রাখাইনে চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে সামপ্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশসহ সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত কাও সো মোর কাছে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ। গত রবিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিনের সাক্ষাতে এলে তিনি এই উদ্বেগের কথা জানান। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, পররাষ্ট্র সচিব মিয়ানমারে বিশেষ করে রাখাইন রাজ্যের ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি রাষ্ট্রদূতকে বলেন, ‘এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতিকে আরও তীব্র করেছে, যার ফলে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা জনগণের সামপ্রতিক অনুপ্রবেশ ঘটেছে।’
পররাষ্ট্র সচিব মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে মর্টার শেল এবং বাংলাদেশি নৌকায় গুলি করার কথা উল্লেখ করে সীমান্তে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, ‘এই ঘটনাগুলো বাংলাদেশি সীমান্তে থাকা সমপ্রদায়ের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করছে, যা তাদের তাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলেছে। জসীম উদ্দিন বাংলাদেশি জেলেদের লক্ষ্য করে গুলি চালানোর ঘটনা তুলে ধরেন এবং এই ধরনের ঘটনা রোধ করার ওপর জোর দেন।’
পররাষ্ট্র সচিব সমপ্রতি তার কক্সবাজার সফরের প্রসঙ্গ তুলে ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলার অবনতি, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বৃদ্ধি এবং ক্যাম্পের মধ্যে সহিংস সংঘর্ষ, মাদক চোরাচালান ও পাচার বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে কেন্দ্র করে স্থানীয় সম্পদ ও প্রশাসনের উপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করছে।’ পররাষ্ট্র সচিব রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরুর ওপর জোর দিয়ে রাষ্ট্রদূতকে বলেন, ‘ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায়।’ মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করেন।
এদিকে, রোহিঙ্গা সংকট প্রলম্বিত হওয়ায় এবং আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের মনোযোগ অন্যদিকে সরে যাওয়ায় রোহিঙ্গাদের জন্য আর্থিক সহায়তা কমেছে এবং তাদের জন্য পরিচালিত কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে আর্থিক সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক গোলটেবিল আলোচনায় শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান এ তথ্য জানান। অরবিস ইন্টারন্যাশনাল এবং দ্য ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেস আয়োজিত ‘মানবিক পরিস্থিতে চক্ষুসেবার সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি: পাঠ ও সেরা অনুশীলন’ শীর্ষক আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে দেখাশোনা করা কেবল বাংলাদেশের দায়িত্ব নয়।’ তিনি বলেন, ‘আমরা জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছি। আমরা তাদের পক্ষে কাজ করছি। কিন্তু এখন তারা আমাদের ভুলে যাচ্ছে।’ মিজানুর রহমান বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্বাস্থ্যকেন্দ্র ১৬০ থেকে কমে এখন ১২০–এ দাঁড়িয়েছে এবং আর্থিক সংকটের কারণে বর্তমানে চালু স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোও তাদের সেবা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা সমপ্রদায়ের জন্য কাজ করছে এমন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও আর্থিক সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হচ্ছে।’
বলা জরুরি যে, রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন সমস্যা হচ্ছে। তারা এখন বিশ্বের জন্যও হুমকি। রোহিঙ্গাদের যদি দ্রুত ফিরিয়ে নেওয়া না হয় এ সমস্যা আরও বাড়তে থাকবে। অভিযোগ আছে, বিভিন্ন দেশ এই সমস্যা জিইয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এসব সত্ত্বেও মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের অধিকার ফিরিয়ে না দিয়ে তাদের ওপর মানসিক নির্যাতন করছে। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের জীবন বাঁচাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ ও কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। অথচ বাংলাদেশের নিরাপত্তা আজ ঝুঁকিতে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, দীর্ঘমেয়াদি রোহিঙ্গা সংকট এখন জটিলতার আবর্তে রয়েছে। বাংলাদেশ এ সমস্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। সংকট মোকাবিলায় পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা নিশ্চিতের পাশাপাশি অন্যান্য সমস্যা সমাধানে সব পক্ষকে একত্রে বহুমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশ সরকারকে যে কোনো পরিস্থিতিতে চলমান রোহিঙ্গা সমস্যাকে অগ্রাধিকার তালিকায় রেখে সংশ্লিষ্ট সবার সহায়তায় সংকট সমাধানের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক এক গবেষক তাঁর এক লেখায় লিখেছেন, মিয়ানমার ও রাখাইন রাজ্যে যুদ্ধ বন্ধে এবং স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক দেশগুলোকে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। রোহিঙ্গাদের জন্য রাখাইন রাজ্যে নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করার বিষয়টি ভেবে দেখতে হবে। জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দাতা দেশগুলোর সহায়তায় রোহিঙ্গাদের রাখাইনে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে আরাকান আর্মি, সেখানকার রাজনৈতিক দল ও স্থানীয় রাখাইনদের নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি নিয়ে এনইউজি, আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে সমন্বয়ের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রাখতে হবে। দেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ক্যাম্পের জনঘনত্ব কমাতে হবে। ভাসানচরে কিছু রোহিঙ্গা স্থানান্তর করা হলে এ সমস্যা কিছুটা কমবে। এজন্য প্রয়োজনীয় সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে। নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিজিবি ও কোস্টগার্ডের তৎপরতা চলমান রাখতে হবে।