রোহিঙ্গা গণহত্যার মামলায় জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে(আইসিজে) মিয়ানমারের সামরিক জান্তার তোলা আপত্তির ওপর গণশুনানি শুরু হচ্ছে আজ সোমবার(২১ ফেব্রুয়ারি)।
মহামারী পরিস্থিতিতে নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগের পিস প্যালেসে মিশ্র পদ্ধতিতে এই শুনানি হবে। আদালতের কিছু সদস্য গ্রেট হল অফ জাস্টিসে উপস্থিত থাকবেন। বাকিরা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিচারিক কার্যক্রমে অংশ নেবেন।
২০১৯ সালে মামলাটির প্রাথমিক শুনানিতে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর পক্ষে সাফাই গেয়েছিলেন দেশটির নোবেলজয়ী নেত্রী অং সান সু চি, তিনি এখন সেই সামরিক জান্তার হাতে বন্দি।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেন বর্তমান জান্তা। এই সরকার জাতিসংঘের স্বীকৃতি না পেলেও তাদের ঠিক করে দেওয়া আট সদস্যের দল আইসিজেতে লড়বে। এ দলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মিয়ানমারের অ্যাটর্নি জেনারেল থিডা ও।
মিয়ানমারের জান্তার প্রতিনিধি এই শুনানিতে লড়াইয়ের সুযোগ পাওয়ায় ওই সরকার কিছুটা কূটনৈতিক বৈধতা পেয়ে যাচ্ছে কি না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন অধিকার কর্মীরা। তবে আইসিজের তরফ থেকে নির্ধারিত সময়েই গণশুনানি এগিয়ে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
গত ১৯ জানুয়ারি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আইসিজে জানায়, ২১, ২৩, ২৫ ও ২৮ ফেব্রুয়ারি এই শুনানি হবে। দুই পক্ষের প্রতিনিধিরা সরাসরি অথবা ভিডিও লিংক ব্যবহার করে শুনানিতে অংশ নিতে পারবেন এবং এ বিষয়ে নির্দেশনা আদালতের ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে।
এছাড়া কূটনৈতিক কোর, গণমাধ্যম কর্মী ও জনসাধারণ আদালতের ওয়েবসাইট ও ইউএন ওয়েব টিভির সরাসরি ওয়েব কাস্টের মাধ্যমে এই শুনানি দেখতে পারবেন।
রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে নির্বিচারে গণহত্যার অভিযোগ এনে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়ার করা এ মামলার বিচারে আইসিজের এখতিয়ার চ্যালেঞ্জ করেছে মিয়ানমারের জান্তা। এবারের গণশুনানি হবে মূলত মিয়ানমারের সেই আপত্তির ওপর।
এর আগে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে অভিযোগকারী গাম্বিয়া এবং অভিযুক্ত মিয়ানমারকে তাদের আইনি যুক্তি দাখিলের জন্য সময় বেঁধে দিয়েছিলো আইসিজে।
গাম্বিয়াকে ওই বছরের ২৩ জুলাইয়ের মধ্যে তাদের অভিযোগের বিষয়ে আইনি যুক্তিগুলো উপস্থাপন করতে বলা হয়েছিল। অন্যদিকে অভিযোগের মুখে থাকা মিয়ানমারকে তাদের নির্দোষিতার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপনের জন্য ২০২১ সালের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারীর প্রেক্ষাপটে এ মামলার কার্যক্রমে ভাটা পড়ে।
পাঁচ বছর আগে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অভিযানে যে বর্বরতা চালানো হয়, তার মধ্য দিয়ে দেশটি ১৯৮৪ সালের আন্তর্জাতিক গণহত্যা কনভেনশন ভঙ্গ করেছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে এ মামলায়।
হেগের পিস প্যালেসে ২০১৯ সালের ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর এ মামলার ওপর প্রাথমিক শুনানি হয়। তাতে গাম্বিয়ার পক্ষে নেতৃত্ব দেন দেশটির বিচার বিষয়ক মন্ত্রী আবুবকর তামবাদু। অন্যদিকে মিয়ানমারের পক্ষে শুনানি করেন অং সান সু চি।
গত বছর ফেব্রুয়ারিতে এক সামরিক অভ্যুত্থানে সু চির দল এনএলডির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে আবারও সামরিক শাসন ফিরিয়ে আনে দেশটির সেনা নেতৃত্ব।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে শুনানির ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় মিয়ানমারকে জরুরি ভিত্তিতে চার দফা অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দিয়েছিল আইসিজে।
সেখানে বলা হয়েছিল, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বা কোনো পক্ষ এমন কিছু করতে পারবে না, যা গণহত্যা হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। গণহত্যার অভিযোগের সমস্ত আলামত তাদের সংরক্ষণ করতে হবে।
কিন্তু তার পরের দুই বছরে দেশটির পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। রাখাইন থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে থাকা সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার ফিরিয়ে নেয়নি। বরং রাখাইনসহ সেদেশের বিভিন্ন এলাকায় জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়নের নতুন নতুন খবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এসেছে।
ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত এক দেশ অন্য দেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গের অভিযোগ তুলতে পারে। এ আদালত কোনো ব্যক্তিবিশেষকে সাজা দিতে পারে না, যেমনটি পারে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)। আইসিসি আলাদাভাবে রোহিঙ্গা গণহত্যার ঘটনা তদন্ত করছে।
আইসিজেতে মামলা হলে আদালতের সিদ্ধান্ত মানার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে সদস্য দেশগুলোর ওপর। আর সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করার কোনো সুযোগ নেই। তবে সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য করার কোনো ক্ষমতা নেই এ আদালতের। সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করারও বহু উদাহরণ রয়েছে।
রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ নিয়ে জাতিসংঘের এই সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায় আসতে কয়েক বছরও লেগে যেতে পারে।