চৈত্র থেকে আষাঢ় পর্যন্ত নদ-নদীতে মশারি জালে শিকার করা হয় গলদা ও বাগদা চিংড়ির রেণু। মূলত সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা ও দরিদ্রতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে একটি রেণু সিন্ডিকেট। যারা প্রশাসনের নজর এড়িয়েই চালাচ্ছে মশারি জালে রেণু শিকারের মহাযজ্ঞ। এক্ষেত্রে প্রশাসনের দুর্বলতাকে দুষছেন অনেকেই।
সম্প্রতি ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, ফেনীসহ দেশের আরও কয়েকটা জেলার উপকূলীয় নদ-নদীতে নির্বিচারে চলছে রেণু শিকার। এ কাজে মশারি জাল ব্যবহারের কারণে প্রতিদিনই ধ্বংস হচ্ছে নানা প্রজাতির মাছের লার্ভা, ডিমসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ভোলার মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীতে প্রজনন মৌসুমে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে অবাধে শিকার করছে বাগদা এবং গলদা রেনু পোনা। প্রভাবশালীদের শত কোটি টাকার বাণিজ্যে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে মাছের শত প্রজাতি। এর ফলে মেঘনায় দিন দিন বিলুপ্ত হচ্ছে দেশীয় প্রজাতির অতি পরিচিত মাছ। নষ্ট হচ্ছে জীব ও বৈচিত্র্য।
এই নিষিদ্ধ রেনু পাচারে জেলায় রয়েছে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা এক শ্রেণির প্রভাবশালী ব্যক্তিদের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। গত ১৭ বছর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নেটওয়ার্কের মূল হোতারা নিয়ন্ত্রণ করেছেন দৌলতখান, বোরহানউদ্দিন উপজেলার হাকীমুদ্দিন, তজুমুদ্দিন উপজেলা ও চরফ্যাশনের প্রায় ৫০টি ঘাট।
তারা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ভোলা থেকে চরফ্যাশন পর্যন্ত মেঘনা পাড়ের ঘাটগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন। প্রায় প্রতিদিন প্রত্যেক আড়তে জমা হওয়া ড্রাম ভর্তি রেনু সংগ্রহ করে রাতের আঁধারে ট্রাক, পিকআপ অথবা ইঞ্জিন চালিত ট্রলারে করে নদী পথে হাত বদল হয়ে পাঠানো হয় যশোর, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। মৎস্য বিভাগ, কোস্টগার্ড ও নৌ-পুলিশ ২/১টি অভিযান পরিচালনা করলেও বন্ধ হচ্ছে না কোটি কোটি টাকার এই রেনুর অবৈধ ব্যবসা।
জানা গেছে, বৈশাখ থেকে আষাঢ় মাসজুড়ে প্রাকৃতিকভাবে ভোলার নদীগুলোতে বাগদা ও গলদা চিংড়ির রেনু পোনার প্রজনন হয়। এসময় রেনু শিকারে রয়েছে সরকারি বিধি নিষেধ। কিন্তু এই বিধি নিষেধ অমান্য করে জেলে, শিশু ও বৃদ্ধ সবাই রেনু শিকারে মশারি দিয়ে তৈরি বিশেষ ধরনের জাল ব্যবহার করে এই রেনু পোনা ধরে তা একটি পাত্রে রাখা হয়। পরে নিখুঁতভাবে বাছাই করে চামচ বা ঝিনাই দিয়ে শুধু বাগদার রেনুগুলো আলাদা পাত্রে রেখে অন্য প্রজাতির পোনাগুলো মাটিতে ফেলে দেওয়া হয়৷ এতে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে চিরচেনা বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা। ধ্বংস হয় জীব ও বৈচিত্র্য। প্রশাসনের নাকের ডগায় চলছে গলদা-বাগদা রেনু শিকারের এ মহোৎসব।
ফেনীর সোনাগাজীতেও দেখা গেছে একই চিত্র৷ উপকূলীয় এলাকায় নদী ও খালে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে চলছে অবাধে চিংড়ির রেণু আহরণের মহোৎসব। প্রতিবছর জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত রেণু আহরণের এ উৎসব পুরো দমে চলে। চিংড়ির রেণু আহরণের জন্য ধ্বংস করা হয় কোটি প্রজাতির মাছের পোনা৷
ফেনী জেলার মানুষ ছাড়াও খুলনা, রংপুর, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা এলাকা থেকে আসা প্রায় দুই হাজার লোক সোনাগাজীর উপকূলীয় এলাকায় অবস্থান করে নদীতে পোনা মাছ আহরণ করছেন। এরা পোনাগুলো স্থানীয় আড়ৎদারদের মাধ্যমে খুলনাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে পাচার করে থাকেন।
এদিকে, বরগুনার নদীর তীরবর্তী এলাকা ঘুরে দেখা যায় রেণু শিকারিদের বেশিরভাগই শিশু-কিশোর। যাদের অনেকেই সিন্ডিকেটের দেয়া দাদনের দুষ্টচক্রে আটকে পড়ছেন।
মৎস্য বিশেষজ্ঞরা জানান, সিন্ডিকেট বন্ধ হলে মিলবে সুফল। রেণু শিকারিদের মধ্যে একজন বলেন, ‘আমরা তো গরিব মানুষ, এজন্য দাদন নিয়ে আমরা এগুলো করি।’
আরেকজন বলেন, ‘মাছ চালান না দিলেই এটা বন্ধ হয়ে যাবে। আর চালান দিলে আমরা মাছ বেচতে পারবো, তা না হলে পারবো না।’
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. সাজেদুল হক বলেন, “ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে যারা চাইল্ড লেবারের মধ্যে পড়বে এবং মহিলাদের কম পারিশ্রমিক দিয়ে রেণু শিকারের প্রলোভন দিয়ে থাকে। আমাদের মৎস্য অধিদপ্তরসহ অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে সঠিকভাবে তদারকি করে এই চক্রকে ভাঙতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “কয়েক ধাপে এই সিন্ডিকেটের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। প্রথমে শিকারিদের কাছ থেকে ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় রেণু কিনে মহাজনের কাছে বিক্রি করেন হকাররা, এরপর পাইকাররা বাড়তি দরে মহাজনদের আড়ৎ থেকে রেণু কিনে সরবরাহ করেন মোকামে।”
অবৈধ রেণু শিকারিদের ঠেকাতে অভিযানে নেমে হামলার শিকার হতে হয় মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তাদের। যার নেপথ্যে থাকে প্রভাবশালী সিন্ডিকেট।
বরগুনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ মহসীন এ প্রতিবেদক’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “এদের মধ্যে পুরুষ-মহিলা সবাই থাকে। তাদের বিরুদ্ধে সবসময় ১০০ ভাগ আইন প্রয়োগ করা মুশকিল হয়ে পড়ে। আমাদের লোকবল স্বল্পতা এর জন্য একটা বাধা।”
জেলার সবচেয়ে বড় মোকামের খোঁজে পাথরঘাটায় যাওয়ার পথেই দেখা যায় মোটর সাইকেলে করে রেণু সরবরাহ করছে সিন্ডিকেটের আরেক সদস্য। তাকে থামানো হলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই হাজির হন চরদুয়ানীর সিন্ডিকেটের হোতারা।
গোপন সূত্রে জানা গেছে, বরগুনায় প্রায় ৩০টির বেশি গদি রয়েছে। আমতলীর পচাকোড়ালিয়ার জালাল, বগীর মো. মতি, নলী এলাকার রহমান সহ তালতলী উপজেলার বামনায় প্রভাবশালীরা গড়ে তুলেছেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট। অন্যদিকে সদরের ফুলঝুরি এলাকায় ঘরে ঘরেই চলে অবাধে রেণু বেচাকেনার কার্যক্রম।
বরগুনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আবদুল হালিম বলেন, “ভালো হলো যে এটা আমরা জানতে পেরেছি। এবার এটা পরিবহনের সাথে কারা জড়িত বা টোটাল সিন্ডিকেটের সাথে কারা জড়িত আছে সেগুলো যাচাই বাছাই করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”