৎক্ষণিকভাবে নিহত সবার নাম-পরিচয় জানা যায়নি। দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। লঞ্চটি পানির ২৫ মিটার (প্রায় ৫৫ হাত) গভীরে ডুবে আছে। দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে।
একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলছেন, আশপাশের নৌযান থেকে লোকজন চিৎকার করছিল। কিন্তু লঞ্চের ওপর উঠে পড়া জাহাজটি গতি কমায়নি। গতকাল রোববার দুপুর ২টার দিকে সোনাকান্দা এলাকায় সিটি গ্রুপের মালিকানাধীন মালবাহী জাহাজ রূপসী-৯ পেছন থেকে চাপা দিলে ডুবে যায় যাত্রীবাহী লঞ্চ এম এল আশরাফ উদ্দিন-২। সে সময় নড়িয়া-৪ নামের আরেকটি লঞ্চে নারায়ণগঞ্জ থেকে মাদারীপুরের দিকে যাচ্ছিলেন যাত্রী রাকিব আল রাজু। খবর বিডিনিউজের।
এ ঘটনায় নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আ ন ম বজলুর রশীদকে আহ্বায়ক করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অন্য দুই সদস্য হলেন ক্যাপ্টেন আবু সাইদ মোহাম্মদ দেলোয়ার রহমান ও বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (নৌনিরাপত্তা ও ট্রাফিক)। আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
লঞ্চকে ডুবিয়ে পালিয়ে যাওয়া মালবাহী জাহাজটিকে মুন্সীগঞ্জের একটি ডকইয়ার্ড থেকে আটক করা হয়েছে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রাকিব আল রাজু রাজু বলেন, ২টা ১০ মিনিটের দিকে নারায়ণগঞ্জ নতুন ব্রিজের পাশে পৌঁছার পর দেখি একটি লঞ্চের ওপর জাহাজ তুলে দিয়েছে। লঞ্চের উপরে ওঠার পরও শিপটা স্লো করে নাই। এর কারণ হতে পারে, শিপের পাইলট হয়ত এটা দেখেও নাই। আমরা অনেক চিৎকার করেছি। তাতেও কোনো কাজ হয় নাই। নিজের মোবাইল ফোনে ওই ঘটনার ভিডিও করেন রাজু। সেই ভিডিও ফেইসবুকে দিলে তা ভাইরাল হয়ে যায়।
সেখানে দেখা যায়, রূপসী-৯ জাহাজটি একপাশ থেকে চলন্ত লঞ্চটির ওপর চেপে বসে। লঞ্চের আতঙ্কিত যাত্রীরা নদীতে লাফিয়ে পড়তে শুরু করেন। এ অবস্থা চলে প্রায় ২৫ সেকেন্ড। এক পর্যায়ে লঞ্চটি ডুবে যায়।
নারায়ণগঞ্জ সদর নৌ থানার ওসি মনিরুজ্জামান বলেন, ঠিক কতজন নিখোঁজ আছেন, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তিনি বলেন, ঘটনাস্থলে নৌ পুলিশ ও বিআইডব্লিউটিএ উদ্ধারকাজ শুরু করেছে। অনেকে সাঁতরে তীরে উঠতে সক্ষম হলেও হতাহত বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ডুবুরি দলও সেখানে উদ্ধার কাজে অংশ নেয়। রাতের মতো তল্লাশি অভিযান স্থগিত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন উদ্ধারকর্মীরা। তবে একটি টিম দুর্ঘটনাস্থলে রাখা হয়েছে।
এখনো নিখোঁজ ১৫-২০ জন : ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান জানান, ফায়ার সার্ভিসের দুটি দলের পাঁচজন ডুবুরি এখানে কাজ করছেন। তিনি বলেন, লঞ্চের যাত্রীদের ভাষ্য অনুযায়ী, সেখানে ৪০ থেকে ৫০ জনের মতো যাত্রী ছিলেন। তাদের মধ্যে ২০ থেকে ২৫ জন তীরে উঠতে পেরেছেন। ছয় জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এখনও ১৫ থেকে ২০ জন নিখোঁজ রয়েছেন।
জরুরি যোগাযোগে হটলাইন : লঞ্চডুবির ঘটনায় জরুরি যোগাযোগের জন্য বিআইডব্লিউটিএ একটি ‘হটলাইন’ খুলেছে; যারা নম্বর ১৬১১৩। এছাড়া আরও দুটি টেলিফোন নম্বরও দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হলো +৮৮০২২২৩৩৫২৩০৬; মোবাইল- +৮৮০১৯৫৮৬৫৮২১৩।
বন্ধুর জন্য অপেক্ষা, বাবার জন্য কান্না : ঘাটে বসে বন্ধু আব্দুল্লাহ জাবেদের জন্য কাঁদছিলেন তরুণ তানভির। তারা চার বন্ধু বেড়াতে মুন্সীগঞ্জে যাওয়ার জন্য লঞ্চে উঠেছিলেন। লঞ্চডুবির পর তিন বন্ধু সাঁতরে তীরে উঠতে পারলেও এখনও নিখোঁজ জাবেদ।
কাওকাবুর বলেন, তারা চারজনই লঞ্চের নিচতলায় ছিলেন। কার্গো জাহাজটি যখন লঞ্চটিকে চাপা দেয় তখন লঞ্চজুড়ে মানুষের আর্তচিৎকার। সবাই কার্গো জাহাজটিকে থামাতে বলছিল। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে কাওকাবুর নদীতে লাফিয়ে পড়েন। তিনি বলেন, তার তিন বন্ধুও নদীতে ভেসে উঠেছিলেন। জাবেদকে তিনি সাঁতার কাটতেও দেখেন। তবে তীরে এসে তানভির ও মাহফুজুরকে খুঁজে পেল জাবেদকে পাননি।
এদের মধ্যে দূষিত নোংরা পানি পেটে যাওয়ায় মাহফুজুর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়ে বাসায় পাঠানো হয়েছে। বাকি বন্ধুরা এখনও রয়েছেন নিখোঁজ বন্ধুর অপেক্ষায়। তাদের আশা, জীবিতই ফিরে পাবেন তাদের হারানো বন্ধুকে।
হাতেম আলীর খোঁজে সন্তানরা : শীতলক্ষ্যা পাড়ে কাঁদতে দেখা গেল মুন্সীগঞ্জের হাতেম আলীর মেয়ে কাকলি আক্তারকে। কান্নার মাঝেই খবর নিচ্ছিলেন তার বাবার খোঁজ মিলেছে কিনা? হাতেম আলী ‘এমএল আশরাফ উদ্দিন-২’ লঞ্চে ছিলেন কিনা, তা তার সন্তানরা নিশ্চিত নন। তবে লঞ্চডুবির পর থেকে তার মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় তাদের ধারণা, এই লঞ্চেই ফিরছিলেন তারা।
অসুস্থ হাতেম আলী ঢাকার বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসক দেখাতে গিয়েছিলেন সকালে। বারডেম থেকে নারায়ণগঞ্জ হয়ে মুন্সিগঞ্জ রওনা হয়েছিলেন। সন্তানরা জানান, মুন্সীগঞ্জ থেকে ঢাকা যাতায়াতের জন্য সাধারণত মুন্সীগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জ পথের লঞ্চ বেছে নিতেন হাতেম আলী। অর্থাৎ তিনি লঞ্চে মুন্সীগঞ্জ থেকে নারায়ণগঞ্জ এসে বাসে উঠতেন। আবার ঢাকা থেকে বাসে নারায়ণগঞ্জ গিয়ে মুন্সীগঞ্জের লঞ্চে উঠতেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকরোনা : চারমাস পর নগরীতে শনাক্ত শূন্য
পরবর্তী নিবন্ধকরের বোঝা কমিয়ে আনব