রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গোলাগুলি, ২ জঙ্গি নেতা গ্রেপ্তার, অস্ত্র উদ্ধার

পাহাড় থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নেয় জঙ্গিরা : র‌্যাব

| মঙ্গলবার , ২৪ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৪:৩৯ পূর্বাহ্ণ

কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। গ্রেপ্তারের পর র‌্যাব জানায়, পাহাড়েসমতলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তাড়া খেয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছিল জঙ্গিরা। জামাতুল আনসারের শীর্ষস্থানীয় এক নেতাসহ সশস্ত্র সদস্যদের অবস্থানের খবর পেয়ে র‌্যাবের একটি দল গতকাল ভোরে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় অভিযান চালায়।

দুই পক্ষের তুমুল গোলাগুলির পর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কুতুপালং ৭ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় সংবাদ সম্মেলনে আসেন র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। গ্রেপ্তার দুজনের মধ্যে মাসিকুর রহমান ওরফে রণবীর ওরফে মাসুদ জামাতুল আনসারের সামরিক শাখার প্রধান ও শুরা সদস্য। আর তার সহযোগী আবুল বাশার ওরফে আলম এ সংগঠনের বোমা বিশেষজ্ঞ।

তাদের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, তিনটি পিস্তলের ম্যাগাজিন, ১০ রাউন্ড পিস্তলের গুলি, একটি খালি কার্তুজ, দুটি একনলা (দেশীয়) বন্দুক, ১১টি ১২ বোরের কার্তুজ, ১০০ রাউন্ড পয়েন্ট টুটু (.২২) বোরের গুলি, নগদ ২ লক্ষ ৫৭ হাজার টাকা উদ্ধারের কথা জানিয়েছে র‌্যাব। খবর বিডিনিউজের।

নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার কথা র‌্যাব জানিয়েছিল গত বছরের অক্টোবরের শুরুতে। তখন র‌্যাব জানায়, পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে মিলে দুর্গম এলাকায় প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে তুলেছে জামাতুল আনসার। এরপরে পাহাড়ে ধারাবাহিক অভিযানের খবর জানিয়ে আসছে এলিট ফোর্স র‌্যাব।

র‌্যাবের পরিচালক বলেন, বিভিন্ন সূত্রে গোয়েন্দা তথ্যে তারা নিশ্চিত হন যে, রণবীর ও বাশার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান করছে। ওই তথ্যের ভিত্তিতে কুতুপালং সাত নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ‘এ’ ব্লক ঘিরে গতকাল ভোর ৫টায় যৌথ চিরুনি অভিযান শুরু করে র‌্যাব।

র‌্যাবের অবস্থান বুঝতে পেরে জঙ্গিরা পাশের পাহাড়ে চলে যায়। র‌্যাব ওখানে অভিযান শুরু করলে সশস্ত্র লোকজন র‌্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। আত্মরক্ষার্থে র‌্যাব সদস্যরাও পাল্টা গুলি চালায়। কিছুক্ষণ পর সেখান থেকে দুই জঙ্গি নেতাকে গ্রেপ্তার করতে সমর্থ হয় র‌্যাব।

র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা, র‌্যাব, র‌্যাব৩ এবং র‌্যাব১৫ এর সদস্যরা এ অভিযানে অংশ নেন বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।

যেভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে : সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের পরিচালক আল মঈন বলেন, অক্টোবর মাসে র‌্যাব বাড়িছাড়া যে ৫৫ জনের তালিকা প্রকাশ করেছিল, সেখানে আবুল বাশারের নামও ছিল। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ আবুল বাশার আজ (গতকাল) র‌্যাবকে জানিয়েছে, গত ৩ অক্টোবর র‌্যাব এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ অভিযান শুরু হওয়ার পর সে তার দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাহাড় থেকে পালিয়ে সিলেটে সামরিক শাখার প্রধান রণবীরের কাছে যান। সেখান থেকে তারা দুজন বেশ কিছু দিন আগে কুতুপালং ৭ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এসে আত্মগোপন করেন।

ধারাবাহিক অভিযানের প্রসঙ্গ টেনে র‌্যাবের পরিচালক বলেন, গত বছরের ২০ অক্টোবর পার্বত্য চট্টগ্রামের বিলাইছড়ি থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে পাহাড়ে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় জামাতুল আনসারের সাত জঙ্গি এবং তাদের সহায়তাকারী তিনজন কেএনএফ (বম পার্টি) সদস্যকে আটক করে। পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী বম পার্টির শেল্টারেই জঙ্গিরা সেখানে অবস্থান নেয়। সেখানে গ্রেপ্তারদের মধ্যে হিন্দাল শারক্বীয়ার সামরিক শাখার উপপ্রধান সৈয়দ মারুফ আহমেদ মানিকও ছিলেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে সংগঠনটির সামরিক শাখার প্রধান মাসুকুর রহমান রণবীরের কার্যক্রম এবং সম্ভাব্য অবস্থান সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। ওই তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব দেশের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালায়। এরই ধারাবাহিকতায় সোমবারের অভিযান।

জঙ্গি দলের পাহাড়ি যোগ : বেশ কয়েকজন তরুণের ঘর ছাড়ার তদন্তে নেমে ২০২২ সালের অক্টোবরে র‌্যাব নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া সম্পর্কে তথ্য পাওয়ার কথা জানায়। র‌্যাব বলছে, হরকাতুল জিহাদ, জেএমবি ও আনসার আল ইসলামের বেশ কিছু সদস্য ২০১৭ সালে নতুন এই উগ্রবাদী সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করে। পরে ২০১৯ সালে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামে কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে।

এদিকে কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ নামে পাহাড়ের একটি সশস্ত্র দলের তৎপরতার খবর বেশ কয়েক মাস ধরেই আলোচনায় আসছিল। পাহাড়িরা কেএনএফ সংগঠনটিকে ‘বম পার্টি’ নামে চেনে। নিজেদের তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রান্তিক অঞ্চলের অনগ্রসর জনজাতিগুলোর ‘প্রতিনিধিত্বকারী’ হিসেবে তুলে ধরে। এ সংগঠন ‘কুকিচিন রাজ্যে’ নামে একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল চায়; যেখানে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরারা থাকবে না; থাকবে বম, খিয়াং, পাংখুয়া, লুসাই, খুমি ও ম্রোরা।

দুই দফায় জামাতুল আনসারের ১২ জনকে গ্রেপ্তারের পর র‌্যাবের তরফ থেকে বলা হয়, নতুন এ জঙ্গি সংগঠনকে পাহাড়ের দল বম পার্টি পৃষ্ঠপোষকতা করছে। পাহাড়ে তাদের প্রশিক্ষণও চলছে। নতুন জঙ্গি দলের ‘পাহাড়ি যোগের’ তথ্য সামনে আসার পর অক্টোবরে পার্বত্য চট্টগ্রামে সমন্বিত অভিযান শুরু করার কথা জানায় র‌্যাব; যার অংশ হিসেবে দুর্গম এলাকায় প্রচারপত্র বিলি, মাইকিংও শুরু হয়।

জঙ্গিদের অবস্থানের তথ্য প্রদানকারীকে এক লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয় ওই লিফলেট। পাশাপাশি জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয় সেখানে। এর মধ্যে বান্দরবান ও রাঙামাটির দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে ১০ জনকে গ্রেপ্তারের পর ২১ অক্টোবর র‌্যাবের এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, কেএনএফের প্রতিষ্ঠাতা নাথান বমের সাথে ২০২১ সালে জামাতুল আনসারের আমিরের সমঝোতা হয়। পার্বত্য অঞ্চলে কেএনএফের ছত্রছায়ায় জামাতুল আনসার সদস্যদের ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য তাদের মধ্যে চুক্তিও হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী প্রতি মাসে তিন লাখ টাকা দেওয়ার পাশাপাশি কেএনএফ সদস্যদের খাবার খরচ বহন করে জামাতুল আনসার।

২৭ অক্টোবর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট সিটিটিসি জানায়, জামাতুল আনসারের মূল ব্যক্তি শামিন মাহফুজ, যিনি রংপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে বহিষ্কৃত একজন সাবেক শিবির কর্মী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমন্ত্রণালয়ে আটকা ভূমি অধিগ্রহণের ফাইল
পরবর্তী নিবন্ধভবনের বাইরে ক্লাস করলেন শিক্ষার্থীরা