চট্টগ্রামে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন বলেছেন ‘রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে যে যে ধরনের পদক্ষেপ দরকার, সব পদক্ষেপ আমরা নিয়েছি। আমরা মিয়ানমারের সাথে ধারাবাহিক আলোচনা করছি। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে।’ গতকাল রোববার দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের বঙ্গবন্ধু মিলনায়তনে মেজর (অব.) মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলামের দুটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. শিরীণ আখতারের সভাপতিত্বে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, মুখ্য আলোচক ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক এবিএম আবু নোমান। খড়িমাটির স্বত্ত্বাধিকারী মনিরুল মনিরের সঞ্চালনায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশের সম্পাদক রুশো মাহমুদ। পিএইচপি গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মহসিন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ১৬ ডিসেম্বর আমরা যখন বিজয় ছিনিয়ে আনি, তখন আমাদের মনে প্রচণ্ড দুঃখ ছিলো। যাঁর নির্দেশে আমরা যুদ্ধ করেছি, তিনি (বঙ্গবন্ধু) তখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন। বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ অবিচ্ছেদ্য ও অভিন্ন। বঙ্গবন্ধু ছাড়া আমাদের স্বাধীনতা সম্পূর্ণ হয় না। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশে ফেরার ফলে আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু ঢাকায় নেমেই বলেছিলেন, ‘আমার বাংলা স্বাধীন হয়েছে, আমার জীবনের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।’ ১০ জানুয়ারির ভাষণে বঙ্গবন্ধু আরো বলেছিলেন, ‘কবিগুরু তুমি বলেছিলে- যে বাঙালি জাতি মানুষ হয়নি। কিন্তু তুমি দেখে যাও, আমাদের বাঙালি জাতি, আমার বাঙালি তারা মানুষ হয়েছে। তোমার যে চিন্তাধারণা আজকে বাংলাদেশিরা ভুল প্রমাণিত করেছে।’
বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য আসছে উল্লেখ করে প্রধান অতিথি বলেন, ‘আমরা পৃথিবীতে একেকটি মডেল তৈরি করছি, আদর্শ তৈরি করছি। বাঙালিরা এগিয়ে যাচ্ছে। কোভিড পেনডেমিকে কত ধরণের প্রচারণা এসেছে, নেতিবাচক বক্তব্য এসেছে। বাংলাদেশে ৫০ লক্ষ থেকে এক কোটি লোক মারা যাবে, এদের (বাংলাদেশ) মেডিকেল সিস্টেম এতো দরিদ্র, এত্তো পুওর। আল্লাহ মেহেরবান, এখনো ৮ হাজারের নীচে মারা গেছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে করোনা ব্যবস্থাপনায় এক নম্বরে অবস্থান করছে। সেকেন্ড ওয়েবটাও আমরা সফলতার সাথে মোকাবেলা করছি। এজন্য আমার উপর হুকুম হচ্ছে, ‘মাস্ক পড়ে থাকো’ এটাই নাকি আসল ঔষধ।’
কোভিডের সময়েও বাংলাদেশের অর্থনীতি খারাপ অবস্থায় ছিল না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ খুব ভালো করছি। গত দুই বছর আগে আমাদের গ্রোথ রেট এশিয়ার ৫০টি দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ ৮ দশমিক দুই পার্সেন্ট। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন- জীবন জীবিকা দুটাকেই বাঁচাতে হবে। কোভিড আসার পর আমরা কেবিনেটের স্পেশাল মিটিং করেছি। আমরা ভেন্টিলেটর, চিকিৎসা সামগ্রী নিয়ে ব্যতিব্যস্ত অবস্থা পার করেছি। তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘লকডাউনে আমার গরীব লোকের জীবিকা বন্ধ হয়ে গেছে। চিকিৎসা সামগ্রী আনার পাশাপাশি এটাও চিন্তা রাখত হবে, ‘আমার দেশের একজন লোকও যেনো না খেয়ে না মরে। তাদের বাড়িতে খাবার পৌঁছে দেবেন।’ এরপর সমস্যাগ্রস্থ মানুষের বাড়িতে খাবার পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। কাজটি অত্যন্ত সুচারুরূপে, কারচুপি, দুর্নীতির উর্ধ্বে থেকে আমার দল আওয়ামী লীগ ও তাদের সহকর্মীরা সম্পন্ন করেছে। যার কারণে পেনডেমিকে কেউ না খেয়ে মরে নাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘শুধু দেশে নয়, যারা বিদেশে আছেন, যাদের কাজ নেই, বেকার, অবৈধ, তারাও যেনো না খেয়ে না থাকেন।’ আমরা স্বদেশ থেকে বিদেশেও টাকা পাঠিয়েছি।
রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘দুনিয়ার কোনো দেশে ১১ লক্ষ লোককে আশ্রয় দেওয়ার ক্ষমতা আছে? ইউরোপের ২৭ দেশে ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেনের মাত্র ১০ লক্ষ লোক নিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল। এখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মানবিক কারণে এই ১১ লাখ লোককে আশ্রয় দিয়েছেন। প্রথম বিদেশীরা কেউ সাহায্য করেনি। কিন্তু আমাদের দেশের লোকেরাই তাদের প্রথম আশ্রয় দিয়েছে, গ্রহণ করেছে। এই মহানুভবতা কোথাও নেই। আমরা নতুন আদর্শ সৃষ্টি করেছি। মডেল সৃষ্টি করেছি। বাঙালিরা মানুষ, তারা মানুষকে মানবিকতার গুণ দিয়ে বিচার করে।’
রোহিঙ্গাদের ফেরতের বিষয়ে মিয়ানমারের সাথে আলোচনা চলমান রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মিয়ানমার আমাদের প্রতিবেশি রাষ্ট্র। তাদের সাথে আমাদের আলাপ হয়েছে। তারা বার বার বলছে, তারা এগুলোকে নিয়ে যাবে। কখনো বলে নাই, নিবে না। আমরা বলেছি, এই লোকগুলোকে তোমরা নিয়ে যাও। কিন্তু অবশ্যই তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। মিয়ানমার বলেছে, উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজকে সাড়ে তিন বছর একজন রোহিঙ্গাও ফেরত যায়নি। কারণ তাদের (মিয়ানমার) মধ্যে আন্তরিকতার অভাব। সর্বশেষ গত ২০ জানুয়ারির পর মিয়ানমারের সাথে আমাদের বড় মিটিং হয়েছে। এরপরে তারা কোভিডের বাহানা দিয়ে, তারপরে ইলেকশনের বাহানা দিয়ে সময় পেছায়। এখন তাদের দেশে ইলেকশন শেষ। ১০ তারিখেই (১০ জানুয়ারি) নতুন করে তাদের সাথে আমাদের আলোচনা শুরুর কথা।’
১৯৯২ সালে দুই লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নেওয়ার উদাহরণ টেনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৮ সালে দেখেছি। ১৯৯২ সালে দেখেছি। তখন অনেক রোহিঙ্গা আমাদের দেশে ছিলো। ১৯৯২ সালে প্রায় দুই লক্ষ ৫৩ হাজার রোহিঙ্গা আমাদের দেশে আসে। পরবর্তীতে আলোচনার মাধ্যমে তাদের মধ্যে দুই লক্ষ ৩০ হাজার নিয়ে যায়। ইতিহাস আছে, তারা নিয়ে গেছে। যার কারণে আমরা আশাবাদী, এখনো তারা নিয়ে যাবে। আমরা মিয়ানমারের সাথে দ্বি-পাক্ষিক আলোচনা করছি। ইন্ডিয়া, চায়না, থাইল্যান্ড সবার কাছে গিয়েছি। সব দেশেই স্বীকার করেছে, সমস্যা সৃষ্টি করেছে মিয়ানমার, সমস্যার সমাধানই বের করবে মিয়ানমার। মিয়ানমার ক্যান সলভস দিস প্রবলেম। তারা সবাই বলছে, স্থায়ী সমাধান হচ্ছে, লোকগুলোকে ফেরত নিয়ে যাওয়া। সেই দিক থেকে পররাষ্ট্রনীতিতে আমরা এখনো ড্রাইভার সিটে (চালকের আসনে) আছি। আমেরিকা, ইউরোপ সবাই এক বাক্যে বলছে, রোহিঙ্গাদের ফেরত নিয়ে যাওয়াই স্থায়ী সমাধান।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে চারটা মিটিং করেছি। সর্বশেষ মিটিংটা খুবই পজিটিভ মিটিং ছিলো। তারা একবাক্যে ওয়াদা করেছে, তারা লোকগুলোকে (রোহিঙ্গা) বুঝাবে। তাদের দেশের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। অন্য সময় কিন্তু বলতো না। কিন্তু রোহিঙ্গারা তাদের সরকারকে বিশ্বাস করে না। সেইজন্য আমরা মিয়ানমারকে বলেছি, তোমাদের বিশ্বাসের ফারাক রয়েছে। বিশ্বাস বাড়ানোর জন্য আমরা তিনবার প্রস্তাব দিয়েছি। কিন্তু তারা ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কোনো উত্তর দেয়নি। আমরা আমাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আলোচনার মাধ্যমে বড় বড় সমস্যার সমাধান করেছি। আমরা মনে করি, আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সম্ভব।’
তিনি বলেন, ‘মেজর এমদাদ সাহেবের সাথে আমার পরিচয় চিটাগাং স্টক এঙচেঞ্জে। এমদাদ সাহেবের কারণে আমি কিছুদিন চিটাগাং এঙচেঞ্জের চেয়ারম্যান হয়েছিলাম। তখন উনার মতো স্পিরিটেড লোকের সাথে আমার পরিচয়। এজন্য আমি উনার (মেজর এমদাদ) প্রতি খুব কৃতজ্ঞ। উনি সবসময় পজিটিভ চিন্তা করেন, কখনো নেগেটিভ বলেন না। উনি এখনো আমাকে আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন, রোহিঙ্গা সমস্যা আমরা অবশ্যই সমাধান করবো। রোহিঙ্গা নিয়ে তথ্যভিত্তিক বইয়ের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। কিন্তু মেজর এমদাদের বইটি যথেষ্ট তথ্যভিত্তিক। তিনি বইটি ইংরেজিতে প্রকাশ করার অনুরোধ করেন। তাহলে বহির্বিশ্ব রোহিঙ্গা নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা পাবে।
অনুষ্ঠানে শিক্ষা উপমন্ত্রী মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা দেওয়ার পরপরই ছাত্রলীগ, যুবলীগের একটি বিশাল টিম টেকনাফে গিয়ে রোহিঙ্গাদের সেবা করেছে। তারা খাদ্য, বস্ত্র নিয়ে গেছে। শেখ হাসিনার কথায় নিজের পকেটের অর্থ খরচ করে রোহিঙ্গা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, স্বাধীনতার পর, ৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে সেটা আমরা দেখেছি। এই অভিজ্ঞতাটা আজীবন ধারণ করা সম্ভব হবে। যে অভিজ্ঞতাটা হয়েছে, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনৈতিক চেতনা থেকেই সেটা হয়েছে। এটা যেন আমাদের রাজনীতিতে, সমাজে চর্চা করি সেই অনুরোধ থাকবে।