রিজোয়ান মাহমুদের হাইকো : শব্দ-কল্পনায় পয়মন্ত

ইউসুফ মুহম্মদ | শনিবার , ১৪ অক্টোবর, ২০২৩ at ৫:৪১ পূর্বাহ্ণ

সত্য উচ্চারণে সাহস, সততা ও ধীশক্তি দরকার। এর ব্যত্যয় হলে মূল স্রোত থেকে ছিটকে পড়ার আশঙ্কা থাকে। আর এটা সবাই পারেন না, কেউ কেউ পারেন। যেমন পেরেছিলেন জীবনানন্দ দাশ তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায়। গ্রন্থটি প্রকাশ পায় ১৯৫৪ সালে। তিনি লিখেছিলেন ‘কবিতা অনেক রকম’। কথটি ছোট কিন্তু ব্যাপ্তি বিস্তৃত। এতে প্রকাশ পেয়েছে এক অমোঘ সত্য।

এই সত্যের সন্ধানে লেখক ঘোরেন, ঘুরি আমরা পাঠকরাও; চেষ্টা করি কবি ও লেখকদের চিন্তার অংশী হওয়ার। এ চেষ্টার ফল সম্পর্কে শিবনারায়ণ রায় তাঁর ‘কবির নির্বাসন ও স্রোতের বিরুদ্ধে গ্রন্থেরলেখক ও পাঠক প্রবন্ধে’ (পৃষ্ঠা২০) আমাদের জানিয়েছেন, ‘সাহিত্য আমাদের অনুভূতিকে সুক্ষ্ম করে, আমাদের বোধে গভীরতা আনে, আমাদের বুদ্ধির পরিশীলন ঘটায়, আমাদের বিচিত্র এবং অনেক সময়ে পরষ্পরবিরোধী চিত্তবৃত্তির মধ্যে সঙ্গতি আনে, অভ্যাসের সঙ্কীর্ণতা দূর করে মনুষ্যত্বেও অমিত সম্ভাবনা বিষয়ে আমাদের জাগ্রত করে তোলে। সাহিত্য পাঠে আমাদের মন সরস হয়, আমাদের বিচারে ঔদার্যের সঞ্চার ঘটে, আমরা সব দেশের সব কালের মানুষের সঙ্গে আত্মীয়তা স্থাপনের শক্তি অর্জন করি। সব চাইতে বড় কথা, সাহিত্যসম্ভোগের মধ্য দিয়ে আমরা কিছুমাত্রায় সাহিত্যিকের সৃজনঅভিজ্ঞতার স্বাদ পাই; এবং যেহেতু সৃজনের মধ্যেই মানুষের মুক্তি, সে কারণে মানুষের জীবনে এ অভিজ্ঞতা অমূল্য।’

এ অমূল্য পথে হালে যে ক’জন মহৎ কবির সাক্ষাৎ আমরা পাঠকরা পাই তাদের মধ্যে রিজোয়ান মাহমুদের নামও যুক্ত করা যায়। তিনি কবিতা, হাইকো, রুবাইয়াৎ, গল্প ও প্রবন্ধ লিখে ইতিমধ্যে খ্যাতি অর্জন করেছেন। সম্প্রতি আমাদের হাতে এসেছে তাঁর সনেট গ্রন্থ ‘মুদ্রিত কামনা থেকে’, ‘হাইকো চাঁদের ফ্রক’, ‘এই হাত হাজার দুয়ারি’ ও ‘মীরখানার ফকরি’। তাবে আমরা আজ আলো ফেলবো ‘হাইকো চাঁদের ফ্রক’এর ওপর।

এ গ্রন্থ প্রসঙ্গে বলার আগে হাইকো সম্পর্কে আমরা একটু ধারণা নিতে পারি। হাইকো এক ধরনের সংক্ষিপ্ত কবিতা, যার আঁতুড়ঘর জাপানে। হঠাৎ ঘটিত মনের ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে একটি পদ্ধতি বেছে নেন জাপানের কবি মাৎসু বাসো, সে সপ্তদশ শতাব্দির কথা। বাসোর প্রকৃত নাম মাৎসু কিন্সাকু। তিনি ৩ পঙক্তিতে ৫৫ ফরমেটে মোরাস লিখেন, সব মিলে হয় ১৭ মোরাস। মোরাস ও মাত্রার মধ্যে কোনো সাযুজ্য নেই। হাইকোতে ভাবনার চিত্ররূপ অঙ্কন করা হয়। ইউরোপীয় কবিরা এ ১৭ মোরাসকে ১৭ দল ভেবে হাইকো রচনা করেছেন। ইমেজিস আন্দোলনের পর এতে তারা আরো পরিবর্তন আনেন এবং ১৭ অক্ষরের পরিবর্তে আরো বেশি অক্ষরে হাইকোকবিতা লেখা শুরু করেন। এভাবে বহু উদাহরণ ভারাক্রান্ত করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়, তাই আমরা সরাসরি রিজোয়ানের হাইকো আলোচনায় যেতে পারি।

রিজোয়ান মাহমুদের হাইকো পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছে শব্দকুশলতায় তিনি সৎ ও নির্মোহ থেকেছেন। এ চারিত্র্য তাঁর কাব্য পাঠেও বিবেচ্য। হাইকো রচনার ক্ষেত্রে তিনিও জাপানী ঘরানা অনুসরণ করেছেন। কবি নিজেকে নতুনরূপে আবিষ্কার করেন তাঁর লেখায়। সাথে সাথে প্রকাশের বিষয়টিও মুখ্য হয়ে ওঠে। শিল্পীর সাধনা গ্রন্থে ‘লেখকের শিল্পকৌশল’ প্রবন্ধে (অনুবাদ: আবু জাফর সামসুদ্দীন) আঁদ্রে মরোয়া বলেছেন, “… লেখক নিজেকে প্রকাশ করার প্রেরণা বোধ করে থাকেন; কিন্তু তাঁর প্রকাশভঙ্গী কালে কালে পরিবর্তন লাভ করে। ষোড়শ শতাব্দীতে জন্মালে, ভালেয়া রচনা করতেন গাথাসঙ্গীত; ত্রয়োদশ শতাব্দীতে জন্মালে রচনা করতেন রহস্যঘন নাটক। মূলত কলা এবং ধর্মের উৎস এক। ধর্মগ্রন্থ এবং মহাকাব্যের মধ্যে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। বাইবেল একটি মহাকাব্য। হোমার ছিলেন ধর্মীয় কবি। গ্রীক জাতির পুরাণস্রষ্টা তিনি।’ মরোয়ার সাথে সুর মিলিয়ে বলা যায় রিজোয়ান বাংলা কবিতা ও রুবাইতে নতুন কাব্যধারা ও চিন্তার সূত্রপাত করেছেন। এতে তিনি বিষয়বৈচিত্রে যেমন পরিবর্তন এনেছেন তেমনি দক্ষ শিল্পীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বাংলাদেশের কাদামাটির সোঁদা গন্ধ অঙ্কন করেছেন । তাঁর হাইকোয় আমরা প্রেমপ্রকৃতির পাশাপাশি দেখতে পাই সময়ের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ কার্যকারণের বিচিত্র উপস্থাপন। দেশ, সমাজ, সমাজের পাঙ্খিলতা ও সাম্প্রতিক সময়ে সারা পৃথিবীকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়া করোনা প্রসঙ্গও তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। পাঠক কয়েকটি হাইকোয় প্রবেশ করলেই আমাদের কথার সত্যতা প্রতিফলিত হতে পারে।

সসার আসে/ দাপুটে অ্যালিয়ন/ মনুষ্যক্ষয়’ ()। ‘সুুদবাজারে/ চাকতির খেলাড়ু/ অভিভাবক’ (১০)

এ দুটি হাইকো বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ ও অনুপ্রাস নিয়ে কবি আমাদের সামনে খুলে দিয়েছেন চিন্তার নতুন দিগন্ত। তিন সংখ্যক হাইকোতে রিজোয়ান বিজ্ঞানীদের অনুসন্ধানের সাথে সুর মিলিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, সসারে যদি সত্যি একদিন মানুষের চেয়ে বুদ্ধিমান কোনো প্রাণি পৃথিবীতে আসে তাহলে মানুষের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে কিনা! ‘মনুষ্যক্ষয়’ শব্দটি ব্যবহার করে তিনি আরো দূরবর্তী সংকেত দিচ্ছেনতাই যদি হয় তাহলে পৃথিবী নামক গ্রহে মানুষ বেঁচে থাকতে পারবে কি? ক্ষয় হোক, তবু মানুষ বাঁচে। আশায় বুক বাঁধে সোনালী ফসলের স্বপ্নে। মানুষের এই পথ চলা অক্লান্ত। তাঁর হাইকোতে কবি এই বলে আমাদের প্রাণে রসের সঞ্চার করছেন যে, ‘বাগানে ফুল/ফেনায়িত মুরলী/বাতাস কাঁদে’ ()। এই আশা ও রস আমাদের মজ্জাগত, মননের গভীরতম সত্তার উপলব্ধিতে এই মুরুলী সুর তোলে। যার কারণে ‘বাতাস কাঁদে’। তাই তো তিনি বুদ্ধ ধর্মের একটি ধী গোষ্ঠী জেন এর প্রয়োগ করে উচ্চারণ করতে পারেন ‘জেনের শ্বাস/ঘুঙর অনুপ্রাস/বাজনা বাজে’ ()। এই বাজনা ও বাঁশির কান্না এক হয়ে যায় সমম্বিত বোধ ও রসে। এখানে আমরা তত্ত্ব ও তথ্য এ দুয়ের অমৃতে সিক্ত হচ্ছি। তাই যারা বলেন, তত্ত্বতথ্যঋদ্ধ হলে কবিতার শ্রী হানি ঘটে তাদের সাথে এখানে আমি সম্পূর্ণ একমত হতে পারছি না। কবিতা সুধার ধারায় ভাসাতে পারে আবার দৃষ্টিসুভব এবং মননেরও হতে পারে।

প্রকৃতি ও তার রূপবৈচিত্র্যে মুগ্ধ অনেকেই হন। কিন্তু কবির দৃষ্টিবাহিত প্রাকৃতিক মূর্তি হৃদয়উত্তিত সংরাগে মথিত ও রক্তিম হলে সৃষ্টি হয়, ‘হাইকু রাত/আমার অপরাধ/বৃষ্টির ফোঁটা’ (), ‘সুজুকি নেই/বাশো ডাকে পুকুরে/ শব্দহীনতা’ (), ‘নোনতা চাঁদ/ ক্ষয়িষ্ণু পাগলেরা/ আকাশ খোঁজে’ (), ‘আষাঢ় তুমি/ শ্রাবণের সুরভি/ ভাদ্রের কণা।’ (১৮) যে কণা নির্মাণ করে কবির বিশ্বাস। নতুন প্রেরণায় উজ্জিবীত রিজোয়ান কবিতার মুহূর্তকে ধরতে পারেন ক্ষুদ্রচিত্রপটে। প্রতিমার পর প্রতিমা নির্মাণ করতে পারেন ছন্দের সুনিপুণ বিস্তারে। এ পথে নীলকণ্ঠ কবি উজ্জীবনের বিচ্ছুরণে হৃদয়ের সেতার বাজান এই বলে, ‘দেহের বীণা/ বিছানায় বাজছে/ প্রিয়বরেষু’ (২০)। ‘সাপ সঙ্গমে/নিঃশ্বাসের রেণুকা/ করালগ্রাসে’ (২১)। ‘মাঝির ক্ষত/ নিঃসঙ্গতা তোমার/ তীরের জল’ (২২)। ‘রাখাল জানে/ হৃদব্যথা বাঁশির/ অন্তর্দহন’ (২৪)। প্রেম মথিত আবেগ ও অনুভূতির তীব্র দহনে বহ্নিমান রিজোয়ান ভাষাকে এখানে নানা বসনে সাজিয়েছেন ভাব ও শব্দ বিন্যাসে। ক্ষুদ্র পঙক্তির আড়ালে তিনি সতর্ক চেতনায় নির্মাণ করেছেন বিপুল রোমাণ্টিকতা।

রিজোয়ান মাহমুদের মরমি চিন্তাও নতুন সুষমায় উদ্ভাসিত হয় যখন তিনি বলেন, ‘শবেবরাত/ ভাগ্যলিপি খুলছে/ মরমি টানে’ (২৩)। প্রেম, প্রকৃতি ও মরমি চিন্তার উদ্বোধন ঘটিয়ে তিনি আমাদের মনে করিয়ে দেন মানুষ শ্বাশত নয়। তবু মানুষ বাঁচতে চায়, আশায় পথ হেঁটে বপন করেন জীবনের সোনালী ফসল। মানুষের সফর এখানে অক্লান্ত। এ হচ্ছে আমাদের চিন্তা ও সংসার চর্চার স্বভাবগত সত্তা। কিন্ত মানুষকে তিনি ‘কবর পাখি/ ডাকে না বৃক্ষশাখা/ পাপের ঝিলে’ (১০০) বলে সতর্ক করে দেন। কথিত আছে যে মৃতব্যক্তিকে কবরে শায়িত করার পর দুজন ফেরেশতা এসে কিছু প্রশ্ন করবেন। মুনকারনকির নামের এ ফেরেস্তাকে তিনি কবরের পাখি রূপে কল্পনা করেছেন এবং আমাদের চিন্তাসূত্রকে প্রসারিত করেছেন বহুদূর। তাঁর হাইকো আপাতকঠিন মনে হলেও এগুলো পাঠে আমরা সময় ও পথ সম্পর্কে ধারণা পাই, আমাদের উপলব্ধি সূক্ষ্মতর। আমাদের মন সজাগ, রসপূর্ণ ও সমৃদ্ধ হয়; শব্দ ও ভাবের সাথে আত্মীয়তা করা হয়ে ওঠে সহজতর। তাছাড়া মনকে ভিজিয়ে নিতে পারি কল্পনার অতল দীঘির জলে। জীবনের মানবিক সৌন্দর্যকে পৌঁছাতে পারি কাঙ্ক্ষিত উচ্চতায়।

লেখক : কবি

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাসেল ফিরে আসে বাঙালির মনে ও মননে
পরবর্তী নিবন্ধবাংলাদেশ, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া