নির্যাতন ও গণহত্যা থেকে রক্ষা পেতে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থী জীবনকে ‘খাঁচায় বন্দি পাখি’র সঙ্গে তুলনা করে স্বদেশে ফিরে যাওয়ার দাবিতে গণসমাবেশ করেছে রোহিঙ্গারা। তারা বলেছেন, মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত শরণার্থী জীবন খুবই কষ্টের। এই জীবন থেকে মুক্তি পেতে নাগরিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বাড়ার পর সেখানে ফেরার প্রক্রিয়া আরও জটিল হয়ে পড়েছে। তাদের অভিযোগ, আগে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের হত্যা ও নির্যাতন করেছে; এখন একই কাজ করছে আরাকান আর্মি। গতকাল বুধবার দুপুরে উখিয়া উপজেলার কুতুপালং এলাকার লম্বাশিয়া ১–ইস্ট নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অনুষ্ঠিত ওই গণসমাবেশে রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতারা বক্তব্য দেন। ক্যাম্পের মাঠে রোহিঙ্গা কমিউনিটি যুবকদের সংগঠন ‘ইসলামি মাহাসা’ নামের একটি সংগঠনের উদ্যোগে গণসমাবেশটি অনুষ্ঠিত হয়। দুপুর ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত চলা সমাবেশে বিভিন্ন বয়সী অন্তত এক লাখ রোহিঙ্গা অংশ নেন। খবর বিডিনিউজের।
রাখাইন রাজ্যে বিগত কয়েক মাস ধরেই আরাকান আর্মির প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের ক্যাম্পগুলো ছেড়ে পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে বলে আন্তার্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে রাখাইন রাজ্যে অবস্থানরত অবশিষ্ট রোহিঙ্গারাও জীবন–মৃত্যুর হুমকির মধ্যে পড়েন। এই সময়ে প্রচুর রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুতও হয়।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত এসব প্রতিবেদনে বলা হয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সশস্ত্র সংগঠন ও আরাকান আর্মি মুখোমুখি হচ্ছে। তাদের মধ্যে সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যেই সমপ্রতি সরকারের এক উপদেষ্টা সাংবাদিকদের জানান, মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান আর্মির সঙ্গে জান্তা বাহিনীর সংঘাত ও সহিংসতার জেরে এই সময়ে আরো ৬০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন। সীমান্তে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছেন আরো অনেক রোহিঙ্গা।
রাখাইন রাজ্যের এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির মধ্যে বিশাল এই গণসমাবেশ থেকে রোহিঙ্গা নেতারা তাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দাবি তুলে ধরেন। তারা মিয়ানমারে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের জোরালো ভূমিকা নেওয়ার দাবি ও নিজেরা দ্রুত সময়ের মধ্যে নিজ দেশে ফিরে যেতে নানা স্লোগান দেন। সমাবেশে রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, ‘রোহিঙ্গারা নিজেদের দেশ মিয়ানমারের রাখাইন (আরাকান) রাজ্যে ফিরে যেতে প্রস্তুত। রোহিঙ্গাদের দাবিগুলো মিয়ানমার সরকার মেনে নিলে আমরা ফিরে যাব। জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ সরকার সহযোগিতা করলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সহজ হবে।’
ক্যাম্পের শান্তি–শৃঙ্খলা বজায় রাখা রোহিঙ্গাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য মন্তব্য করে তাদের এ কমিউনিটি নেতা বলেন, সমপ্রতি মিয়ানমারের রাখাইন (আরাকান) রাজ্যে আরাকান আর্মির শক্তিশালী অবস্থানের কারণে ফিরতে আরও জটিলতা তৈরি হয়েছে। আরাকান আর্মিও রোহিঙ্গাদের নির্যাতন ও হত্যা করে যাচ্ছে। এর আগে মিয়ানমারের জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের ওপর যে গণহত্যা চালিয়েছিল তার সঠিক ও ন্যায়বিচারও এখনো হয়নি।
রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকারের পাশাপাশি নিরাপত্তা এবং মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা দ্রুত করার জন্য জাতিসংঘসহ বিশ্ব সমপ্রদায়কে এগিয়ে আসার দাবি জানান মোহাম্মদ জোবায়ের।
মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের দাবিগুলো নিশ্চিত করা হলে স্বেচ্ছায় ফিরে যাবেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে সারাজীবন থাকার জন্য আসেনি। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের দায়িত্ব নিয়েছে, থাকার জন্য জমি দিয়েছে, ঘর দিয়েছে, খাবারের ব্যবস্থা করেছে। নিরাপত্তার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কাজ করছে। আমরা (রোহিঙ্গারা) বাংলাদেশের মানুষ ও সরকারের কাছে সারাজীবন ঋণী হয়ে থাকব।
সমাবেশে রোহিঙ্গা নেতা রাহমত করিম বলেন, ‘ক্যাম্পের এমন জরাজীর্ণ বন্দিজীবন মানুষের জন্য না। এখানে বাংলাদেশ যে উদারতা দেখিয়েছে তার জন্য রোহিঙ্গারা কৃতজ্ঞ। এখন সারা বিশ্ববাসীকে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ন্যায়সঙ্গতভাবে ফেরাতে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।’
গণসমাবেশে রোহিঙ্গা কমিউনিটির নেতা জহির আহমেদ, কাওয়ালি হামিদ, আব্দুর রশিদ, দিল মোহাম্মদ ছাড়াও রোহিঙ্গা আলেম–ওলামা ও যুবকরা বক্তব্য দেন।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আইন–শৃঙ্খলায় নিয়োজিত ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি সিরাজ আমিন বলেন, ‘কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই শান্তিপূর্ণভাবে রোহিঙ্গাদের গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। তারা নিজ দেশে ফিরে যেতে এ সমাবেশের আয়োজন করেছেন।’
ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা নিজেদের মধ্যে হানাহানি ও বিভিন্ন অপরাধ প্রবণতা বন্ধসহ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও স্বদেশে ফিরতে একতা সৃষ্টির লক্ষ্যে এই সমাবেশ হয়েছে বলে জানিয়েছেন কঙবাজারের শরাণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।
তিনি বলেন, গত সোমবার তারা সমাবেশ আয়োজনের জন্য অনুমতি নিয়েছে। বুধবার শান্তিপূর্ণ সমাবেশটি শেষ হয়েছে। রোহিঙ্গাদের স্কুল–মাদ্রাসার শিক্ষক, ইমাম, আলেম–উলামা, যুবক ও কমিউনিটি নেতারা সমন্বিতভাবে এ সমাবেশের আয়োজন করেছে।
বুধবারের গণসমাবেশকে ঘিরে গত এক মাস ধরে বিভিন্ন ক্যাম্পে ছোট ছোট সভা–সমাবেশের আয়োজন চলছিল বলেও তথ্য দেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার।
মিজানুর রহমান বলেন, কোনো ধরনের হানাহানি, হট্টগোল ও সংঘাত ছাড়া শান্তিপূর্ণ আয়োজনের শর্তে রোহিঙ্গাদের সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বিভিন্ন সময় বিতাড়িত হযে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কঙবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে এবং নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার ভাসান চরে রয়েছে।