প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ব নেতাদের যুদ্ধ, সংঘাতের পথ পরিহার করে শান্তি, মানবজাতির কল্যাণ এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। গত শুক্রবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদরদপ্তরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে তিনি এ আহ্বান জানান। তিনি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। গত মাসে রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত হওয়ার ছয় বছর পূর্ণ হয়েছে। সম্পূর্ণ মানবিক কারণে আমরা অস্থায়ীভাবে তাদের আশ্রয় দিয়েছি। কিন্তু পরিস্থিতি এখন আমাদের জন্য সত্যিই অসহনীয় হয়ে উঠেছে। শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘায়িত উপস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতি, পরিবেশ, নিরাপত্তা এবং সামাজিক–রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। প্রত্যাবাসন নিয়ে অনিশ্চয়তা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক হতাশার জন্ম দিয়েছে। এই পরিস্থিতি সম্ভাব্য মৌলবাদকে ইন্ধন দিতে পারে। এই অবস্থা চলমান থাকলে এটি আমাদের আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করতে পারে।
তিনি বলেন, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায় এবং সেখানে তারা শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করতে আগ্রহী। আসুন আমরা এই নিঃস্ব মানুষের জন্য তাদের নিজের দেশে ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করি।
অন্যদিকে, বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বেসামরিক, নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল উজরা জেয়া জাতিসংঘের ৭৮তম অধিবেশনের ফাঁকে তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলে প্রধানমন্ত্রী একই ধরনের মন্তব্য করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর সরকার রোহিঙ্গাদের তাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের অগ্রাধিকার হচ্ছে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসন করা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করা উচিত, অন্যথায় এই অঞ্চল নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়বে। কারণ রোহিঙ্গারা ইতোমধ্যে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে। যার মধ্যে রয়েছে হত্যা, আগ্নেয়াস্ত্র চোরাচালান এবং মাদক ব্যবসা। রোহিঙ্গারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। কারণ তাদের প্রত্যাবাসন দীর্ঘায়িত হচ্ছে এবং তারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে এবং তারা সেখানে কোনো ভবিষ্যৎ অনুভব করছে না।
শেখ হাসিনা গাম্বিয়ার আন্তর্জাতিক আদালতে (আইসিজে) দায়ের করা মামলায় আন্তর্জাতিক সমর্থনও চেয়েছেন। সাতটি দেশ ফ্রান্স, কানাডা, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক ও মালদ্বীপ মামলার প্রতি সম্মতি দিয়েছে।
এখানে উল্লেখ করা যায়, মায়ানমার থেকে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অবস্থান পাঁচ বছর পূর্ণ হলো গত ২৫ আগস্ট। গত পাঁচ বছরে একজনও প্রত্যাবাসন হয়নি। এত বছরেও রোহিঙ্গাদের ফেরানোর কার্যকর কোনো উদ্যোগ মায়ানমার দেখাতে পারেনি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘ক্রমশই রোহিঙ্গারা আমাদের দেশের জন্য বোঝা হয়ে উঠছে। রোহিঙ্গাদের একটি অংশ নানা অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে, মাদক দ্রব্য, অন্তর্দ্বন্দ্ব ইত্যাদি লেগেই আছে। কয়েকবার প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও নানা কারণে এবং মিয়ানমারের টালবাহানায় তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। অথচ এখন তাদের ফিরে যাওয়ার দরকার। যখন প্রয়োজন হয়েছিল তখন আমরা তাদের আশ্রয় দিয়েছি। তার অর্থ এই নয় যে তাদের আজীবন ধরে রাখতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা পৃথিবী নিজেই এক বিরাট সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি মুহূর্ত পাড়ি দিচ্ছে এই মুহূর্তে। বছর বছর রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নেওয়ায় বৃদ্ধি পাচ্ছে তাদের সংখ্যাও। ফলে যত বছর পার হবে তত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। যা বাংলাদেশের ওপর চাপ তৈরি করবে। এ বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে অনেকবার উঠছে। কিন্তু কার্যকর কোনো কিছু আসেনি।’
ক্রমশই সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে সমস্যার তালিকা। আভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আশ্রয়হীন মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের খাদ্য ও অন্যান্য সুবিধা প্রদানে জটিলতা বাড়ছে। কিন্তু এদের ভবিষ্যত কী হবে তার কোনো সুরাহা হয়নি। এখনো কোনো স্থায়ী সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ইস্যুটি এভাবেই পড়ে থাকছে অমীমাংসিত ইস্যু হয়ে। যেখানে রোহিঙ্গা ফেরত যাওয়ার কথা, সেখানে তাদের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। রোহিঙ্গারা যেখানে আশ্রয় নিয়েছে সেই উখিয়া, টেকনাফ এবং ভাসানচর থেকেও পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। তারা দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রবেশের চেষ্টা করছে। এ অবস্থায় মিয়ানমারের উপর রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার চাপ আন্তর্জাতিকভাবে অব্যাহত রাখতে হবে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ব নেতাদের যেভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, তার প্রভাব আমরা অচিরেই প্রত্যক্ষ করতে চাই। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া যেন দ্রুত শুরু হয়, সে–প্রত্যাশা আমাদের।