২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদের নেতৃত্বে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করে। এই সরকারে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পান ফখরুদ্দিন আহমদ। একে ‘ওয়ান ইলেভেন‘ বলে অভিহিত করা হয়। এই সরকার দুই বছর দায়িত্ব পালন করে। এর আগে পাঁচবছর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার পরিচালনা করে। এ সময়ে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ ব্যবস্থা প্রায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। উৎপাদন না বাড়িয়ে খাম্বা বসানোর প্রকল্প ব্যাপক আলোচনা–সমালোচনার জন্ম দেয়।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের জরুরি পদক্ষেপ নিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়। বিনা টেন্ডারে বেসরকারিখাতে এভাবে অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে ওঠার পর বিদ্যুৎখাতে বিপর্যয় ঠেকানো সম্ভব হলেও এ নিয়ে শুরু থেকেই আপত্তি ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে।
জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলায় কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের যে উদ্যোগ পনের বছর আগে নেওয়া হয়েছিল তা যে এখন গলার কাঁটা হয়ে বিধছে তা একাদশ জাতীয় সংসদে প্রদত্ত তথ্য থেকেই সুস্পষ্ট। কারণ, বিদ্যুৎ উৎপাদনে থাকুক বা না থাকুক চুক্তি অনুসারে কেন্দ্র ভাড়া পায় সরকারি বেসরকারি প্রতিটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। যাকে ক্যাপাসিটি চার্জ বলা হয়। সরকার ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিকদের যুক্তি হল কেন্দ্রভাড়া না দিলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী হতো না। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর তিন মেয়াদে টানা সাড়ে ১৪ বছর দায়িত্ব পালনের পর জাতীয় সংসদে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিষদের যে হিসাব পেশ করেছে তাতে দেখা যায়, সরকার সাড়ে ১৪ বছরে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিকদের ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করেছে এক লাখ পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এই সময়ে সরকারের কাছে তাদের পাওনা রয়েছে আরও ২০ হাজার কোটি টাকা। চুক্তি অনুযায়ী পুরো ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয় মার্কিন ডলারে। অপরিকল্পিতভাবে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ক্ষমতা বাড়ানোর কারণে দিতে হয়েছে এই অর্থ। উৎপাদন না করলেও তাদের এই টাকা বসিয়ে বসিয়ে পরিশোধ করতে হয়েছে। আর এ কারণেই ক্যাপাসিটি চার্জে ডুবতে বসেছে বিদ্যুৎ খাত এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্ট খাতের বিশেষজ্ঞদের।
বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা চাহিদার দ্বিগুণেরও বেশি। আর এই অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতাই এখন সরকারের গলার কাঁটা হয়ে দেখা দিয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিপুল সক্ষমতা যেটি তৈরি হয়েছে ততটা বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় না সবসময়ই। বিদ্যুৎকেন্দ্রের একাংশকে বসিয়ে বসিয়ে ভাড়া দিতে হয়।
সংসদে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভাড়ার প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী বিদেশী ও বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর কোনও কোনওটির একাধিক কেন্দ্র রয়েছে। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশের বিদ্যুৎ খাতের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপ তাদের ভাড়া পেয়েছে অন্তত ১৭,৬১০ কোটি টাকা। সামিট গ্রুপের কর্ণধার আজিজ খান সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনীর তালিকায় অন্যতম প্রধান। যুক্তরাষ্ট্রের এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল সাতটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভাড়া পেয়েছে ৮৩১০ কোটি টাকা। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ইউনাইটেড গ্রুপ তারা ছয়টি কেন্দ্রের বিপরীতে ভাড়া পেয়েছে ৭,৭৫৮ কোটি টাকা। চতুর্থ সর্বোচ্চ ভাড়া পাওয়া প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ বিনিয়োগে করা পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র। তারা পেয়েছে ৭,৪৫৫ কোটি টাকা।
রুবেল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপরীতে পেয়েছে ৭,৩২৫ কোটি টাকা। বাংলা ট্র্যেক গ্রুপের মালিকানাধীন পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্র পেয়েছে ৫,৪২৩ কোটি টাকা, ওরিয়ন গ্রুপের মালিকানাধীন পাঁচটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র পেয়েছে ৪,০৮০ কোটি টাকা। ডরিন গ্রুপের সাতটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র পেয়েছে ৩,০৬৬ কোটি টাকা, সামিট ও ইউনাইটেডের যৌথ মালিকানাধীন খুলনা পাওয়ার কোম্পানির তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পেয়েছে ৩,৭৪৪ কোটি টাকা।
এর বাইরে হোসাফ গ্রুপ ২,৮৬০ কোটি ,ম্যাক্স গ্রুপ ২,৩৯১ কোটি, মোহাম্মাদি গ্রুপ ২,৮৩৪ কোটি ,কনফিডেন্স গ্রুপ ২,১৮৫ কোটি, সিকদার গ্রুপ ১,৮৪৩ কোটি, রিজেন্ট গ্রুপ ১,১৭২ কোটি, বারাকা গ্রুপ ১,৬৯৩ কোটি , সিনহা গ্রুপ ১,৪৫৪ কোটি এবং এনার্জিপ্যাক পেয়েছে ১,১১৩ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ।
এর বাইরে রয়েছে আরও বিদ্যুৎকেন্দ্র। কিছু কিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে যেগুলো খুব কম সময় উৎপাদনে ছিল অথচ বিপুল অঙ্কের অর্থ নিয়ে গেছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের এপিআর এনার্জির ৩০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার একটি ডিজেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তিন বছরে নিয়ে গেছে ২,৭৮৮ কোটি টাকা। কেন্দ্রটি বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকত। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জাতীয় সংসদে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধের এই হিসাব পেশ করার পর তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরিকল্পিতভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে মোটা অঙ্কের আর্থিক ক্ষতিপূরণ গুনতে হচ্ছে সরকারকে। দলীয় ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে একের পর এক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা হয়েছে। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য এটা বড় বোঝা। বিদ্যুৎ বিভাগের দূরদর্শী পরিকল্পনার অভাবে সরকারি কোষাগার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে।
বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী ২০০৯ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪,৯৪২ মেগাওয়াট। বর্তমানে ২৩ হাজার ৫৪৮ মেগাওয়াট। কিন্তু গ্রাহক চাহিদা গরম কালে ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ১৮ হাজার মেগাওয়াট এবং শীতকালে সাড়ে ৯ হাজার মেগাওয়াট। অর্থাৎ উৎপাদন ক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎ ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ফলে অলস বসিয়ে রাখতে হচ্ছে সচল বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এজন্য বেসরকারি কেন্দ্রের বিদ্যুৎ ব্যবহার না করেই চুক্তি অনুযায়ী ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ প্রতিবছর সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা করে গচ্ছা দিতে হচ্ছে সরকারকে।
বিদ্যুৎ বিভাগের গবেষণা শাখা পাওয়ার সেল জানিয়েছিল, নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজন নেই। হিসাব অনুযায়ী ২০৩১ সালে দেশে চাহিদা দাঁড়াবে ২৯ হাজার মেগাওয়াট। আর অনুমোদন পাওয়া ও নির্মাণ প্রক্রিয়ায় থাকা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের পর উৎপাদন ক্ষমতা দাঁড়াবে ৪১ হাজার মেগাওয়াটে। এরপরও নতুন নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি হয়েছে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাব এর মতে, কেন্দ্র ভাড়া নির্ধারণ করতে হয় প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে। কিন্তু বাংলাদেশে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুক্তি হয়েছে প্রতিযোগিতা ছাড়া। এর জন্য জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি আইন পাস করা হয়েছে যাতে এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন কোনো আদালতে তুলতে না পারে। এতে কেন্দ্রভাড়া বেশি পড়েছে। বেশি লাভবান হয়েছেন বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা। অন্যদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিপুল সক্ষমতা তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু ততটা বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় না। ফলে সবসময়ই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একাংশকে বসিয়ে ভাড়া দিতে হয়। আর স্বার্থান্বেষী মহলের অতি উৎসাহে রেন্টাল বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের বাড়তি সুযোগ দিতেই চুক্তি নবায়ন করা হয়েছে। বেসরকারি মালিকদের বিনিয়োগ লাভসহ উঠে গেলেও চুক্তি নবায়নের সময় ক্যাপাসিটি চার্জ খুব একটা কমেনি। ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণ করা হয় ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন দক্ষতা বা সক্ষমতার উপর। অভিযোগ রয়েছে, চুক্তির সময় কেন্দ্রের সক্ষমতা কৌশলে বেশি করে দেখানো হয়, যাতে ক্যাপাসিটি চার্জ বেশি হয়। চুক্তিতে যে সক্ষমতা দেখানো হয়, সে অনুযায়ী কেন্দ্রগুলো উৎপাদন করতে পারে না। কিন্তু ক্যাপাসিটি সরকারকে ঠিকই গুনতে হয়।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবারের মত যে সরকার গঠন করছে সেই সরকারের সামনে থাকছে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ। থাকছে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা ফেরানো, বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির মোকাবেলার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের আস্থা অর্জনের বিষয়। তেমনি কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট ও ক্যাপাসিটি চার্জ বিষয়ে জনস্বার্থ অনূকুল সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টিও ভাবতে হবে আর সময়ক্ষেপণ না করে।
লেখক: সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক।