রাসায়নিক শিল্পপার্ক ও প্লাস্টিক শিল্পনগরী গড়ে তোলার কথা ভাবতে হবে

রেজাউল করিম স্বপন | মঙ্গলবার , ৩ অক্টোবর, ২০২৩ at ৪:৩৯ পূর্বাহ্ণ

বড়ই বিচিত্র এই দেশ! যেখানে ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকায় গড়ে ওঠা প্রায় প্রতিটি বহুতল ভবনে একই সাথে রয়েছে গোডাউন, মার্কেট, কারখানা, অফিস ও আবাসিক ফ্ল্যাট। আর সেই ভবনটি যদি হয় পুরান ঢাকায়, তবে আপনি নিশ্চিতভাবে বলতে পারেন, সেই ভবনের বেসমেন্টে রয়েছে কোনও না কোনও রাসায়নিকের গুদাম। অর্থাৎ সেই ভবনটির দাঁড়িয়ে আছে বোমা জাতীয় পদার্থের ওপর, যেটি যে কোনও সময় বিস্ফোরিত হয়ে মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে। এই রকম একটি ভয়াবহ প্রাণঘাতি অবস্থার মধ্যে দিয়ে চলছে পুরান ঢাকার জনগণের দৈনন্দিন জীবন। এটি কোনও কল্পকাহিনি নয়, আমাদের রাজধানীর পুরানো ঢাকার বাস্তবতা এটি। স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও আমরা রাসায়নিক ও প্লাস্টিক শিল্পের জন্য আলাদা কোনও স্থানের ব্যবস্থা করতে পারিনি। যা সত্যি লজ্জা ও হতাশার।

রাজধানীর চুড়িহাট্টায় এই ধরনের একটি ভবনে ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ভয়াবহ আগুন লাগে। এতে ৭১ জনের মৃুতু হয়। ওই ঘটনায় গঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে রাসায়নিকের গুদাম থেকে আগুনের সুত্রপাত বলে জানানো হয়। ওই কমিটি তখন জরুরি ভিত্তিতে পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকা থেকে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক গুদাম বা কারখানা সরিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করে। চুড়িহাট্টার সেই আগুনের পর সরকার রাসায়নিক শিল্পপার্ক তৈরির উদ্যোগ নেন এবং দ্রুত রাসায়নিক গুদাম সরানোর লক্ষ্যে দুটি অস্থায়ী গুদাম নির্মাণের উদ্যোগ নেন। যার একটি টঙ্গীতে বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের (বিএসইসি) ৬ একর জমিতে। অন্যটি ঢাকার শ্যামপুরে ঢাকা নারায়ণগঞ্জ সড়কের পাশে বাংলাদেশ রাসায়নিক শিল্প সংস্থার (বিসিআইসি) মালিকানাধীন উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরির জমিতে। দুটি অস্থায়ী গুদাম তৈরির জন্য ব্যয় ধরা হয় ১৬৮ কোটি টাকা। অস্থায়ী গুদাম তৈরির ১০ মাসের প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ২১ নভেম্বর। করোনাসহ বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। তবে এ বছরের জুলাই মাসে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিসিআইসি আনুষ্ঠানিকভাবে শ্যামপুরের গুদাম বুঝে পায়। শ্যামপুরে ৬ একর জায়গায় মোট ৫৪টি গুদামঘর গড়ে তোলা হয়েছে। একেকটির আয়তন ১ হাজার ৪৪৪ বর্গফুট। তবে গুদাম ছাড়াও অফিস কক্ষ ও অন্যান্য স্থাপনা মিলিয়ে মোট ২ হাজার ৫৬ বর্গফুট জায়গার ভাড়া দিতে হবে ব্যবসায়ীদের।

এরপর গত ১৯ জুলাই বিসিআইসি এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ২ বছরের জন্য গুদামের ভাড়া ও অন্যান্য শর্তের কথা জানায়। তাতে ২৪ আগস্টের মধ্যে আবেদন করতে বলা হয়। রাসায়নিক গুদামের প্রতি বর্গ ফুটের মাসিক ভাড়া নির্ধারণ করা হয় ৭০ টাকা। সে অনুযায়ী একটি প্রতিষ্ঠানকে মাসে প্রায় ১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হবে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ,পানি, নিরাপত্তা সহ অন্যান্য পরিষেবার জন্য আরো ২০ হাজার টাকা বিল দিতে হবে। সব মিলিয়ে মাসে খরচ হবে প্রায় ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। এই ভাড়াকে অনেক বেশি বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। তারা বলেন রাজধানীর অন্যতম বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিলে প্রায় একই সুবিধার ভবনে প্রতি বর্গফুটের ভাড়া ৬০ টাকার আশপাশে। সেখানে ঢাকার এক প্রান্তে অবস্থিত শ্যামপুরে এত বেশি ভাড়া কিসের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়েছে, তা বোধগম্য নয়। অন্যদিকে গাজীপুরের টঙ্গীতে নির্মিতব্য ৫৩টি গুদামঘরের মধ্যে মাত্র ৩১টির অব কাঠামোগত কাজ শেষ হয়েছে, তবে এখনো ব্যবহার উপযোগী হয়নি।

আসলে পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের গুদাম সরিয়ে নিতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ২০১০ সালে। তাও ভয়াবহ একটি অগ্নিকাণ্ডের পর। নিমতলীর সেই আগুনে মারা যান অন্তত ১২৪ জন। কথা ছিল, একটি রাসায়নিক শিল্পপার্ক হবে, যেখানে রাসায়নিক ব্যবসায়ীরা স্থায়ীভাবে তাদের গুদাম সরিয়ে নেবেন। সেই উদ্যোগের পর ১৩ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু রাসায়নিক শিল্পপার্ক এখনো তৈরি হয়নি। তবে শিল্পপার্ক তৈরির আগে রাসায়নিকের গুদাম দ্রুত সরিয়ে নিতে ২০১৯ সালে অস্থায়ী গুদাম তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। সেই গুদাম তৈরি হলেও অত্যধিক ভাড়ার কারণে ব্যবসায়ীরা যেতে রাজি হচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা বলেন, দুটি অস্থায়ী গুদামে ১০৭টি রাসায়নিকের গুদামের স্থান হবে। এতোটুকু জায়গায় তাদের কিছুই হবে না। কারণ, পুরান ঢাকায় ২০ হাজারের মতো রাসায়নিকের দোকান আছে। তারা বলেন, রাসায়নিক ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ কেমিক্যাল মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য আছেন ১ হাজার ৬০০ জন। সংগঠনটির কর্মকর্তারা বলেন, আসলে দরকার রাসায়নিক শিল্পপার্ক। সেই প্রকল্পের গতি খুব মন্থর। একটি বড় দুর্ঘটনা ঘটলে হয়ত আবার তোড় জোড় শুরু হবে।

তবে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে ৩১০ একর জায়গায় বিসিকের স্থায়ী রাসায়নিক শিল্পপার্ক প্রকল্পের কাজ এখন চলমান। এটি বাস্তবায়িত হলে সেখানে ১ হাজার ৮৪৩টি শিল্প প্লট হবে। সেখানে এখন প্লট বরাদ্দের প্রক্রিয়া চলছে। কিন্তু এখনো সেই শিল্পপার্কের মাত্র ৪০% কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

এর আগে ২০০৬ সালে পুরান ঢাকা থেকে প্লাস্টিকের কারখানা সরিয়ে নিতে উদ্যোগ নেয় সরকার। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সমঝোতা স্মারকও সই হয়। এলক্ষ্যে একটি প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১৫ সালের জুলাইয়ে। এ জন্য মুন্সিগঞ্জ জেলার সিরাজদিখানে ৫০ একর জায়গা নির্বাচন করা হয়। প্রকল্পটি ২০১৮ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রকল্প অনুমোদনের প্রায় আট বছর পার হলেও জমি অধিগ্রহণই করতে পারেনি বিসিক।

বিসিক কর্মকর্তারা জানান, জমি অধি গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসনের কাছে ২১৮ কোটি টাকা জমা দিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু স্থানীয়দের বিরোধিতার কারণে জেলা প্রশাসন জমি অধিগ্রহণ করতে পারেনি। এ অবস্থায় মৌজা পরিবর্তনের প্রস্তাব দিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ে আবার সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব পাঠিয়েছে বিসিক।

পুরান ঢাকা বিভিন্ন পণ্যের পাইকারি ব্যবসা বহু পুরনো। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) প্রকাশিত ঢাকার বাণিজ্যিক ইতিহাস বইয়ে বলা হয়েছে, ১৯৬০ এর দশকে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন পণ্যের ব্যবসা হতো। এর মধ্যে রাসায়নিকের ব্যবসা হতো সদরঘাট, ওয়াইজঘাট, মিটফোর্ড রোড, নবাবপুর, বাংলাবাজার, সোয়ারীঘাট ও মতিঝিলে। ব্যবসায়ীরা জানান, এখন মিটফোর্ড, ইমামগঞ্জ, চকবাজার, তাঁতীবাজার, গেণ্ডারিয়া, সিদ্দিকবাজার, আলুবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় রাসায়নিকের ব্যবসা হয়। আর প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবসা হয় চকবাজার, লালবাগ, কামালবাগ, পোস্তা, উর্দু রোড প্রভৃতি এলাকায়।

রাসায়নিক শিল্পপার্ক ও প্লাস্টিক শিল্পনগর প্রকল্প নিয়ে আলোচনার মধ্যেই ২০১৯ সালে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুনে ৭১ জনের মৃত্যু হয়। এরপর আরও বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে, মানুষের মৃত্যু হয়েছে। মানুষের এই মৃত্যু ও দুর্ভোগের কারণ পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের গুদাম সরাতে না পারা। বিষয়টি আবার আলোচনায় এসেছে পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণে ২৪ জনের মৃত্যুর পর। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আশঙ্কা, সিদ্দিকবাজারের ঘটনা রাসায়নিক থেকে না হলেও পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। ঝুঁকি থেকে যাওয়ার জন্য দায়ী সুশাসনের ঘাটতি, জবাবদিহিতার অভাব ও জীবন রক্ষার প্রকল্পে অগ্রাধিকার না দেওয়া। তাই পুরান ঢাকার জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানে অনতিবিলম্বে রাসায়নিক শিল্পপার্ক ও প্লাস্টিক শিল্পনগরীতে এইসব ব্যবসা স্থানান্তরিত হওয়া দরকার। না হয় আরেকটি ভয়াবহ ঘটনা যে কোনও সময় ঘটে যেতে পারে। যা কোনওভাবেই কাম্য হতে পারে না।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল
পরবর্তী নিবন্ধযেরকম দৃষ্টি সেরকম সৃষ্টি