রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কবে

জড়াচ্ছে অপরাধে, বাড়ছে ঝুঁকি, থেমে নেই মানব পাচারও

উখিয়া প্রতিনিধি | বুধবার , ২৪ আগস্ট, ২০২২ at ৬:০৯ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আশ্রয়ের ৫ বছর পূর্ণ হচ্ছে আগামীকাল ২৫ আগস্ট। এ সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গাদের দেখতে এসেছেন অনেক বিশ্ব নেতৃবৃন্দ, আন্তর্জাতিক সেলিব্রিটি। আশ্রয় দেয়ায় প্রশংসিত হয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু সমস্যা সমাধানে আলোর রশ্মির দেখা মিলছে না। এর মধ্যে রোহিঙ্গারা খুন, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, গুম, অস্ত্র, মাদক, স্বর্ণ ও মানব পাচারের মতো গুরুতর অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে। ফলে ঝুঁকি বাড়ছে।
প্রত্যাবাসন কবে : বর্তমানে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয় ক্যাম্পে অন্তত ১৩ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক একাধিক চুক্তি অনুযায়ী এতদিনে অধিকাংশ রোহিঙ্গার নিজ দেশে ফেরত যাওয়ার কথা। কিন্তু বিগত ৫ বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও আনুষ্ঠানিকভাবে মিয়ানমার ফেরত নেয়নি।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে ২০১৭ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার চুক্তি সই করে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রত্যাবাসন শুরু করতে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়। জেডব্লিউজির সর্বশেষ ও পঞ্চম বৈঠক হয় চলতি বছরের ১৪ জুন। মিয়ানমারের নেপিদোয় মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব ইউ থানহ ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে দ্রুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে ঐকমত্য পোষণ করা হয়। দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক উদ্বাস্তু প্রত্যার্পণ চুক্তি অনুযায়ী ২০১৭ সালের নভেম্বরে ও ২০১৮ সালের মাঝামাঝি দুইবার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সে সময়ে অভিযোগ ওঠে, রোহিঙ্গাদের একটি সশস্ত্র গ্রুপের বাধায় তা ভেস্তে যায়। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে জোরালো ভূমিকা গ্রহণকারী মাস্টার মহিবুল্লাহকে ওই সশস্ত্র গ্রুপ হত্যা করে বলে রোহিঙ্গাদের দাবি। চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশের ঘুমধুম সীমান্তের বিপরীতে মিয়ানমারের তংপিউ লেটওয়ে স্থল ট্রানজিট পয়েন্ট দিয়ে প্রতি সপ্তাহে ১৫০ জন ও টেকনাফের হ্নীলার বিপরীতে মিয়ানমারের নাগা খুইয়ে নাফ নদী ট্রানজিট পয়েন্ট দিয়ে প্রতি সপ্তাহে ৩০০ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর কথা। গত সোমবার পররাষ্ট্র সচিব জানান, চলতি বছরের শেষের দিকে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো শুরু হবে। মিয়ানমার সরকারও রোহিঙ্গাদের গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
বাড়ছে ঝুঁকি : কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের তথ্যমতে, দুষ্কৃতকারী রোহিঙ্গারা খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, মানব পাচার, অগ্নিসংযোগসহ ১৪ ধরনের অপরাধে জড়িত। এসব অপরাধের কারণে ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত থানায় ১ হাজার ৯০৮টি মামলা হয়েছে। আর এই সময়ের মধ্যে খুনের ঘটনা ঘটেছে ৯৯টি। ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত হয়েছে ২৩৪ জন। ওই সময় পর্যন্ত ২ হাজার ৮৫০ জনের বিরুদ্ধে ১ হাজার ২৯৮টি মামলা হয়েছিল।
সর্বশেষ ১০ আগস্ট উখিয়ার ১৫ নং জামতলী ক্যাম্পে দুষ্কৃতকারীদের গুলিতে খুন হয়েছে দুই রোহিঙ্গা মাঝি। এ নিয়ে গত ৫ বছরে এদের হাতে খুন হয়েছে অন্তত ১৫ জন মাঝি। গুমের শিকার হয়েছেন অন্তত ১৫ জন। গত দুই মাসে খুন হয়েছে আটজন রোহিঙ্গা।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আলোচিত খুনের ঘটনা ঘটেছিল গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর। ওই রাতে রোহিঙ্গাদের জনপ্রিয় নেতা ও আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যান মাস্টার মুহিবুল্লাহকে খুন করে সন্ত্রাসীরা। এর এক মাসের কম সময়ের মধ্যে ১৮ নং ক্যাম্পের একটি মাদ্রাসার ছয়জন ছাত্র-শিক্ষককে একসাথে হত্যার ঘটনা সবাইকে বিচলিত করে।
৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সদ্য বদলি হওয়া অধিনায়ক (পুলিশ সুপার) মোহাম্মদ সিহাব কায়সার খান জানান, ভবিষ্যতে মাদক, অস্ত্র উদ্ধার ও অপরাধী আটক কার্যক্রম জোরদার করে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয় মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এপিবিএন দৃঢ়ভাবে কাজ করছে।
স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি : উখিয়া ও টেকনাফে স্থানীয় জনসংখ্যার দ্বিগুণের বেশি রোহিঙ্গার বসবাস। প্রতি বছর নতুন জন্ম নেয়া প্রায় ৩৫ হাজার রোহিঙ্গা যোগ হচ্ছে ক্যাম্পে। হাম, ধনুষ্ঠংকার, কলেরা, ম্যালেরিয়া, চর্মরোগ, ডায়রিয়া ও ডেঙ্গুর মতো রোগ বাংলাদেশে প্রায় নিয়ন্ত্রিত হলেও রোহিঙ্গাদের কারণে সেসবের ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে।
ক্যাম্প ও আশপাশের এলাকায় বেড়ে চলেছে এইচআইভি (এইডস) ভাইরাসের বিস্তার। ২০১৫ সাল থেকে গত জুন পর্যন্ত কক্সবাজারে এইডস রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭১০ জন। এর মধ্যে আক্রান্ত ৬১২ জনই রোহিঙ্গা। আর সব মিলিয়ে মারা গেছেন ১১৮ জন। রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে এ রোগ।
ব্যাপক ঘনবসতিপূর্ণভাবে আশ্রয় ক্যাম্পে চলতি বছরের এ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ১২ হাজারের মতো বলে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার অফিসের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ত্বোহা ভুঁইয়া জানান।
কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. আশিকুর রহমান জানান, রোহিঙ্গা আসার আগে এসব রোগের তেমন প্রাদুর্ভাব ছিল না। রোহিঙ্গাদের কাছে এইচআইভি রোগের প্রাদুর্ভাব থাকায় ও তাদের অবাধ মেলামেশা ও এক জায়গায় বেশি সংখ্যক জনবল হওয়ার কারণে এইচআইভি ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
মানব পাচার : বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে কড়াকড়ির ফলে মানব পাচারকারীরা নতুন রুটে রোহিঙ্গাদের মালয়েশিয়া পাচার করছে। বাংলাদেশের পুরনো কিছু দালাল, ক্যাম্পে অবস্থানকারী রোহিঙ্গা দালাল, মিয়ানমারের রাখাইন ও ইয়াঙ্গুনভিত্তিক এবং থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়াভিত্তিক শক্তিশালী দালাল রোহিঙ্গাদের পাচার কাজে জড়িত। উক্ত সিন্ডিকেট সদস্যরা ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের নাফ নদী ও স্থল সীমানা দিয়ে রাখাইনে নিয়ে যায়।
সূত্রে জানা যায়, সড়ক ও জলপথে এসব রোহিঙ্গাকে ইয়াঙ্গুন নিয়ে যায়। ইয়াঙ্গুন উপকূল থেকে আন্দামান হয়ে থাইল্যান্ড বর্ডার ও উপকূল ধরে মালয়েশিয়া পাচার করছে। প্রতিজন রোহিঙ্গা পাচারে বাংলাদেশি ছয় থেকে সাড়ে ছয় লাখ টাকা আদায় করছে পাচারকারীরা।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের জানুয়ারির মধ্যে দেড় হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগর পাড়ি দিয়েছে।
পরিচয় যাচাইয়ে মিয়ানমারের দীর্ঘসূত্রতা : গত তিন বছরে মাত্র ২৭ হাজারের মতো আশ্রিত রোহিঙ্গার পরিচয় নিশ্চিত করেছে মিয়ানমার। অথচ প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে এ সময়ে মিয়ানমারকে ৮ লাখ ২১ হাজারের মতো রোহিঙ্গার তালিকা দিয়েছে বাংলাদেশ। গত ২৩ আগস্ট কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) দপ্তর থেকে এ তথ্য জানা যায়। মিয়ানমার ধীরগতিতে পরিচয় যাচাইয়ের কাজ করছে। তাতে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে।
আইনি জটিলতা : রোহিঙ্গা জেনোসাইড ও নিপীড়নের অভিযোগে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত (আইসিসি) ও আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (আইসিজে) জবাবদিহির মুখে পড়ছে মিয়ানমার। গাম্বিয়ার পর মালদ্বীপ আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলায় বাদীপক্ষ হওয়ার জন্য আবেদন করার ঘোষণা দিয়েছে। কূটনৈতিক সূত্র মতে, আগামী দিনগুলোতে আরো কিছু দেশ এই মামলায় যুক্ত হতে পারে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ও রোহিঙ্গা ক্যাম্প সফর করেন। শেষে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, মিয়ানমার ফিরে গিয়ে রোহিঙ্গাদের যাতে আবারো নিরাপত্তাহীনতায় পড়তে না হয় সেদিক খেয়াল রাখতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার টেকসই সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক মহল কাজ করছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার মতো অনুকূল পরিবেশ নেই বলে জানান তিনি।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ক্যাম্পগুলোতে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সক্রিয়।
অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার সামছুদ্দোজা নয়ন জানিয়েছেন, ক্যাম্পে দুই হাজারের বেশি রোহিঙ্গা মাঝি রয়েছেন। এই মাঝিরা সাধারণ রোহিঙ্গাদের নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। ২৫ আগস্ট গণহত্যার বিষয়টি স্মরণে রাখতে রোহিঙ্গারা সীমিত পরিসরে আলোচনা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করতে পারে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সদস্য সচিব ও উখিয়ার পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, সবচেয়ে উৎকণ্ঠার বিষয় রোহিঙ্গারা নানা অবৈধ কারবারের সঙ্গে জড়িয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। তারা জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট নিচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে বিয়ে করে বাংলাদেশিদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলছে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ও উখিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন দীর্ঘ হলে সামাজিকসহ নানাভাবে নিরাপত্তার ঝুঁকি থেকেই যায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিজিএমইএ ফোরাম চট্টগ্রামের পূর্ণাঙ্গ কমিটি
পরবর্তী নিবন্ধচমেক হাসপাতাল থেকে ভুয়া সেনা সদস্য আটক