রেলের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের ‘লঘুদণ্ড’

মালামাল ক্রয়ে অসদাচরণে দোষী সাব্যস্ত বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি এক বছরের জন্য স্থগিত

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ২২ জুন, ২০২৫ at ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ

রেলের মালামাল ক্রয়ে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় টেন্ডার আহ্বান না করায় অসদাচরণে দোষী সাব্যস্ত করে বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক প্রকৌশলী মো. বেলাল হোসেন সরকারের বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি এক বছরের জন্য স্থগিত করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। গত ১৮ জুন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপন এ আদেশ জারী করেন।

প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, সরকারি ক্রয় কার্যক্রমে নিয়ম লঙ্ঘন, দরপত্র প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব এবং দায়িত্ব পালনে গাফিলতির কারণে এই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলে (রাজশাহী) প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের দায়িত্বে থাকাকালীন মো. বেলাল হোসেন সরকার একাধিক মালামাল ক্রয়ের ক্ষেত্রে তালিকাভুক্ত ১৭৯ ঠিকাদারের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক ওটিএম (ওপেন টেন্ডার মেথড) পদ্ধতি অনুসরণ না করে এলটিএম (লিমিটেড টেন্ডার মেথড) পদ্ধতিতে নিজের পছন্দমতো মাত্র ৬টি প্রতিষ্ঠানকে বেছে নিয়ে টেন্ডার আহ্বান করেন। এই প্রক্রিয়ায় কেনাকাটা নিয়ে ব্যাপক অনিয়মদুর্নীতির অভিযোগ ওঠে।

রেল মন্ত্রণালয়ের তদন্তে সরাসরি দুর্নীতির প্রমাণ না থাকলেও টেন্ডার আহ্বানকারী দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনে গাফিলতির কারণে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ অনুযায়ী তাকে ‘অসদাচরণে’ দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।

যে দুর্নীতির কারণে বরখাস্ত এবং বেতন বৃদ্ধি স্থগিত : ২০১৮১৯ অর্থবছরে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের বিভিন্ন স্টেশনের মালপত্র কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়মদুর্নীতির অভিযোগ উঠে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (সিওএস) বেলাল হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে। অভিযোগের কারণে তখন রেল মন্ত্রণালয় থেকে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির তদন্তে অনিয়ম এবং দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগ পাওয়ার পর ২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর রেলওয়ের তৎকালীন সচিব সেলিম রেজার স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে প্রকৌশলী মো. বেলাল হোসেন সরকারকে বহিষ্কার করে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

পরে তিনি রেল ভবনে যোগ দেন। সর্বশেষ রেল ভবনে রেলওয়ের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা থেকে তিনি সম্প্রতি চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে রেলওয়ের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক হিসেবে যোগ দেন। বর্তমানে মো. বেলাল হোসেন সরকার পাহাড়তলীর রেলওয়ের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন। তার এই দায়িত্ব পালনকালেই গত ১৮ জুন রেল মন্ত্রণালয় ২০১৮১৯ অর্থবছরে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের বিভিন্ন স্টেশনের মালপত্র কেনাকাটায় অনিয়মদুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তার এক বছরের বেতন বৃদ্ধি স্থগিত করে লঘুদণ্ড দেওয়া হয়।

১৮ জুন রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে জারী করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, প্রকৌশলী মো. বেলাল হোসেন সরকার সিওএস, কন্ট্রোলার অব স্টোরস অফিস (পূর্ব), বাংলাদেশ রেলওয়ে চট্টগ্রাম কর্তৃক সিওএস কন্ট্রোলার অব স্টোরস অফিস (পশ্চিম) বাংলাদেশ রেলওয়ে রাজশাহী থাকাকালীন রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের পণ্য ক্রয়ে আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত টিম সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র, ক্রয়কৃত পণ্য এবং বাজার থেকে সরেজমিন সংগৃহীত পণ্যের নমুনার বাজারদর যাচাই এবং পারিপার্শ্বিক বিষয়াদি বিবেচনাপূর্বক তদন্ত করে বেলাল হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম ও দায়িত্ব অবহেলার প্রমাণ পাওয়া যায়।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, যেহেতু তিনি টেন্ডারকারী হিসেবে টেন্ডারের শর্ত মোতাবেক মানসম্মত পণ্য গ্রহণ নিশ্চিতকরণে কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন করেননি এবং যেহেতু অভিযোগনামা ও অভিযোগ বিবরণী এবং অভিযুক্ত কর্মকর্তার লিখিত জবাব, বিভাগীয় মামলা সংক্রান্ত অনুষাঙ্গিক দলিলাদি পর্যালোচনায় এবং ব্যক্তিগত শুনানিতে আনীত অভিযোগ গুরুতর প্রতীয়মান হওয়ায় বিষয়টি তদন্তের জন্য রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে অতিরিক্ত সচিব আ. . ম আশরাফুল আলমকে তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি তদন্ত প্রতিবেদনে জানান, সরাসরি দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ না মিললেও টেন্ডার আহ্বানকারী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ ও প্রক্রিয়াগত অবহেলা সরকারি ক্রয় ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, দায়িত্বশীল পদে অধিষ্ঠিত থেকেও দায়িত্ব অবহেলার কারণে ক্রয় প্রক্রিয়ায় যথাযথভাবে আইন অনুসরণ করা হয়নি, যা সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ অনুযায়ী কর্তব্যে অবহেলা, অসদাচরণ হিসেবে গণ্য।

নথিপত্র পর্যালোচনার পর এবং তদন্ত প্রতিবেদনের মতামতের আলোকে অভিযুক্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮এর ৩() ধারায় অসদাচরণের অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। সেই অনুযায়ী বিধিমালার ৪()() ধারায় তাকে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি পরবর্তী ১ বছরের জন্য স্থগিত রাখার লঘুদণ্ড প্রদান করা যায়।

প্রতিবেদনের শেষ অংশে বলা হয়, বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক মো. বেলাল হোসেন সরকারকে (প্রাক্তন সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক পশ্চিমাঞ্চল, রাজশাহী) তার বিরুদ্ধে আনীত অসদাচরণের অভিযোগে দোষী সাবস্ত্য করে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮এর ৪() বিধিমতে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি পরবর্তী এক বছরের জন্য স্থগিত রাখার লঘুদণ্ড প্রদান করা হলো। এই আদেশ অনুযায়ী, মো. বেলাল হোসেন সরকার স্থগিতকৃত বর্ধিত বেতনের কোনো বকেয়া পাবেন না এবং এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর পরবর্তী বছর থেকে বর্ধিত বেতন প্রাপ্য হবেন।

এ বিষয়ে জানতে গতকাল রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক প্রকৌশলী মো. বেলাল হোসেন সরকারকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশান্তর জোড়া সেঞ্চুরি, ১২ বছর পর গল টেস্ট ড্র
পরবর্তী নিবন্ধসীতাকুণ্ডে গৃহবধূকে পুড়িয়ে মারার অভিযোগ