রেডিও : স্মৃতির তরঙ্গে ভেসে থাকা এক যুগ

সনেট দেব | সোমবার , ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ১১:৪৫ পূর্বাহ্ণ

সন্ধ্যার বাতাসে ভেসে আসত মৃদু শোশো শব্দতারপর হঠাৎই কোথা থেকে টুপ করে জ্বলে উঠত এক অচেনা কণ্ঠ। মনে হতো, দূরের কোনো শহর, কোনো পর্বত, কোনো নদীপাড়ের মানুষের সঙ্গে আমাদের লুকানো বন্ধন তৈরি হয়ে গেছে। আমরা চুপ হয়ে বসে থাকতাম, ঠিক যেন এখনই কিছু ঘটতে যাচ্ছেএকটি গান, একটি গল্প, কিংবা কোনো বিচিত্র দেশের সংবাদ। আমাদের ঘরোয়া নীরবতায় রেডিও শুধু তরঙ্গ নিয়ে আসত না, নিয়ে আসত একটি সময়ের ধীর স্পন্দন, এক ধরনের সামাজিক উষ্ণতা, যা আজকের শিশুদের কাছে প্রায় অবিশ্বাস্য মনে হবে।

একসময় যখন বিনোদনের অর্থ ছিল পরিবারকে ঘিরে বসে থাকা, একত্রে গান শোনা, নাটকের সংলাপে হাসা বা কাঁদাতখন সেই ছোট্ট বাক্সটাই ছিল আমাদের বিশ্বজোড়া জানালা। রেডিও ছিল অলস দুপুরের সঙ্গী, আবার ঝড়বৃষ্টির আতঙ্কে অন্ধকার ঘরে একটুখানি সাহসের আলো। আমাদের প্রজন্মের কাছে রেডিও কেবল যন্ত্র নয়এটি ছিল অনুভূতির নাম, স্মৃতির নাম।

রেডিওর কাহিনি শুরু প্রযুক্তির ইতিহাসে এক মহা বিপ্লবের অধ্যায় দিয়ে। ঊনিশ শতকের শেষ দুই দশকেই বিশেষ করে ভারতীয় বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ নিয়ে অগ্রগামী গবেষণা পরিচালনা করেন। ১৮৯৪ সালে কলকাতার টাউন হলে তিনি প্রথমবার প্রদর্শন করেন, কিভাবে অদৃশ্য তড়িৎতরঙ্গ একটি দূরবর্তী রিসিভারকে সক্রিয় করতে পারে। তিনি ধাতব cohererএর পরিবর্তে অজৈব পদার্থের semiconductor-like detector ব্যবহার করেনযা ছিল রেডিও রিসিভারের একটি প্রাথমিক রূপ। পরবর্তী গবেষকেরা, বিশেষত মার্কনি, রেডিওযোগাযোগের উন্নত যন্ত্র নির্মাণে বসুর উদ্ভাবিত ‘ক্রিস্টাল ডিটেক্টর’ প্রযুক্তিকে কাজে লাগান।

১৮৯৫ সালের ৭ মে রাশিয়ান বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার পোপপ্রথমবার বাতাসে ছড়িয়ে থাকা বৈদ্যুতিক তরঙ্গ শনাক্ত করার যন্ত্র প্রদর্শন করেনযাকে আজ ইতিহাস “রেডিও রিসিভারের প্রোটোটাইপ” বলে মেনে নিয়েছে। একই বছর ইতালীয়ইংরেজ আবিষ্কারক গুলিয়েলমো মার্কনি সফলভাবে রেডিও তরঙ্গ প্রেরণ করেন এবং ১৮৯৬ সালে তাঁর প্রযুক্তির পেটেন্ট পান। এই আবিষ্কার কয়েক বছরের মধ্যেই বিশ্বকে বদলে দিল১৯০১ সালে মার্কনি আটলান্টিক সাগরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে প্রথম তারবিহীন সংকেত পাঠাতে সফল হন।

আরও পরে, ১৯০৬ সালের বড়দিনের আগের রাত২৪ ডিসেম্বরকানাডিয়ান উদ্ভাবক রেজিনাল্ড ফেসেনডেন প্রথমবার মানবকণ্ঠে সরাসরি কথা ও সঙ্গীত সম্প্রচার করেন। সেদিনই পৃথিবী প্রথম “রেডিও ব্রডকাস্ট” শোনেযা আধুনিক গণমাধ্যমের জন্ম ঘোষণা করে। রেডিওর এই আবিষ্কার শুধু প্রযুক্তি নয়, মানব সংস্কৃতির পথই পাল্টে দেয়। শব্দ, তথ্য, খবর, গানসবকিছুই এখন বাতাসে ভেসে মানুষের দরজায় পৌঁছত।

বিশ্বজোড়া এই বিপ্লব দ্রুত পৌঁছায় ভারতীয় উপমহাদেশেও। আকাশবাণী (পরে অল ইন্ডিয়া রেডিও) ও আঞ্চলিক সম্প্রচার কেন্দ্র গড়ে ওঠে ধীরে ধীরে। বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে তখন বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি, কিন্তু ব্যাটারিচালিত রেডিও সেট ছিল নানা ঘরে। বেতারের গান, নাটক, খবরগ্রামের সহজসরল জীবনেও বদলে দেয় তথ্যপ্রবাহের ধরণ। বাংলা ভাষার উচ্চারণ, সাহিত্যপাঠ, সংগীত পরিবেশনা, নাটকের উপস্থাপনায় রেডিও একটি নতুন শিল্প রূপ দেয়। খবরের কাগজ যেখানে গ্রামের দূর প্রান্তে পৌঁছাতে দেরি করত, সেখানে রেডিও পৌঁছে দিত খবরের উষ্ণতাপ্রতিদিন, প্রতিক্ষণ।

রেডিও একসময় পুরো পরিবারকে একত্রে বসে থাকার উপলক্ষ ছিল। “সাতটা বাজতে না বাজতেই সংবাদ শুরু হবে”এমন কথায় সন্ধ্যার কাজকর্ম থেমে যেত। গল্পবিচিত্রার নাটক শুনতে শুনতে কেউ কান্না লুকাত, কেউ রূপকথার গল্প শুনে ঘুমিয়ে পড়ত। বিজ্ঞাপনের জিঙ্গল মুখস্থ হয়ে যেত শিশুদের। সেই সময়ের মানুষ জানতশুধু একটি যন্ত্র নয়, রেডিও মানে সময়কে ধরে রাখা। রেডিওর অ্যান্টেনা ঠিক করতে যে উৎসাহ, যে রহস্যআজকের প্রজন্ম কল্পনাই করতে পারবে না। কখনো অ্যান্টেনা জানালার গ্রিলে বাঁধা, কখনো প্লেটের ওপর রাখা, কখনো ছাদে উঠে বাতাসের দিকে তাকিয়ে সিগনাল ধরে রাখাএ যেন শ্রোতারাই নিজেদের মতো করে রেডিও শুনতে শেখার এক প্রাচীন রীতির অংশ।

সময় বদলাচ্ছিল দ্রুত। টিভির আগমন রেডিওর একচ্ছত্র রাজত্বে খানিক শীতলতা আনলেও দুই হাজার সালের পরপরই বাংলার শহুরে তরুণ জীবনে এক নতুন উন্মাদনা ফিরে এলোএফএম রেডিও। শুধু একটি সম্প্রচারপ্রযুক্তি নয়, যেন রাতবালার নিঃসঙ্গতার সঙ্গী, একাকিত্বে ঢেউ তোলা উষ্ণ কণ্ঠ, অচেনা মানুষের গল্প শোনা, গোপন আবেগের জানান দেওয়া এক আশ্চর্য আশ্রয়। এফএম রেডিওর সময়টায় শহরের তরুণরা রাত হয়েই বুঝতএখন কোনো RJ স্টুডিওতে ঢুকে মাইকে বলছেন, “বন্ধুরা, কেমন আছেন?”, আর তারপরে বেজে উঠছে কোনো হারানো প্রেমের গান। প্রেম, বন্ধুত্ব, অভিমান, আড্ডাসব মিলিয়ে FM হয়ে উঠেছিল এক ধরনের সমষ্টিগত শহুরে আত্মা। রাত জেগে পড়া বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রী, অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে ফেরা যাত্রী, চট্টগ্রামঢাকাসিলেটের রাস্তায় রাতভর ট্রাক চালানো ড্রাইভার, ছোট দোকানের মালিককারও দিনের শেষে একমাত্র বিনোদন ছিল এই এফএম রেডিও।

মোবাইল ফোনে যখন ছোট অ্যান্টেনাযুক্ত ইয়ারফোন দিলেই এফএম শোনা যেত, তখন মনে হতোআবার সেই পুরোনো রেডিওদিন ফিরে এসেছে, তবে আধুনিক রূপে। নতুন প্রজন্মের জীবনে “গান, কথা, গল্প, আবেগ” এর এক নতুন নস্টালজিয়া তৈরি হয়েছিল। এফএম ছিল খুব ব্যক্তিগত, খুব আপনএক নিঃশব্দ বন্ধু। কিন্তু প্রযুক্তি কাউকে সময় দিতে জানে না। যে উত্থান ছিল ঝলমলে, সে পতনও ততটাই দ্রুত। ইউটিউব এসে বললনিজের গান নিজেই বেছে নাও। স্ট্রিমিং অ্যাপ বললপ্লেলিস্ট বানাও, যত ইচ্ছে শুনো। ফেসবুক ইনবক্স দিলডেডিকেশন পাঠানোর আলাদা কারণে প্রয়োজন কী? পডকাস্ট বললকোথায় যে, আর কে কখন কথা বলল, তুমি নিজেই ঠিক করে নাও। ফলযে FM স্টেশনগুলো একসময় মধ্যরাতের শহরকে বেঁধে রাখত, সেগুলো একে একে নিভে গেল। মানুষ নিজের সঙ্গ বেছে নিতে শুরু করল, অচেনা কণ্ঠের সঙ্গ নয়। এবং সেই অবলম্বন, যাকে ঘিরে নব্বই ও দুই হাজার দশকের প্রথমার্ধ গড়ে উঠেছিল, তা ধীরে ধীরে হয়ে গেল নস্টালজিয়ার ধূলোমাখা স্মৃতি। আজকের কিশোররা অনেকেই জানে না RJ মানে কী, “ডেডিকেশন” ছিল কেমন এক ম্যাজিক, কিংবা কেন হাজারো তরুণ রাত ১২টার কাউন্টডাউনে FM স্টেশন ধরত। FM রেডিও যেন সেই ট্রেন, যা একসময় সবার যাত্রাপথ ছিল, আর এখন নীরব স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছেযাত্রীহীন, আলোহীন।

আজকের শিশুকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, “রেডিও কী?”-তারা বেশিরভাগই থমকে যায়। কেউ ভাবে এটা হয়তো কোনো পুরোনো যন্ত্র, কেউ বলে-“মোবাইলে তো অ্যাপ আছে না?” তাদের কাছে শব্দের উৎস বলতে বোঝায় স্পিকারের আলো ঝলমলে অ্যানিমেশন, টাচস্ক্রিন আর ইউটিউবের অ্যালগরিদম। তারা জানেই না নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বসে অপেক্ষা করে অনুষ্ঠান শোনার যে এক অদ্ভুত উত্তেজনা ছিলসেটা কীভাবে রাতের নরম বাতাসে মিশে যেত। তারা জানে না পুরোনো রেডিওর শরীরে হাত চালিয়ে ভলিউম বাড়ানো বা ফ্রিকোয়েন্সি মিলিয়ে নিতে নিতে হালকা “ঝিঁ ঝিঁ” শব্দ শোনা কতটা পরিচিত ছিল। জানে না দুপুরের অবসর বা সন্ধ্যার আড্ডা কীভাবে মাত্র দুটি বোতামে সাজানো যেতখবর, গান, নাটক, কণ্ঠনাট্য, গল্প আর মানবজীবনের গাঢ় স্মৃতিগুলো দিয়ে।

আজকের প্রজন্মের কাছে রেডিও ইতিহাস বইয়ের মধ্যেকার একটি অনুচ্ছেদ, হয়তো কোনো জাদুঘরের গ্লাসকেসে রাখা নিঃশব্দ একটি বাক্সকিন্তু বাস্তব অনুভূতি নয়। তারা রেডিওর শব্দে ভেসে আসা গ্রামের বৃষ্টির রাত্রি, শহরের ঘুমহীনতা, স্টেশনের ঘোষণা, কিংবা মোহনীয় কোনো ঘোষিকার কণ্ঠে তৈরি হওয়া দৈনন্দিন মায়াএসব কিছুই চেনে না। রেডিও তাদের কাছে অভিজ্ঞতার নয়, কল্পনার জগত। আমাদের কাছে ছিল জীবনযাপনের নিঃশব্দ সঙ্গীআজ তাদের কাছে শুধুই ইতিহাস।

রেডিও আজ নস্টালজিয়ার বিষয়কিন্তু তার প্রয়োজন আজও অক্ষুণ্ন। দুর্যোগে, ঘূর্ণিঝড়ে, পাহাড়ঘেঁষা অঞ্চলেযেখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক হারিয়ে যায়, রেডিও তখনও থাকে। যখন সব প্রযুক্তি ব্যর্থ হয়, তখন রেডিওই দেয় টিকে থাকার তথ্য। এখনকার প্রজন্ম হয়তো জানে না, কিন্তু রেডিও এখনও বাংলাদেশ বেতার, কমিউনিটি রেডিও আর জরুরি সংকেতের মাধ্যমে দেশের মানুষের পাশে আছে। রেডিও আজ যেন সংগ্রহশালার পুরনো বাদ্যযন্ত্রের মতোস্ক্র্যাচ ধরা শব্দে, অচেনা কোনো কণ্ঠের ভেসে আসায়মানুষকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় এক মন্থর, সরল, অমলিন সময়ে।

রেডিও আমাদের শেখায়সংযোগ শুধু প্রযুক্তির ওপর দাঁড়িয়ে নয়, মানুষের অনুভূতির ওপর দাঁড়িয়ে। যে সময়টায় শব্দ ছিল ধীর, গল্প ছিল গভীর, সংযোগ ছিল মানবিকরেডিও সেই সময়ের প্রতীক। আজ যতই নতুন মাধ্যম আসুক, রেডিওর স্মৃতি মুছে যায় না। কারণ রেডিও আসলে শব্দ নয়রেডিও মানে মানুষের কণ্ঠের উষ্ণতা, রেডিও মানে সময়কে থামিয়ে রাখা এক ক্ষুদ্র মুহূর্ত, রেডিও মানে আমাদের শৈশব, তারুণ্য, পরিবার, রাতের একাকিত্বসবকিছুর মিশ্র সুর। রেডিও হয়তো ম্লান, হয়তো হারিয়ে যাওয়ার পথেকিন্তু তার স্মৃতি এখনো বাতাসে ভাসে। যে বাতাসে একদিন পুরো পৃথিবীর গল্প ভেসে এসে আমাদের ঘরে ঢুকত।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপার্সোনাল ডায়েরি : অবক্ষয়ের খণ্ডচিত্র
পরবর্তী নিবন্ধআহলা চাইল্ড কেয়ার একাডেমিতে চক্ষু ক্যাম্প