লক্ষ্যই জীবনের গতিধারা নির্ণয় করে

মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান | শনিবার , ১২ ডিসেম্বর, ২০২০ at ১০:৩৯ পূর্বাহ্ণ

১৯৯৬ সালের কথা। ছেলেটির বয়স ১২ কি ১৩ বছর। রাজধানীর উদয়ন স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। পড়াশোনায় মনোযোগী, এর পাশাপাশি বিজ্ঞানের নানা খুঁটিনাটিতে তার বেশ আগ্রহ। আশৈশব তার ইচ্ছে মহাকাশ বিজ্ঞানী হওয়ার। অন্তহীন মহাকাশের গলি-ঘুঁজির সীমাহীন রহস্য তাকে খুব টানে।
একদিন ম’ার উৎসাহে বড় বোনের সাথে সে এলো কোয়ান্টাম মেডিটেশন ক্লাসে। শিখল কিভাবে মনছবি তৈরী করতে হয়। জানল, মনছবি অর্থাৎ জীবনের লক্ষ্য একবার কোনভাবে মনে গেঁথে গেলে তা অর্জিত হবেই, সেটি আজ হোক বা কাল। মনছবি যে কাজ করে স্বয়ংক্রিয় এক মিসাইলের মতই।
ছেলেটি মনছবি করল যে, সে জ্যোতির্বিজ্ঞানী হবে। আর এ জন্য তাকে পড়তে হবে অ্যাস্ট্রোফিজিক্স নিয়ে। যেই ভাবা সেই কাজ। মনছবি ঠিক। তাকে বলা হলো, অ্যাস্ট্রোফিজিক্স তো বাংলাদেশে পড়ানো হয় না, আমেরিকাতে পড়ানো হয়। ছেলেটি বলল, “আমি ওখানে গিয়ে পড়ব”।
এর ঠিক বিশ বছর পরের ঘটনা। ৬ জানুয়ারি ২০১৬। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় বসেছে আমেরিকান অ্যাস্ট্রেনোমিক্যাল সোসাইটির ২২৭ তম বার্ষিক সভা। বিশ্বের জাদরেল সব মহাকাশ বিজ্ঞানীরা সেদিন ওখানে হাজির। একসময় মঞ্চে উঠলেন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র ‘নাসা’য় গবেষণারত একজন তরুণ গবেষক। পড়তে শুরু করলেন তার গবেষণা পত্র। সবাইকে চমকে দিয়ে ঘোষণা দিলেন, মহাকাশে পাঁচটি সুপারস্টার বা অতিতারকার অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে তার দল।
আর এর মধ্য দিয়ে সমাধান মিলেছে প্রায় পৌনে দু’শ বছরের পুরনো একটি মহাজাগতিক সমস্যার। পৃথিবী জুড়ে মহাকাশ বিজ্ঞানী ও গবেষকদের মাঝে হই চই পড়ে গেল। জ্যোতির্বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এ যেন এক অভূতপূর্ব সাফল্য।
কুড়ি বছর আগের সেই কিশোরটিই আজকের এই তরুণ বিজ্ঞানী। তিনি ড. রুবাব খান। তাঁর নেতৃত্বে মহাকাশে পাঁচটি সুপারস্টারের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়েছে। তিনি বাংলাদেশের সন্তান। ঢাকার উদয়ন স্কুল থেকে বাংলা মাধ্যমে এস.এস.সি ও নটরডেম কলেজ থেকে এইচ.এস.সি সম্পন্ন করার পর ফুল ব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে তিনি ভর্তি হন যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অ্যাস্ট্রোফিজিঙ ডিপার্টমেন্টে। তারপর ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে অ্যাস্ট্রমনিতে পিএইচডি করে ২০১৪ সালে পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসেবে যোগ দেন নাসার গডার্ড স্পেস প্লাইট সেন্টারে। বাকিটা তো বিস্ময়কর ইতিহাস।
বন্ধু সহপাঠী ও অন্যদের সাথে রুবাবের পার্থক্য ছিল একটাই। জীবনের শুরুতেই তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন, তিনি কি হতে চান বা কি হবেন। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে তিনি ছিলেন তার লক্ষ্যে অবিচল। তার এই সাফল্যের বীজ তাই অঙ্কুরিত হয়েছিল সেই শৈশবেই।
দ্বিতীয় উদাহরণটিও তের বছর বয়সি এক স্কুল পড়ুয়া বালককে নিয়ে। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলায় তার খুব আগ্রহ। তার মনছবি অর্থাৎ জীবনের লক্ষ্যটাও বেশ বড়। তার ইচ্ছে সে অলিম্পিকে সোনা জিতবে। যদিও তার দেশ থেকে কেউই তখন পর্যন্ত ওটা করতে পারে নি। কিন্তু ঐ যে তার লক্ষ্য! লক্ষ্যটা অবশ্য শৈশবেই তার মনের মধ্যে বুনে দিয়েছিলেন ছেলেটির দাদা, যিনি ছিলেন সেই দেশটির ইতিহাসে প্রথম অলিম্পিয়ান। দাদা ছিলেন লং জাম্পার, এবার নাতির আগ্রহ সাঁতারে। সাঁতারই তার ধ্যান জ্ঞান।
এর মধ্যে একদিন জানা গেল বিশ্বসেরা সাঁতারু এসেছেন তার দেশে, তাদেরই শহরে। বিশ্বাসই হচ্ছিল না যেন ছেলেটির। তিনি যে তার স্বপ্নের নায়ক। এক নামে যার দুনিয়াজোড়া খ্যাতি। তাকে সেদিন কাছে পেয়ে সবার সে কি হুড়োহুড়ি। যদি একটা ছবি অন্তত তোলা যায় তার সঙ্গে। ছেলেটিও পেল সেই কাঙ্খিত সুযোগ। আর সেদিন বুঝি জীবনটা পাল্টে গেল তার। পরের বছর ছেলেটির পরিবার পাড়ি জমাল যুক্তরাষ্ট্রে। তাতে কি! লক্ষ্য তার অটুট, অলিম্পিকে সোনা সে জিতবেই।
আট বছর পর। ২০১৬ সালে ব্রাজিল অলিম্পিকে ১০০ মিটার বাটারফ্লাই সাঁতারে বিশ্বসেরা সাঁতারুকে হারিয়ে দিল মাত্র একুশ বছর বয়সী এক তরুণ। কে সে?
এতক্ষণে নিশ্চয়ই সবার বুঝা হয়ে গেল কার বা কাদের কথা বলা হচ্ছে। হ্যাঁ তাই, বিশ্বসেরা সাঁতারু মাইকেল ফেল্‌প্‌স আর তাকে পুলে হারিয়ে দেয়া সিঙ্গাপুরের জোসেফ স্কুলিংয়ের কথাই বলা হচ্ছে। আট বছর আগের সেই বালক স্কুলিং-ই ২০১৬ এর অলিম্পিকে হারিয়ে দিল তার স্বপ্নের নায়ক সর্বকালের সেরা অলিম্পিয়ান ফেল্‌প্‌সকে।
মানুষের জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে এমন এক ধন্বন্তরি চালিকা শক্তি, যা তাকে কর্মোদ্যমী ও শক্তিমান রাখে জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে। কখনও পথ হারাতে দেয় না। আমরা সবাই জানি আমাদের মস্তিষ্ক এক বিস্ময়কর জৈব কম্পিউটার। সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সুপার কম্পিউটারের চেয়েও যা বহুগুণ শক্তিশালী ও করিৎকর্মা। একবার যদি কোন লক্ষ্য এতে সেঁটে দেয়া যায় এবং তাতে অবিচল থেকে কাজ করে যাওয়া যায়, তবে একদিন না একদিন তা অর্জিত হবেই। এটাই সত্য, এটাই চিরন্তন। পৃথিবীর এযাবৎ সকল সফল মানুষ জেনে বুঝে কিংবা অচেতন মনে সাফল্যের এই সূত্রটিই অনুসরণ করেছেন এবং নিশ্চিতভাবে সফল হয়েছেন। যেমনটা হতে পারি আমরা যে কেউ-ই। প্রতিপাদ্য : একাগ্র থাকলে কঠিন হলেও (বাস্তব) ইচ্ছা পূরণ হয়। লেখক : প্রাবন্ধিক, সমাজব্রতী

পূর্ববর্তী নিবন্ধআগাছা পরিষ্কার করুন দ্রুত, নইলে ভালো ফলন পেতে বিষ প্রয়োগ ছাড়া উপায় থাকবে না
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে