দি চিটাগাং কো–অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লি. এর সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহাজাহানের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের স্বার্থে এবার সোসাইটির বর্তমান সম্পাদককে সুনির্দিষ্ট চারটি বিষয়ে তথ্য ও রেকর্ডপত্র সরবরাহ করতে বলেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একই অভিযোগ তদন্তের অংশ হিসেবে মোহাম্মদ শাহাজাহানসহ সোসাইটির ৬ সদস্যকে তাদের ক্রয়কৃত বা গ্রহণকৃত এবং বিক্রয়কৃত বা হস্তান্তরকৃত শেয়ারের রেকর্ডপত্র সরবরাহ করার জন্য নোটিশ দিয়েছে দুদক। নোটিশগুলো জারি করে সার্ভিস রিটার্ন করার জন্য সোসাইটির বর্তমান সম্পাদককে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। এছাড়া ওই ছয়জনের শেয়ার গ্রহণ ও হস্তান্তর বিষয়ে জেলা সমবায় কার্যালয়ের পরিদর্শক অর্পণ দাশগুপ্তের কাছেও তথ্য চেয়েছে দুদক। পাশাপাশি শাহাজাহানের অনিয়ম তদন্তের অংশ হিসেবে একটি প্রকল্পের ক্রয়কৃত জমির রেকর্ডপত্র সরবরাহ করার জন্য সোসাইটির সহকারী ব্যবস্থাপক (ভূমি) মো. শফিকুল ইসলামকে পত্র দিয়েছে দুদক।
গত ২১ অক্টোবর এ বিষয়ে বর্তমান সম্পাদকসহ সংশ্লিষ্টদের চিঠি দিয়েছেন দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম–১ এর সহকারী পরিচালক ও অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা সাঈদ মোহাম্মদ ইমরান। বিষয়টি আজাদীকে নিশ্চিত করেন দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম–১ এর উপ–পরিচালক সুবেল আহমেদ।
এদিকে শাহাজাহানের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অনিয়ম তদন্তে দুই সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছেন জেলা সমবায় অফিসার মো. মোসলেহ উদ্দিন। এতে চন্দনাইশ উপজেলা সমবায়
অফিসার মো. সামসুদ্দিন ভূইয়াকে দলনেতা ও মেট্রোপলিটন থানা সমবায় কার্যালয়ের সহকারী পরিদর্শক সুদীপ দাশকে সদস্য করা হয়। তাদের আগামী ২০ নভেম্বরের মধ্যে ‘বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন’ দাখিল করতে বলা হয়।
জানা গেছে, ২১ অক্টোবর দুদক জেলা সমবায় অফিসারকেও একটি চিঠি দেয়। এতে শাহাজাহানের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। এর প্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠন করে জেলা সমবায় অফিস।
শাহাজাহানের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ : দুদকের ইস্যুকৃত পত্রে মোহাম্মদ শাহাজাহানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে এক হাজার কোটি টাকা মূল্যমানের পরিত্যক্ত সরকারি জমি আত্মসাৎ, জাল–জালিয়াতি ও প্রতারণার আশ্রয়ে শেয়ার কেলেঙ্কারি, মিথ্যা তথ্য ও রেকর্ড সৃজন করে হিসাব খোলা, সমবায় অফিস ও ব্যাংকের যোগসাজশে প্রতিষ্ঠানের হিসাব হতে নিজেরাই টাকা উত্তোলন করে নামে–বেনামে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।
বর্তমান সম্পাদকের কাছে যেসব তথ্য চাওয়া হয় : মোহাম্মদ শাহাজাহানের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ বিষয়ে চিটাগং কো–অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লিমিটেডের বর্তমান সম্পাদকের কাছে বিভিন্ন তথ্য চাওয়া হয়। বর্তমান সম্পাদককে দেয়া পত্রে বলা হয়, সোসাইটির সদস্য চেমন আরা বেগমের স্বামী মৃত মো. রাশেদের (সদস্য নং–১৫০২) ৫টি শেয়ার (শেয়ার নং ৯০৪ থেকে ৯০৮) সোসাইটির অপর সদস্য মোহাম্মদ সাজ্জাদের (সদস্য নং–৩০৩৯) অনুকূলে জাল–জালিয়াতির মাধ্যমে হস্তান্তর করা হয়েছে মর্মে তদন্তে উদ্ঘাটিত হয়েছে। তৎপ্রেক্ষিতে সমবায় সমিতি আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ পূর্বক জেলা সমবায় অফিসারের কার্যালয়কে অবহিত করতে বলা হয়। এ বিষয়ে সোসাইটি কর্তৃক কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তার প্রমাণসহ ব্যাখ্যা প্রদান করতে বলা হয়। একইপত্রে জেলা সমবায় অফিসারের কার্যালয় থেকে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে দেয়া পত্রের মর্মানুযায়ী কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা জানাতে বলা হয়।
দুদকের পত্র সূত্রে জানা গেছে, সোসাইটির খুলশী প্রকল্পের ৪ নং সড়কের ১০৪/সি প্লটের পার্শ্ববর্তী ৭ দশমিক ১৮ কাঠা জমি বরাদ্দ সংক্রান্তে ৩য় যুগ্ম জেলা জজ আদালতে দায়েরকৃত ৭৪৮/২০১০ নং মামলায় সোসাইটির পক্ষে রায় প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে হাই কোর্ট বিভাগে এ বিষয়ে মামলা নং–৬১১/২০১২ দায়ের করা হয়। মামলার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কেও অবহিত করতে বলে দুদক।
এছাড়া সোসাইটির বড়দিঘির পাড় প্রকল্পে জনৈক মায়া রানী দেবীর মালিকানাধীন ১৭ শতক জমি জাল অপ্রত্যাহারযোগ্য পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দলিল মূলে পাওয়ার গ্রহীতা জনৈক মাহবুবুল হকের নিকট থেকে ক্রয় করা হয়। তৎপ্রেক্ষিতে মাহবুবুল হকসহ অত্র ক্রয়ে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সোসাইটি কর্তৃক কোনো আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে কিনা তার ব্যাখ্যা চাওয়া হয়।
পত্র প্রাপ্তির ৫ কার্যদিবসের মধ্যে দুদক যেসব তথ্য ও তৎসংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র চেয়েছে তার সত্যায়িত ফটোকপি সরবরাহের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলে দুদক। এছাড়া বর্তমান সম্পাদককে দেয়া অপর একটি পত্রে অভিযোগের সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে অভিযোগে যুক্ত দি চিটাগং কো–অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লি. এর সদস্যদের নামে ইস্যুকৃত নোটিশগুলো জারি করে অনতিবিলম্বে সার্ভিস রিটার্ন প্রেরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়।
সোসাইটির সহকারী ব্যবস্থাপক (ভূমি) মো. শফিকুল ইসলামকে দেয়া দুদকের আরেকটি পত্রেও ৫ কার্যদিবসের মধ্যে বিভিন্ন তথ্য সরবরাহ করতে বলা হয়। এসব তথ্যের মধ্যে রয়েছে বড়দিঘি পাড়ের খিলপাড়ায় সোসাইটির চতুর্থ প্রকল্পে ক্রয়কৃত জমির তথ্য।
শেয়ারের তথ্য দিতে হবে ৬ সদস্যকে : সোসাইটির ৬ জন সদস্যের নামেও একটি পত্র ইস্যু করেছে দুদক। এতে সোসাইটির সদস্য হিসেবে ক্রয়কৃত বা গ্রহণকৃত এবং বিক্রয়কৃত বা হস্তান্তরকৃত শেয়ারের তথ্য ৫ কার্যদিবসের মধ্যে দিতে বলা হয়। এই ৬ জন সদস্য হচ্ছেন মোহাম্মদ শাহজাহান (সদস্য নং–২৪২০), মোহাম্মদ সাজ্জাদ (সদস্য নং–৩০৩৯), নাসরিন সুলতানা (সদস্য নং–৩১০৮), আব্দুল্লাহ্ আল নোমান (সদস্য নং–৩০০৪), ফাতেমা নুজহাত নাফিসা (সদস্য নং–৪৬৫৬) ও মো. মঈন উদ্দীন খান চৌধুরীর (সদস্য নং–৩৬৪)।
এই ৬ জনের বিষয়ে জেলা সমবায় অফিসের পরিদর্শক অর্পণ দাশগুপ্তের কাছেও বিভিন্ন তথ্য ও রেকর্ডপত্র চেয়ে পত্র দেয় দুদক। এসব তথ্যের মধ্যে রয়েছে তাদের ক্রয়কৃত বা গ্রহণকৃত শেয়ারের পরিমাণ, বিক্রয়কারী বা হস্তান্তরকারীর নাম, বিক্রয়কারী বা হস্তান্তরকারীর অনাপত্তি পত্র পাওয়া গেছে কিনা এবং অস্বাভাবিক বা সন্দেহজনক কোনো শেয়ার হস্তান্তর হয়েছে কিনা তার তথ্য।
পত্রটি সূত্রে জানা গেছে, দি চিটাগং কো–অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লি. এর কতিপয় সদস্যের শেয়ার গ্রহণ বা হস্তান্তর সম্পর্কিত একটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন অর্পণ দাশগুপ্ত। যা পর্যালোচনায় বেশ কিছু অসঙ্গতি পাওয়া যায়।
তদন্ত করে প্রতিবেদন দেবে সমবায় অফিস : জেলা সমবায় অফিসারকে দেয়া পত্রে বিভিন্ন তথ্য ও রেকর্ডপত্র চাওয়া হয়। একই পত্রে বলা হয়, দি চিটাগং কো–অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লিমিটেডের বড়দিঘির পাড় প্রকল্পে ৫ কোটি ৬৩ লাখ ৭৯ হাজার ৪৩৩ টাকা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নিবন্ধকের পূর্বানুমোদন গ্রহণ করা হয়নি এবং উক্ত প্রকল্পে এ যাবৎকালে ব্যয়িত অর্থের হিসাব উদ্ধৃত্ত পত্রে প্রদর্শন করা হয়নি। উপরন্তু সদস্যদের নিকট হতে প্লট বরাদ্দের বিপরীতে প্রাপ্ত অর্থ পুঞ্জীভূত ব্যয় থেকে প্রত্যাহার দেখিয়ে মনগড়া হিসাব উপস্থাপন করা হয়েছে।
এ অবস্থায় ৫টি বিষয়ে পর্যালোচনা করে সমবায় সমিতি আইন, ২০০১ এর ৪৯ ধারা মোতাবেক তদন্ত করে সুস্পষ্ট মন্তব্য ও সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন পত্রপ্রাপ্তির ১০ কার্যদিবসের সরবরাহ করতে বলা হয়। প্রতিবেদনটিতে যেসব তথ্য পর্যালোচনা করতে বলা হয়, সেগুলো হচ্ছে সোসাইটির বড়দিঘির পাড় প্রকল্পে সকল জমির ক্রয় আইনানুগভাবে হয়েছিল কিনা এবং হিসাব বিবরণীর সঙ্গে সমন্বয় আছে কিনা? জমির বাজারমূল্য ও ক্রয়মূল্যের মধ্যে সামঞ্জস্য রয়েছে কিনা? জমির ঠিকাদারি কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও নিয়মানুবর্তিতা ছিল কিনা? জমির বরাদ্দ নিয়মমাফিক হয়েছিল কিনা? (বিগত সরকারের অনেক এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ম বহির্ভূতভাবে বরাদ্দ দেয়া হয়) এবং নিবন্ধকের পূর্বানুমোদন নেয়া হয়েছিল কিনা?












