সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং বিভিন্ন মিডিয়ার প্রচারিত দুটো ছবি আমাকে খুব আলোড়িত করেছে। প্রথম ছবিটা বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষিতে অস্বাভাবিক না হলেও অপ্রত্যাশিত এবং চরম দুঃখজনক। দ্বিতীয় ছবিটাও অপ্রত্যাশিত। আনিসুল হক বসে বসে কাঁদছেন।
তিনি একজন প্রথিতযশা লেখক, সাংবাদিক এবং বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির পত্রিকা প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক। তাঁর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপন্যাস ‘মা’ বহুবার পড়েছি। বেঁচে থাকলে আরও বহুবার পড়ব। ঘুমাতে ঘুমাতে পড়ব। জেগে উঠতে উঠতে পড়ব। বইটির শততম সংস্করণ বের হয়েছে।
প্রিয় লেখকের কান্না পাঠককে তো ছুঁয়ে যাবেই। তাঁর কান্নারত ছবি দেখে আমার চোখও ভিজে উঠেছে। তাঁর প্রতিটি লেখা আমি খুব আগ্রহ নিয়েই পড়ি। তিনি মুক্তিযুদ্ধকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য অবিরাম কাজ করে যাচ্ছেন।
গল্পটা মোটেই আনিসুল হককে নিয়ে নয়। ছবি দুটো’র গল্প এক। তিনি কাঁদছেন দেশের জন্য, তিনি কাঁদছেন মুক্তিযুদ্ধের জন্য, তিনি কাঁদছেন গণতন্ত্রের জন্য, তিনি কাঁদছেন স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য, তিনি কাঁদছেন তাঁর পাশে বসে দীর্ঘদিন কাজ করা তাঁর সহকর্মীর জন্য, তিনি কাঁদছেন হয়তো ছোট্ট আলবীনার জন্য। রোজিনা ইসলাম প্রথম আলোর সিনিয়র সাংবাদিক। তাঁর সৎ এবং সাহসী সাংবাদিকতার জন্য তিনি ইতিমধ্যে যথেষ্ট সম্মান কুড়িয়েছেন। পেয়েছেনও অনেক পুরস্কার দেশে এবং আন্তর্জাতিকভাবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির অনেক তথ্য উদঘাটন করেছেন তিনি। সচিবালয় কোন নিষিদ্ধ জায়গা নয় সাংবাদিক কিংবা জনগণের জন্য। জনগণের অর্থে চলে এই সচিবালয়, প্রথম ছবিটার ছবি সচিবালয়ে জেুবন্নেসা নামক একজন অতিরিক্ত সচিব রোজিনা ইসলামকে গলা টিপে ধরার দৃশ্য। অভিযোগ ‘তথ্য চুরি’। তাঁকে আটকে রাখা হয়। নির্যাতন করা হয়। যা কোনভাবেই কাম্য ছিল না। রোজিনা ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকতা করছেন। স্বাস্থ্যসেবার দুর্নীতি নিয়ে এই করোনাকালে তিনি অনেকগুলো প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। তাঁর এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ধরে সরকার সংশোধনমূলক পদক্ষেপও নিয়েছেন। এটাই হচ্ছে নিয়ম। দেশে গণতন্ত্রের চর্চা থাকলে, তথ্যের অবাধ প্রবাহ থাকলে দেশ তথা সরকার অনেক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে পারে। করোনার কারণে জনস্বাস্থ্য খাত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাই জনস্বার্থে এই খাতের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে রোজিনা ইসলামের রিপোর্টগুলো অনেকের স্বার্থে আঘাত লেগেছে। তাই তারা নির্লজ্জের মত রোজিনা ইসলামকে এভাবে হেনস্তা করেছে। রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩৭৯ ও ৪১১ ধারায় এবং অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ৩ ও ৫ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। তবে অফিসিয়াল সিক্রেটস নাকি অকার্যকর। এই আইন ব্রিটিশ আমলের। বঙ্গোপসাগরে কত জল গড়িয়ে গেল আমরা এখনও নিজেদের সুবিধার্থে ব্রিটিশ আইন নিয়ে বসে আছি। আমি সাধারণ মানুষ। আইন-টাইন বুঝি কম। কিন্তু আমার জানা আছে জনস্বার্থে যে কোন তথ্য পাবার অধিকার আমার আছে। সংবিধান আমাকে সেই অধিকার দিয়েছে। নিজে-নিজে তো আর তথ্য সংগ্রহ করতে পারব না। তাই আমাদের ভরসা হয়ে ওঠে রোজিনা ইসলামেরা। যারা আমাদের জানাতে পারেন কোথায় কি হচ্ছে, আমলাদের এভাবে ক্ষমতা প্রদর্শন অশোভন। জনগণই হচ্ছে এদেশের মালিক আপনারা নন।
আপনারা কোটি টাকার লেপ-তোষক-পর্দা বালিশ যা বানাচ্ছেন সবই জনগণের অর্থে সচিবালয়ে বসে ক্ষমতার উত্তাপে ভাসবেন, বিদেশে গড়ে তুলবেন বেগম পাড়া, সাহেব পাড়া আর সুযোগ পেলেই টুটি চেপে ধরবেন সত্যানুসন্ধানীদের। একবার ভাবুন এই দেশটার কথা। এদেশের মানুষের কথা। ভাবুন এই করোনাকালে কত পরিবার নিঃস্ব হয়েছে। ভাবুন চিকিৎসার অভাবে কত মানুষ মারা গেছে, ভাবুন আমাদের স্বাস্থ্যসেবার কি দৈন্যদশা! আপনারা কেন আত্মগ্লানিতে ভোগেন না! গণপ্রজাতন্ত্রের সেবক আপনারা। অন্য শব্দ ব্যবহার করলাম না।
আশা করছি খুব সহসা রোজিনা ইসলাম মুক্তি পাবেন। তাঁর কলম আরো শক্তিশালী হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে।
সব মহলের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। ছোট্ট আলবীনা তার মায়ের অপেক্ষায় আছে। তার প্রতীক্ষার অবসান হোক।