রেল ভ্রমণ বিশ্বব্যাপী সাশ্রয়ী ও তুলনামূলক নিরাপদ গণপরিবহন হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে পরিবহন খাতে ট্রেন তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যাতায়াত থেকে শুরু করে মালামাল পরিবহন ও কর্মসংস্থানের অন্যতম মাধ্যম হলো রেল খাত। সময়ের পরিক্রমায় এ দেশে রেলের পরিসর বহুগুণ বেড়েছে। বিগত সময়ে এ খাতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ হয়েছে। যদিও রেলওয়ের সেবার মান আজও আশানুরূপ পর্যায়ে উন্নীত হতে পারেনি। গত ১৩ নভেম্বর দৈনিক আজাদীতে ‘চট্টগ্রাম–সিলেট রুট ভোগান্তিতে যাত্রীরা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম–সিলেট রুটে ট্রেন যাত্রীদের টিকিট সংকটের ভোগান্তি বছরের পর বছরও কাটছে না। চট্টগ্রাম–সিলেট সড়ক পথের দীর্ঘ ভোগান্তির কারণে যাত্রীরা রেলভ্রমণ বেছে নিয়েছেন, কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ এ রুটে ট্রেনযাত্রীদের চাহিদার তুলনায় ২০ ভাগ টিকিটও দিতে পারছে না। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের পরিবহন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, শুধু বগি বাড়িয়ে টিকিট সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়, এজন্য নতুন ট্রেন চালুর বিকল্প নেই। এই রুটে চলাচলরত পাহাড়িকা ও উদয়ন এক্সপ্রেসের পাশাপাশি আরও নতুন ট্রেন চালুর জন্য যাত্রীরা দীর্ঘদিন থেকে দাবি জানিয়ে আসলেও একযুগেও নতুন ট্রেন চালু করা সম্ভব হয়নি।
চট্টগ্রাম স্টেশনে টিকিট কাউন্টারে গিয়ে বুকিং সহকারীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, চট্টগ্রাম থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী ট্রেনে করে সিলেট যাওয়ার জন্য অনলাইন এবং কাউন্টারে ভিড় করেন। কিন্তু ট্রেনযাত্রীদের চাহিদার ২০ ভাগ টিকিটও দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
সিলেট রুটের বেশ কয়েকজন যাত্রী অভিযোগ করে বলেন, চট্টগ্রাম–সিলেট সড়ক পথের মতো রেলপথের অবস্থাও শোচনীয়। গুরুত্বপূর্ণ এই রেলপথের শোচনীয় অবস্থার কারণে চট্টগ্রাম–সিলেট রুটের যাত্রীদের যেখানে ৬–৭ ঘণ্টায় গন্তব্যে পৌঁছার কথা–সেখানে ৯ ঘণ্টা পর্যন্ত লেগে যায় প্রতিটি ট্রেন গন্তব্যে পৌঁছতে।
এই ব্যাপারে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার আবু জাফর মজুমদার জানান, চট্টগ্রাম–সিলেট রুটে চলাচলরত পাহাড়িকা ও উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকিটের চাহিদা প্রচুর। সড়ক পথে ভোগান্তির কারণে সিলেট–চট্টগ্রাম রুটের যাত্রীদের কাছে ট্রেনের চাহিদা বেশি। চাহিদা মতো আমরা টিকিট দিতে পারছি না। প্রতিটি ট্রেনে অতিরিক্ত বগি লাগানো হয়। নতুন ট্রেন চালু না হওয়া পর্যন্ত যাত্রীদের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সাধারণত রেলসেবা হিসেবে জনগণের আকাঙ্ক্ষা থাকে বিনা ভোগান্তিতে ট্রেনের টিকিট প্রাপ্তি, পরিচ্ছন্ন প্লাটফর্ম ও ট্রেন, স্বাচ্ছন্দ্যে ট্রেনযাত্রা। কিন্তু এ সাধারণ বিষয়গুলো আজ পর্যন্ত কোনো সরকার এবং রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করতে পারেনি। অন্তর্বর্তী সরকারও রেল সেবার মান উন্নয়নে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ এসব সমস্যা সমাধানের জন্য দীর্ঘ সময় কিংবা বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের প্রয়োজন ছিল না। পরিচালন ব্যয় বাড়ানোরও তেমন আবশ্যকতা ছিল না। কেবল দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই বিদ্যমান সেবাগুলোর মান বাড়ানো যেত। এতেই যাত্রী ভোগান্তি অনেকাংশে কমানো সম্ভব ছিল।
পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর এ পরিস্থিতিতেও বিশেষ কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। একদিকে সেবার মান নিশ্চিত করতে পারেনি রেল কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে বাংলাদেশ রেলওয়ে দীর্ঘ বছর ধরে লোকসানে চলছে। এর অন্যতম কারণ অদক্ষ ব্যবস্থাপনা। পুরো দেশকে রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে নানা সময়ে নতুন নতুন রেলপথ নির্মাণ, ট্র্যাক সংস্কারসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে প্রতি বছর নতুন রেলপথ নির্মাণ এবং ট্রেনসেবা শুরু করলেও চাহিদা অনুযায়ী ইঞ্জিন আমদানি করা হয় না। যথাসময়ে প্রয়োজনমাফিক জনবলও নিয়োগ দেয়া হয় না। ইদানীং ট্রেন দুর্ঘটনাও তুলনামূলক বেড়েছে। চলন্ত অবস্থায় ইঞ্জিন–বগি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ঘন ঘন লাইনচ্যুতির মতো কারিগরি ত্রুটিও দেখা দেয়। আর ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি যেন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সঙ্গে আছে ট্রেনে–স্টেশনে অপরিচ্ছন্নতা, সময়সূচিতে হেরফের, আসনবিহীন ও টিকিটবিহীন ট্রেনযাত্রা, খাবারের বাড়তি দামসহ ব্যবস্থাপনাগত বিভিন্ন সমস্যা।
রেলসেবার মান নিম্ন হওয়ার জন্য দুর্নীতির দায়ও রয়েছে। এটিও দক্ষ ব্যবস্থাপনার ঘাটতিকেই নির্দেশ করে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বাংলাদেশ রেলওয়ের অনিয়ম–দুর্নীতির একাধিক খাতও চিহ্নিত করেছে। সেগুলো হলো সম্পত্তি ইজারা ও হস্তান্তর, অবৈধ স্থাপনা তৈরি, কেনাকাটা, ভূমি অধিগ্রহণ, যন্ত্রাংশ নিলাম, টিকিট বিক্রি, ট্রেন ইজারা, ক্যাটারিং ইত্যাদি। দুর্নীতির কারণে যে রেলওয়ের সেবার মানোন্নয়ন ঘটে না এবং লোকসানও গুনতে হয় তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এসব বিষয়ে বিহিত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।







