রুথ সিউপেদি মোতাও আফ্রিকান প্রথম নারী ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফার এবং ফটোজার্নালিস্ট

নারীর ইমেজ, ইমেজে নারী

সাদিয়া মেহজাবিন | শনিবার , ৮ জুন, ২০২৪ at ১১:০৭ পূর্বাহ্ণ

পর্ব

বহু ভাষা ও ঐতিহ্যের সম্মিলনে আফ্রিকা ছিল মানব জাতির আঁতুরঘর। ১৮৮১ সাল থেকে আফ্রিকা উপনিবেশের শিকার হয়ে এসেছে, পরবর্তীতে ঊনবিংশ শতাব্দীতে জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হয় এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই করে। আফ্রিকা রাজনৈতিকভাবে কতটা সফল বা বিফল তা নিরেট আপেক্ষিক। তবে আফ্রিকানরা তাদের নিজেদের লড়াই জারি রেখেছে।

রুয়ান্ডা আফ্রিকা মহাদেশের একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। ১৯৯৪ সালে, পৃথিবী রুয়ান্ডার বিশাল গৃহযুদ্ধ দেখে, যেখানে আট লক্ষের বেশি মানুষ মারা যায়। রাজনৈতিকভাবে বড় দেশগুলোর প্রভাব ছিল বটে। তবে আফ্রিকা সবসময় মানব ইতিহাসে রহস্যের মতো কাজ করেছে। যেকোনো ইতিহাস তার সময়ের সাথে মজবুত ও সত্য হয়ে উঠে তার যথাযথ নথিভুক্তির মাধ্যমে। ইতিহাস সর্বদা সত্যের কথা বলে তা নয়, ইতিহাসে যা কিছু সত্য তা কেবল এই কারণেই সত্য যে, তার যুক্তিযুক্তভাবে নথি করা হয়েছিল বলে। এক্ষেত্রে ডকুমেন্টশনে ফটোগ্রাফি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে বলা যায়।

মালি এন্ড গার্ডিয়ান’ পত্রিকা ১৯৯৩ সালের দিকে ডকুমেন্টারি ফটোজার্নালিস্ট হিসেবে একজন নারীকে নিয়োগ দেয়। গার্ডিয়ান হয়তো হরহামেশা পত্রিকায় যে ছবিগুলো আসে, সেসবের জন্যেই নিয়োগ দিয়েছিলেন। কিন্তু সে প্রথা ভেঙ্গে ছবিগুলো হয়ে উঠে আরেকটু আলাদা, মানুষের ব্যক্তিগত সরল অভিব্যক্তি ফুটে উঠে তাতে। কেবল শাটার চেপে ক্লিকের পর ক্লিক না করে, মানুষের সাথে যথাযথ সময় কাটানো, তাদের মনের কথা শোনা, তাদের অনুমতি নেওয়া এবং নিজস্ব এক সম্পর্ক স্থাপনই পরবর্তীতে ছবিগুলোকে আপন পরিচয় দেয়। এই কাজটি যথেষ্ট নিষ্ঠার সাথেই করেছিলেন রুথ সিউপেদি মোতাও। যিনি আফ্রিকার ইতিহাসে প্রথম নারী ডকুমেন্টারি ফটোজার্নালিস্ট।

ইমেজ স্বয়ং বেশ নির্বাচনধর্মী। একই ব্যক্তির ছবি ভিন্ন আলোকচিত্রীর ক্যামেরায় ভিন্ন। এতে যে কেবল আলোকচিত্রীর দেখার চোখ তথা জ্ঞানই কাজ করে তা নয়, যার ছবি তোলা হচ্ছে তার সাথে আলোকচিত্রীর সম্পর্কও ইমেজে ফুটে আসে। যত বেশি নিবিড়, সৎভাবে সম্পর্ক স্থাপন হয়, ইমেজ তত বেশি হয় আকর্ষণীয় এবং জীবন্ত। এক্ষেত্রে ছলছাতুরীর জায়গা কম, ঊনিশবিশে ধরা পড়বে প্রত্যেক রেখা।

আফ্রিকার রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থা রুথের ছবির অন্যতম বিষয়। আফ্রিকায় দীর্ঘকাল উপনিবেশের প্রভাব এবং মানুষের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন তাঁর কাজে নানানভাবে প্রকাশ পায়। যুদ্ধময় পৃথিবীতে খাবারের হাহাকার। শিশুকাল থেকে খাবারের লাইনে দাঁড়িয়ে প্রতীক্ষা, খাবার ফুরানোর আগেই এই যুদ্ধে জয় হতে হবে। এক টুকরো বনরুটিতে সকলের নিঃশ্বাস আটকে থাকে, সময়ের আগে দম ফেললেই যেন উবে যাবে। টানটান উত্তেজনার তুঙ্গে শিশুরা পড়ছে, মধ্যবিত্তের জন্যে পড়াশোনা ব্যতিরেকে কোনো উপায় নেই। পড়াশোনা চালাতে দৈহিক পরিশ্রমে আনতে হয় খুচরা পয়সাও। সবই যেন আফ্রিকার অমাবস্যার বর্ণনা। কিন্তু এ কোনো রূপকথা নয় স্বয়ং ফটোগ্রাফিক দলিল। ‘চিলড্রেন’ সিরিজে ৪১ টি ইমেজে এভাবেই রুথের কাজ পৃথিবীকে ভাবাতে বাধ্য করে।

১৯৯৪ সাল ছিল আফ্রিকার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ একটি সাল। মানুষের ন্যায্য দাবি পূরণের একটি আশার আলো ছিল ১৯৯৪ সালের নির্বাচন। নারীপুরুষ সকলেই নির্বাচনের ভাবনায় মগ্ন। নারীদের উৎকণ্ঠার শেষ নেই, তবে কতটা তীব্র সেই যাতনা তার প্রমাণ মেলে রুথের ‘ইলেকশন ১৯৯৪’ সিরিজের কাজে। চোখেমুখে মানুষের অন্তরের যে বিভীষিকা তা স্পষ্ট দেখা মেলে, এতেও রুথ তাঁর বিষযবস্তুকে সম্মান করেছে, তাঁর বেদনায় সামিল হয়েছে।

আফ্রিকায় ইউরোপিয়ানদের আগমন ঘটে খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচারের মধ্য দিয়ে। তাঁরা ধর্ম প্রচারের পাশাপাশি ভূমি দখলের কাজেও লিপ্ত হয়। এছাড়া নিজেদের কৃষ্টিতে খ্রিষ্টান ধর্মের প্রচার এবং প্রভাব উভয়ই আফ্রিকাতে এক নতুন জোয়ার আনে। সেসময় খ্রিষ্টান মিশনারি চার্চ, পোপ এবং আফ্রিকার সাধারণ জনগণের ভূমি সংক্রান্ত ত্রিকোণীয় যে দ্বন্দ্ব তার ডকুমেন্টেশন ধরা পড়ে রুথের ‘রিলিজিয়নস এন্ড রিচ্যুয়ালস’ সিরিজে।

সাদা কাগজে লেখা, সরিয়ে নাও সব বৈষম্য, অন্যায়, বর্ণবাদ, দাসত্ব। কারো ছোট চুলের পিঠে লেখা সরকারি দাসদের থেকে মুক্তি দাও, কেউবা কাগজে বড় হরফে লিখে এনেছেন ‘আমাদের চাকরি ফিরিয়ে দাও’। মুক্তির সংগ্রামে নারীদের এই আন্দোলন চিরাচরিত, সংগ্রামের মাধ্যমেই নারীদের অধিকার আদায় হয়েছে যুগেযুগে। সন্তানকে পিঠে চেপে পাড়ি দিতে হয়েছে বহু পথ, কিংবা রান্নার হেঁশেলে নিজের শেষ সময়টুকু। নারীদের মুক্তি, যুদ্ধ, পরিশ্রম সব কিছুর মিশেলে ১৮ টি ছবি নিয়ে ‘ওমেন’ সিরিজ রুথের কাজের তালিকায় অন্যতম স্থান পেয়েছে। রুথ একজন নারী যেমন, একজন মানবিক মানুষ হিসেবেও নিজেকে পরিচয় করিয়েছেন প্রত্যেকবার। পৃথিবীকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, উপনিবেশের পরেও মুক্তি আসে, অন্ধকারের পরেই আলো মেলে।

সাধারণ মানুষ মূলত অসাধারণের মাপকাঠি। যে মানুষ যত বেশি সহজ, স্পষ্ট, সৎ তারাই সাধারণ রূপে অসাধারণ। মানুষের প্রতি মানুষের যে মানবিক দৃষ্টিকোণ তার অন্যতম প্রতিচ্ছবি মানুষ স্বয়ং নিজেই। তবুও কালের পাত্রে সহজকে ভালোবাসি বলে, আমরা কেউই সহজকে টিকিয়ে রাখিনি, যতভাবে দুঃশাসন করা সম্ভব মানুষই তা করে দেখিয়েছে, তা হোক প্রকৃতির ওপর কিংবা সাধারণ প্রাণের ওপর। পরবর্তীতে মানুষই বলছে, তোমাদের সকল হিংস্রতা নিয়ে দূর হও, আমাদের এই জাতি থেকে দূরে গিয়ে মরো। সাধারণ মানুষের সব অব্যক্ত কথা, অনুভূতি, চাহনিকে ইমেজে রূপ দিয়েছে রুথ। ‘অর্ডিনারি পিপল’ সিরিজে রুথকে বিমূর্তভাবে আবিষ্কার করার সুযোগ হয়। মানুষের আবছা ছায়া খেলা কিংবা কাজের ফাঁকে তার বিমূর্ত ভাবনাকে জাগিয়ে রাখে, রুথ সেসবের অন্তর কথাই ইমেজের গল্পে বলে গেছেন। আপাতত রুথ একজন নাগরিক, আফ্রিকার মুক্তির সংগ্রামে একজন যোদ্ধাও।

এতসব যুদ্ধের পরেও মানুষ হাসে, কারণ দুঃখ কেউ বয়ে নেয় না, ভাবনাগুলো যতই কঠিন হোক, মানুষের কাছে নিজেকে ভালো রাখাটাই মানব ইতিহাসে মুখ্য। কেউই দুঃখী হতে চায় না, সুখের লোভে আপ্রাণ চেষ্টা থাকে। সেসব ছবিও রুথ তুলেছেন, ডকুমেন্টেশনে রেখেছেন মানুষের এই জটিল সব অভিব্যক্তি। ‘পোট্রেট’ সিরিজে সেসব মুখচ্ছবিকে বিশেষ জায়গা দিয়েছেন।

তবে এটি অকপটে যেকেউ স্বীকার করতে বাধ্য, রুথ সিউপেদি মোতাও একজন রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ফটো জার্নালিস্ট। যার প্রত্যেক কাজের মূলে মানুষ এবং মানুষের অধিকারের লড়াই প্রকাশ পেয়েছে। মানুষের অসহায়ত্ব এবং করুণ পরিণতির পেছনে রাজনৈতিক জালের প্রতিটি বুননকে রুথ সামনে এনেছে। ‘হোস্টেল এসে’, ‘অন এসাইনমেন্ট’, ‘মিউজিক এন্ড কালচার’, ‘ পেনশনিয়ার’, সহ বহু কাজে তাঁর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রকাশ ছিল।

১৯৬৮ সালে জন্ম নেওয়া রুথ বর্তমানেও কাজ করে যাচ্ছেন সমান তালে। আফ্রিকার প্রথম নারী ফটো এডিটর তিনি, কাজ করেছেন জোহান্সবার্গে এডভান্স ফটোজার্নালিজমের একজন অভিজ্ঞ শিক্ষক এবং ট্রেইনি হিসেবেও। ‘ওমেন ইন ফটোগ্রাফি’, ‘চিলড্রেন’, ডেমোক্রেসি’স ইমেজেস’, ‘ব্ল্যাক লুক হোয়াইট মিথস’ এর মতো প্রদর্শনীতেও রুথ তার জাতির সংগ্রামের গল্প বলেছেন। এছাড়া অনলাইন প্ল্যাটফর্মেও রুথ বিশেষভাবে পরিচিত। ‘ফটোগ্রাফি লিগ্যাসি প্রোজেক্ট’এ রুথের সকল সিরিজের সুন্দর উপস্থাপন হয়েছে। ‘লাইফ ইন ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট’ শিরোনামে সিটি প্রেসের ইউটিউব চ্যানেলে রুথের সাক্ষাৎকার রয়েছে। রুথ জানান, ‘আমার প্যাশনই পরবর্তীতে পেশায় পরিণত হয়। আমি এমন একটা কাজ করতাম যেটার জন্যে আমাকে পারিশ্রমিক দেওয়া হতো কিন্তু আমার দায়বদ্ধতা ছিলো এরও বেশি। আমি জানতাম আমাকে শেখাতে হবে, গল্পগুলো বলতে হবে, পৃথিবীর মানুষকে জানাতে হবে আফ্রিকার বাস্তবতা কি’। রুথের বেশিরভাগ কাজই সাদাকালোতে করা। নান্দনিক দৃষ্টিকোণের বাইরে এর পেছনে তার রাজনৈতিক বক্তব্যও সুস্পষ্ট। ‘আমার মতে সাদাকালোর এক নিজস্ব অভিপ্রায় আছে। এটার একটা যুক্তি বা বক্তব্য আছে, কীভাবে আমি এই পৃথিবীকে দেখি এবং দেখাতে চাই। আমি তাদের দেখতে পাই রঙিন কিন্তু ব্যক্ত করি সাদাকালোতে’।

রুথ তার কাজের শুরু থেকেই খুব সচেতন ছিলেন। নিজেদের লড়াইয়ের গল্পগুলোকে কীভাবে রাজনৈতিকভাবে জোরালো করা যায় সেটির ভাবনা ছিল গাঢ়। রুথ মনে করেন, ক্যামেরা হাতে একজন ফটোগ্রাফারের বিশাল এক শক্তি আছে। সে চাইলেই কি করতে চায়, কীভাবে করতে চায় তার নির্দেশ দিতে পারে এবং একই সাথে সত্য গল্পগুলো বলতে পারে।

রুথ ব্যক্তিজীবনেও কাজের মতোই স্পষ্ট। নিজের খোলামেলা ব্যক্তি জীবনের ছবি নিয়ে ফটোগ্রাফিক সিরিজ করা, সহজভাবে নিজেকে খোলাসা করা ছিল রুথের কাজের অন্যতম তরিকা। তবে রুথের সেসব ছবিকে গুটি কয়েক মানুষই হয়তো ‘সেক্সিস্ট’ উপাধি দেবে তবে মোটেও সেই তথাকথিত হোয়াইট সুপ্রেমেসির ‘সেক্সিস্ট’ ইমেজে রুথ নিজেকে প্রকাশ করেননি। নিজেকে সাবলীলভাবে প্রকাশ করার পেছনেও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে এক লড়াই জারি রেখেছিল।

আফ্রিকার ইতিহাসে রুথ এবং তাঁর ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফ যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তেমনই বৈষম্যের এই পৃথিবীতে রুথ একটি শক্তির নাম, যার কাজ আপনার উঠানে সরাসরি গিয়ে পৌঁছাবে না হয়তো কিন্তু ইতিহাসে লাল হরফে সেঁটে থাকবে। রুথের মতে, ‘আমি যখন কাজ করতাম, তখন একজনও কৃষ্ণাঙ্গ নারী ফটোগ্রাফার ছিল না, তাই হয়তো কেউ আমাকে অতো সিরিয়াসলি নেয়নি কিন্তু আমি যা যেভাবে করতে চেয়েছি, সেভাবেই করেছি। পরবর্তীতে এর ফলাফল ছিল অসাধারণ। আমি সবসময় বলি যারা তরুণ আছো, কাজ করতে চাও তারা খুব দূরে যেও না, নিজের আঙ্গিনায় দেখো, অসংখ্য গল্প খুঁজে পাবে। নিজেকে নিজের মতো প্রকাশ করলেই পৃথিবীকে সঠিক পথে প্রবাহিত করতে পারবে।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রবন্ধের আলপথ ধরে ফেরদৌস আরা আলীম
পরবর্তী নিবন্ধহালদায় ভেসে আসা অজ্ঞাত লাশের পরিচয় শনাক্ত