দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। এদেশে রেমিট্যান্স যোদ্ধা কারা কীভাবে তারা রেমিট্যান্স যোদ্ধা হয়ে উঠে এটা জানতে একটু পেছনে যেতে হবে। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার্থী নয় লক্ষ হলে মাধ্যমিকে গিয়ে সে সংখ্যা ছয় লাখে ঠেকে। মাধ্যমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে সে সংখ্যা দুই লাখে নেমে আসে। যে সকল শিক্ষার্থী মাধ্যমিক থেকে ঝরে যায় এদের একটি অংশ রেমিট্যান্স যোদ্ধা হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। আমাদের রেমিট্যান্স যোদ্ধারা অধিকাংশই স্বউদ্যোগে নিজের প্রচেষ্ঠায় বিদেশ গমন করে। সরকারি (জিটুজি) পদ্ধতিতে খুব কম সংখ্যক বাঙালি বিদেশ যাওয়ার সুযোগ হয়। প্রয়োজনীয় যোগ্যতা দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের অভাবে প্রবাসে বাঙালিরা কায়িক শ্রম ছাড়া অন্য কোনো সম্মানজনক কাজ ভাগ্যে জুটে না। যেভাবেই হোক তাদের অমানবিক পরিশ্রমের বিনিময়ে আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল থাকছে। মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক থেকে প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে যায় এদের মধ্যে কেউ দেশে বিভিন্ন কলকারখানায় চাকরি গ্যারেজে গাড়ির হেলপার সহকারী রিকশা বা ভ্যান চালক বা অন্যকোনো ঝুঁকি পূর্ণ কাজে নিয়োজিত হয়। শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও দেশের বিভিন্ন কাজে শিশুদের অংশ গ্রহণ উল্লেখযোগ্য। ঝরে পড়া রোধে সরকার নানা কর্মসূচির মাধ্যমে চেষ্টা করলেও ঝরে পড়া হার কমছে না। জাতীয়ভাবে শিক্ষার হার বাড়াতে ঝরে পড়া রোধের বিকল্প নেই। তবে শিক্ষা নিয়ে আমাদের লক্ষ্য সে পর্যন্ত পৌঁছেনি। কর্মমুখী শিক্ষার অভাবে উচ্চ শিক্ষা লাভ করেও শিক্ষার্থীরা চ্যালেঞ্জিং বিশ্বে পিছিয়ে পড়ছে। রেমিট্যান্স যেহেতু আমাদের অর্থনীতির একটি সহায়ক শক্তি তাই জাতির বৃহৎ স্বার্থে এ খাতের উন্নয়নে প্রশিক্ষিত দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণ জনশক্তি রপ্তানিকে আরো সমৃদ্ধ করবে। বর্তমান যেসব রেমিট্যান্স যোদ্ধা বিদেশ যাচ্ছে তারা পরিপূর্ণভাবে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে না। প্রবাসীরা যে রাষ্ট্রে যায় সে রাষ্ট্রের চাহিদা অনুযায়ী কাজের অভিজ্ঞতা নেই, নেই দক্ষতা, আছে ভাষা গত সমস্যা, নেই সে দেশের আইন কানুন সম্পর্কে ধারণা, অভাব রয়েছে প্রশিক্ষণের। যার কারণে প্রবাসে গিয়ে বাঙালিদের পড়তে হয় নানা বিড়ম্বনায় যথাযথ জ্ঞান ও ধারণার অভাবে সে দেশের আইন কানুন সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে অপরাধীর তালিকায় বাঙালিরা এগিয়ে থাকে যার বিরূপ প্রভাব পুরো জাতিকে বহন করতে হয়। জাতির উন্নয়ন উন্নতি শিক্ষার উপর নির্ভরশীল। দারিদ্র্য ও পারিপার্শ্বিক কারণে শিক্ষায় ঝরে পড়াদের আত্নকর্মসংস্থানমূলক শিক্ষায় শিক্ষিত করে একটি দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির সুযোগ রয়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশ গিয়ে নিজের যোগ্যতানুযায়ী কাজ খুঁজে নিতে সমস্যা না হয়। দেশে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি ঝরে পড়াদের জন্য কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখবে যা রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির সহায়ক হবে। সঠিক পরিকল্পনার অভাবে জাতিকে উচ্চ শিক্ষিত যেমন করা যাচ্ছে না আবার ঝরে পড়াদের ও দক্ষ জনশক্তিতে পরিনত করা হচ্ছে না। ঝরে পড়া রোধ করতে হলে এর কারণ নির্ণয় করে সমস্যার যথাযথ সমাধান নিশ্চিত করতে হবে নয়তো ঝরে পড়াদের দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করতে তাদের চরিত্র গঠন শৃঙ্খলাবোধ দায়িত্ব ও কর্তব্যনিষ্ঠা, দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধের উপর প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে যেহেতু তারাই জাতির দর্পণ হিসাবে বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার ভূমিকা রাখবে।
প্রবাসীদের কষ্টার্জিত অর্থ আমাদের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে প্রবাসে তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় দেখার সাহায্য সহযোগিতা করার দায়িত্ব যাদের উপর ন্যস্ত বিদেশ বিঁভূইয়ে প্রবাসীরা যাতে অন্য কারো দ্বারা হয়রানির শিকার না হয় এসব যারা দেখবে উল্টো তাদের দ্বারা হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ প্রবাসীদের। দেশে অর্থ প্রেরণে ব্যাংকিং ব্যবস্থা অধিক নিরাপদ এটা জেনেও ব্যাংক ব্যবস্থাপনার নানা জটিলতা ও সময়ক্ষেপণ থেকে বাঁচতে অবৈধ পথে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানো সহজ মনে করে অধিকাংশ প্রবাসী হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠায় বলে দেশে হুন্ডি ব্যবসা প্রসারিত হচ্ছে। ব্যাংকে টাকা পাঠাতে প্রণোদনার সাথে আরো সহজ পদ্ধতির ব্যবস্থা করা যায় কিনা ভেবে দেখতে হবে এবং ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে প্রবাসীদের উৎসাহিত করার প্রচার প্রচারণা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রবাসীরা কর্মক্ষেত্রে দৈব দুর্ঘটনায় আহত নিহত হলে ভিসা সংক্রান্ত জটিলতা ও কাগজপত্র ঠিক না থাকলে যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও মৃত্যুজনিত আর্থিক দাবি দাওয়া আদায় বা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। প্রবাসে কোনো প্রবাসী মৃত্যুবরণ করলে কাগজপত্র সঠিক থাকা সাপেক্ষ তাঁর লাশ দেশে আনতে বিমান বন্দরে তাৎক্ষণিক ৩৫ হাজার টাকা পরিবারকে প্রদান করা হয় এবং পরবর্তী তিন লক্ষ টাকা প্রবাস কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে প্রদান করা হয় এতেও নানা ভোগান্তি হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। যাদের কাগজপত্র যথার্থ সঠিক থাকে না তারা ঐ তিন লাখ টাকা থেকে বঞ্চিত হয়। বিভিন্ন কারণে প্রবাসীরা ভিসাসহ নানা ডকুমেন্টস বিহীন সে দেশের আইনে অবৈধ ভাবে থেকে টাকা পয়সা উপার্জন করে দেশে পাঠায়। যদিও ভিসাহীন প্রবাসীরা সেদেশের জন্য অবৈধ কিন্তু তার প্ররিত অর্থ আমাদের অর্থনীতিকে চাঙা করছে। প্রবাসীদের মৃত্যুজনিত অর্থ যখন প্রবাসকল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রদান করে সে ক্ষেত্রে যাদের ডকুমেন্টস সঠিক নেই তাদের ব্যাপারে মানবিক দৃষ্টিতে বিবেচনা করা যেতে পারে। এবং এ অর্থের অংক নূন্যতম পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ধার্য করা যায় কিনা কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখতে পারে। প্রবাসীদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা রাখলে ও তাদের সেবায় নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট দপ্তরের ছোট বড় কর্মকর্তা কর্মচারীর খবরদারি হেনস্তা প্রবাসীদের মনে দেশ জাতি ও সরকারের প্রতি বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে। এসবের প্রতিবাদ প্রতিকার চেয়েও কোনো সুফল মিলছে না। দেশাত্মবোধের কারণে বিদেশে আসা যাওয়ায় স্বদেশী এয়ারলাইনসের বিমানে ভ্রমণ করবে এটা স্বাভাবিক এখানেও তাদের সাথে প্রতারণা প্রহসন ও বিমাতাসুলভ আচরণ করা হয়। অন্য এয়ারলাইনসের চেয়ে ভাড়া বেশি সিট খালি থাকলেও নেই বলে ঠেকিয়ে অর্থ আদায়ের অভিযোগ প্রত্যেক প্রবাসীর। দেশমাতৃকার টানে সকল প্রকার হয়রানি সহ্য করে ও স্বদেশী বিমানে ভ্রমণ বিষাদে পরিণত হয় বিমান কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম বিমানবন্দরে যাত্রীদের সেবায় নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থার কর্মকতা কর্মচারির নবাবী ঢংয়ের আচরণ চুরি লুটপাট ইত্যাদি। দীর্ঘদিন যাবৎ প্রবাসীরা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসলেও কোনো প্রতিকার হচ্ছে না।
সরকার প্রবাসীদের অবদানকে স্বীকৃতি স্বরূপ তাদের রেমিট্যান্স যোদ্ধা হিসাবে ভূষিত করেন। দেশে–বিদেশে রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের নানা সমস্যা অভাব অভিযোগ নিয়ে নিয়মিত বিভিন্ন মিডিয়ায় সচিত্র প্রতিবেদন প্রচার প্রকাশ হলেও সরকার বিষয়টি আন্তরিকতার সহিত নিয়েছে এমন ভাববার অবকাশ নেই। রেমিট্যান্স যদি আমাদের জাতীয় অর্থনীতির চালিকা শক্তির একটি উৎস হয়ে থাকে তাহলে এ খাতের উন্নয়নে অধিক গুরুত্বসহকারে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে গড়িমসি জাতির অর্থনীতির এক সময়ের হৃদস্পন্দন পাট চামড়া চা এর মত মুখ থুবড়ে পড়বে এতে কোনো সন্দেহ নেই। সময় থাকতে এ খাতের উন্নয়ন উন্নতি সমৃদ্ধি জাতির বৃহৎ স্বার্থে বিবেচনার দাবি রাখে।
লেখক : প্রাবন্ধিক