গণহত্যার বিচার ও নিজ দেশে ফেরার আকুতি জানিয়ে সমাবেশ করেছে রোহিঙ্গারা। গতকাল শুক্রবার সকালে কক্সবাজারের উখিয়া–টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সকালে উখিয়া–টেকনাফের একাধিক ক্যাম্পের নির্ধারিত স্থানে পৃথক সমাবেশস্থলে জমায়েত হতে থাকে রোহিঙ্গারা। সবচেয়ে বড় সমাবেশ হয় কুতুপালং লম্বাশিয়া ক্যাম্পে। সেখানে বক্তব্য রাখেন রোহিঙ্গা নেতা মৌলানা সৈয়দ উল্লাহ, মাস্টার কামাল, বার্মিজ ভাষায় বক্তব্য রাখেন মাস্টার সোহাইল, ইংরেজি ভাষায় বক্তব্য রাখেন মোহাম্মদ মুসা। সমাবেশে ২০১৭ সালের এ দিনে মিয়ানমার সরকার ও তাদের সহযোগীদের নির্মম নির্যাতন ও গণহত্যার বিচার ও বসতভিটায় ফেরার দাবি জানান তারা। টেকনাফের ২৬ নং ক্যাম্প এবং উখিয়ার ৯, ১৪, ১৩, ১৭, ২ ওয়েস্ট, ১ ওয়েস্ট, ৪ ও ১৮ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নির্ধারিত স্থানে সকাল ৯ টা থেকে সমাবেশে আসতে শুরু করে রোহিঙ্গারা।
সমাবেশে রোহিঙ্গাদের রোহিঙ্গা বলেই ডাকা, দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রত্যেক রোহিঙ্গাকে আরাকানের গ্রামে গ্রামে প্রত্যাবাসন, প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত প্রত্যেক চুক্তি ও প্রক্রিয়ায় অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ, ওআইসি, যুক্তরাজ্য, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, বাংলাদেশ, এনজিও, সংশ্লিষ্ট সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা, বার্মার ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন বাতিল, সম্পত্তি ফেরত, স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকারসহ নানা দাবি উত্থাপন করা হয়। সমাবেশে ইংরেজিতে লেখা একটি লিফলেট প্রচার করা হয়। সেখানে তারা উল্লেখ করেছেন– আজ, যখন আমরা রোহিঙ্গা গণহত্যা স্মরণ দিবসের ৬ষ্ঠ বার্ষিকী স্মরণে জড়ো হয়েছি, তখন আমাদের সেই ট্র্যাজেডির ক্ষণগুলো খুব বেশি তাড়িত করে চলেছে।
আমরা নতমস্তকে বাংলাদেশের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, এমন কঠিন সময়ে আমাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ায়। এদিনে আমাদের মনে পড়ে সেই বর্বরতার ভয়ঙ্কর দৃশ্য– যেখানে আমাদের সন্তানদের পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ঘরবাড়িতে, অগণিত রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছিল, আমাদের মা–বোনদের ধর্ষণ করা হয়েছিল, বাড়িঘর এবং আমাদের গ্রামে আগুন দেওয়া হয়েছিল। নিরপরাধের জীবন ও ভবিষ্যৎ কেড়ে নেয়া হয়েছে।
আমরা দাঁড়িয়ে আছি বেঁচে থাকা, সাক্ষী এবং গণহত্যার শিকার হিসেবে। সেই মর্মান্তিক দিনের পর ছয় বছর পার হয়ে গেছে তবুও আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের কাছ থেকে ন্যায়বিচারের সন্ধান অধরা। আমরা নিজেদের প্রশ্ন করি, ন্যায়বিচারের পথ এত কঠিন কেন? যত দিন যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি আমাদের আস্থা কমছে।
আমাদের আশাগুলো বাংলাদেশের অবিচল অংশীদারিত্বের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়, জাতিসংঘ, আসিয়ান এবং বিশেষ করে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টায় নোঙর করে। আমরা আসন্ন গ্রীষ্মের মধ্যে নিরাপত্তা এবং মর্যাদার নিশ্চয়তাসহ আমাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করতে চাই।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটস’র বর্তমান চেয়ারম্যান ডা. জুবায়ের বলেন, সম্মানজনক প্রক্রিয়ায় আমরা নিরাপদ প্রত্যাবাসন চাই। আমাদের আশা সমাবেশে উত্থাপিত রোহিঙ্গাদের যৌক্তিক দাবিগুলো আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গুরুত্ব পাবে। টেকনাফ শালবাগান ক্যাম্পের নেতা মুহাম্মদ জাকারিয়া ও বদরুল ইসলাম বলেন, বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের মূল দাবি সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে নিজ মাতৃভূমি মিয়ানমারে ফিরতে চাই। বাংলাদেশ সরকার আমাদের আশ্রয় দিয়ে মানবিক দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। আমরা কৃতজ্ঞ।
শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে শান্তিপূর্ণ ভাবে দাঁড়িয়ে নিজ দেশে বাড়ি ফিরার আকুতি জানিয়েছেন।
ক্যাম্পে আইন শৃক্সখলায় নিয়োজিত এপিবিএন অধিনায়করা জানান, রোহিঙ্গারা নিজেদের দাবি নিয়ে সুশৃক্সখল সমাবেশ করেছে। ক্যাম্প এলাকার আইনশৃক্সখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহর নেতৃত্বে একটি মহাসমাবেশ হয়। কিন্তু ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর দুর্বৃত্তের গুলি নিহত হন রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন স্বপ্ন দেখানো নেতা মুহিবুল্লাহ। ২০১৮ সালের দিকে সাধারণ রোহিঙ্গাদের নেতা হিসেবে আবির্ভাব হয় মাস্টার মুহিবুল্লাহর। আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি পিস ফর হিউম্যান রাইটস নামের সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ফেরত নিয়ে যেতে সংগঠিত করেছিলেন তিনি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বেশ জোরালো জনমত গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু প্রত্যাবাসন বিরোধী রোহিঙ্গাদের একটি চক্র ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর উখিয়ার লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডি–ব্লকে সংগঠনের কার্যালয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করে। তিনি নিহত হবার পর এ ধরনের সমাবেশে একক কোনো আয়োজক কিংবা নেতৃত্ব পর্যায়ের কেউ সামনে আসছে না। তবে প্রচারপত্রে আয়োজক হিসেবে ‘নির্যাতিত সাধারণ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী’ লেখা হয়েছে।
২০১৭ সালের আগস্টে মায়ানমারের সেনাবাহিনীর দমন নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে নতুন করে পালিয়ে আসে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা। সরকারি হিসেবে এদের বর্তমান সংখ্যা প্রায় ১৩ লাখ। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদেরকে উখিয়ার টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে আশ্রয় দেয়। তাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে বাংলাদেশ বিশাল বনভূমি হারিয়ে ফেলে। কিছু রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের আনাগোনায় উখিয়া–টেকনাফ পরিণত হয়েছে সন্ত্রাসের জনপদে। ফসলের জমি বিনষ্ট, নিরাপত্তাহীনতা, ব্যয় বৃদ্ধিসহ নানা কারণে দিনদিন স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।
এদিকে সমপ্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খুন আর অস্ত্রের মহড়া বেড়েই চলেছে। আধিপত্য বিস্তারে আরসা–আরএসওর পক্ষ হয়ে কয়েকটি গ্রুপ প্রতিনিয়ত সংঘর্ষে জড়ায়। নিজেদের মাদক কারবারসহ অপরাধ কর্মকাণ্ড জিইয়ে রাখতে, মুন্না গ্রুপ, নবী হোসেন গ্রুপ, আরসাসহ সকল সন্ত্রাসী গোষ্ঠী প্রত্যাবাসন ঠেকাতে তৎপর। তাই তারা ক্যাম্পে ক্যাম্পে খুন ও নাশকতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে একাধিক রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝির দাবি।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর বাংলাদেশে আশ্রিত প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর মানবিক সেবায় আর্থিক সাহায্য এবং তাদের সংকট সমাধানে রাজনৈতিক সহায়তার জন্য আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের প্রতি পুনরায় আহ্বান জানাচ্ছেন বলে উল্লেখ করে সংস্থার সহকারী কমিউনিকেশন অফিসার মোস্তাফা মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘ছয় বছর আগে প্রায় ৭,০০,০০০ রোহিঙ্গা নারী, শিশু ও পুরুষ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসে, পাশাপাশি এর সাথে ছিল এর আগে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়া কয়েক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী। বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবিরের মানবিক পরিস্থিতি যখন খারাপ হচ্ছে, তখন এই দীর্ঘায়িত সংকটকে ঘিরে চ্যালেঞ্জগুলো ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।