জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায়। এই জনগোষ্ঠীকে ফেরত পাঠাতে মিয়ানমারের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা হওয়া জরুরি বলেও মন্তব্য করেন তিনি। শুক্রবার কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে এক ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা বলেন। মিয়ানমারের নিরাপত্তার নিশ্চিতের দায় আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের জানিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে আমি দুটি স্পষ্ট বার্তা পেয়েছি। প্রথমত, রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যেতে চায়। এটি তাদের অধিকার, তারা বঞ্চনার শিকার। আর ‘দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গারা আরও ভালো পরিবেশ চায় ক্যাম্পে। দুর্ভাগ্যবশত যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য অনেক দেশ সমপ্রতি নাটকীয়ভাবে মানবিক সহায়তা কমিয়ে দিয়েছে। এই কারণে আমাদের মানবিক সহায়তার মধ্যে খাবারের রেশন কমাতে হয়েছে। আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, আমি আমার জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। যত সম্ভব আমি কথা বলব, যাতে করে ফান্ড পাওয়া যায় এবং এর থেকে আরও খারাপ পরিস্থিতি না আসে। গুতেরেস বলেন, ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের মানসম্মত জীবনযাপন প্রয়োজন। এটি নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে জাতিসংঘ। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করার কথাও জানান তিনি।
আসলে রোহিঙ্গা সংকটের চূড়ান্ত সমাধান হলো মর্যাদাপূর্ণ ও স্থায়িত্বশীল প্রত্যাবাসন এবং তা নিশ্চিত করতে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর তৎপরতা আরও বহুগুণে বৃদ্ধি করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার মূল দায়িত্ব মিয়ানমারের। বাংলাদেশ তাদেরকে মানবিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। এখন শুধু মানবিক সহায়তা দিলেই হবে না, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মায়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগের প্রচেষ্টা দ্বিগুণ করতে হবে।
সারা বিশ্ব অবগত যে, শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদান করতে গিয়ে বাংলাদেশ এক বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। এত অল্প সময়ের মধ্যে বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর আগমন তাদের নিরাপত্তা বিধান ও পরিচর্যার জন্য বিশাল ধরনের কর্মযজ্ঞের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। ঘনবসতি, সম্পদের স্বল্পতা, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে দারিদ্র্যের মাত্রা ও পরিকাঠামোগত স্বল্পতা এবং একই সঙ্গে শরণার্থী মোকাবিলার প্রয়োজনীয় আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অনুপস্থিতি বিষয়টিকে আরও জটিল করেছে। এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও রাষ্ট্রের উচ্চতম পর্যায় থেকে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং জাতিসংঘভুক্ত প্রতিষ্ঠানকে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়ে বেশ কিছু সেক্টর চিহ্নিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে এই চাপ মোকাবিলায় দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আহ্বান জানিয়েছে, যার সাড়া ইতিমধ্যে মিলছে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, রোহিঙ্গারা যেন মর্যাদার সাথে এবং স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করতে পারে সেজন্য বাংলাদেশ সরকার সর্বোচ্চ কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। বুধবার এক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতিসংঘ একটা বড় সম্মেলন আয়োজন করতে যাচ্ছে। আমাদের সেখানে মূল ফোকাস থাকবে রোহিঙ্গারা যেন মর্যাদার সাথে ও স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারে এবং রাখাইনের সকল জনগোষ্ঠী যেন সেখানে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারেন। এর জন্য যত ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতা চালানোর প্রয়োজন, আমরা তার সবই করছি।’
জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ‘আমি আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ে জোরালো আওয়াজ তুলবো। কারণ সম্মানের সঙ্গে এখানে বসবাসের জন্য এই সমপ্রদায়ের মানবিক সহায়তা অত্যন্ত জরুরি।’ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রতি জাতিসংঘের ‘অপরিসীম কৃতজ্ঞতা’ প্রকাশ করেন গুতেরেস। তিনি বলেন, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের প্রতি অত্যন্ত উদারতা দেখিয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আমার জন্য একটি বিশেষ বিষয়।’
বিশেষজ্ঞরা বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার সুদূরপ্রসারী সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যখন দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে, ঠিক এ সময়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের সফর সার্বিক বিষয়ে ফলপ্রসূ হবে। মানবিক সহায়তা সংগ্রহের ব্যাপারে তিনি ভূমিকা রাখবেন বলে যে আশ্বাস দিয়েছেন, সেটাও আনন্দের। কেননা রোহিঙ্গাদের পুষ্টি সহায়তা খুবই জরুরি। আমরা আশা করছি, জাতিসংঘ মহাসচিবের এই সফর রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশ্বের নজর ফিরিয়ে আনবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে শরণার্থী সমস্যা মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। সে ক্ষেত্রে শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের যথেষ্ট বিচক্ষণতা ও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। মানবিকতার সঙ্গে প্রয়োজন বিরাজমান বাস্তবতার সঠিক মূল্যায়ন।