বর্তমান অন্তর্বতীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর তারা বারবার বলছেন তাদের সরকার প্রথমেই দেশ সংস্কার করবেন তারপর একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেবেন। এখন প্রশ্ন হলো দেশ সংস্কার কীভাবে করবেন তারা? এতো বছরের একটি রাষ্ট্রীয় পদ্ধতিকে তারা কি একেবারে বদলাবেন নাকী রাষ্ট্রের কিছু কিছু জায়গায় আমূল পরিবর্তন এনে দেশ সংস্কারের কাজ শেষ করবেন।
একটা বিষয় অত্যন্ত পরিষ্কার যে এসরকারকে কেউ যেহেতু সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়নি এর ফলে তারা চাইলে অনেক সময় পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে পারবেন। এসুযোগে চাইলে দীর্ঘদিন জগদ্দল পাথরের মতো চাপিয়ে দেয়া রাষ্ট্রযন্ত্রের অনেককিছুই তারা পাল্টাতে পারেন। যেহেতু তারা একটি গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছেন এবং তাদের সরকারে সফল গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম নিয়ামক ছাত্র প্রতিনিধিরাও রয়েছেন তারা আন্তরিকতার সহিত কাজ করলে দেশকে পাল্টে দিতে তেমন একটা সময় লাগবে না। তবে সময়সীমা নির্ধারণ করে না দিলেও অন্তর্বতীকালীন সরকার যেহেতু অনন্তকাল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে যেতে পারে না সেহেতু বর্তমান সরকারের উচিত সব কাজে একসাথে হাত না দিয়ে যেসব কাজ করলে সত্যি সত্যি দেশ সংস্কার হবে এবং সাধারণ মানুষও এর সুফল পাবে সেগুলোর ওপর গুরুত্ব দেয়া। প্রকৃতপক্ষে দেশ সংস্কারের প্রথম ধাপেই যদি প্রান্তিক পর্যায় থেকে একেবারে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সুশাসনের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে নিশ্চিত করা যায় তাহলে আইনের কাছে মানুষ সুরক্ষিত থাকবে। বিগত সরকারগুলোর কেউ দেশের সুশাসনের ওপর গুরুত্ব দেয়নি ফলে থানা, কোর্ট, কাচারি সব জায়গায় চলেছে তাদের নিজস্ব গোপন নিয়মে। ন্যায় বিচার বলতে কিছুই ছিল না। বিচার ব্যবস্থাও ছিল এক শ্রেণির বড়লোকদের হাতে। বিচারকরা মনমত রায় না দিলে তাদেরকে প্রত্যাহার বা বদলি করা হতো। মোট কথা দেশের সববিযয়ে রাজনৈতিক প্রভাব ছিলো মাত্রাতিরিক্ত ।
এসব বিষয়ে বর্তমান সরকারকে নজর রাখতে হবে। আইন যদি তার নিজের গতিতে চলতে পারে এবং আইন যদি কোথাও বাধাপ্রাপ্ত না হয় তাহলে দেশে সুশাসন কায়েম হতে বাধ্য। অনেক সময় দেখা যায় কোনো বিষয়ে একটি কোর্ট ন্যায় সঙ্গত রায় দিয়েছে সে রায়ের বিরুদ্ধে অযথাই আপিল করা হয় উচ্চতর আদালতে। আর সেই আপিলের শুনানি হতে হতেই বছরের পর বছর লেগে যায়। এ শুনানি যাতে দীর্ঘসূত্রিতায় না পড়ে তা দেখার দায়িত্ব বিচারকদের। একজন উকিল যাই বলুক না কেনো বিচারকরা যদি তাদের মেধা, মনন এবং ইনসাফ দিয়ে কাজ করে তাহলে কখনই একটি অন্যায় মামলা কোর্টে বেশি দিন টেকে না। এ জায়গাগুলোতে সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে হয়। মূলতঃ সুশাসনের পথে অন্তরায়গুলো চিহ্নিত করা পূর্বক ওসব জায়গাগুলোতে সংস্কারের জন্য হাত দিতে হবে। দেশে সুশাসনে সবচেয়ে প্রান্তিক স্তর হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং মেম্বাররা চাইলে তাদের এলাকাগুলোতে সহজেই সুশাসন কায়েম করতে পারে। তারা তাদের গ্রামগুলোতে কী ধরনের বিচারকার্য পরিচালনা করছে তাও তদারকির বিষয় রয়েছে। তারা কি তাদের বিচারিক ক্ষমতা সবার জন্য সমানভাবে প্রয়োগ করছে? নাকী সমাজে যারা টাকা এবং অর্থ সম্পদের মালিক তাদের বিচার থেকে রেহাই দিচ্ছে তা গভীরভাবে তলিয়ে দেখা উচিত। ন্যায় বিচারের তারপরের স্থর হচ্ছে থানা অর্থাৎ দেশের পুলিশ বাহিনী। পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে এদেশের মানুষের অভিযোগের কোনো অন্ত নেই। অভিযোগ থাকার যথেষ্ট কারণও রয়েছে, এরা প্রথমে জিডি বা এফআইআর করার সময় টাকা, আসামী ধরার জন্য টাকা আবার আসামী ছেড়ে দেয়ার জন্য টাকা, আবার আসামী নাম চার্জশীট থেকে বাদ দেয়ার জন্য টাকা আবার কারো অন্যায় কাজে সহযোগিতার জন্য টাকা। আবার জায়গায় জায়গায় মাসিক চাঁদা, এভাবে করতে করতে এরা জনগণকে অসহ্য করে ফেলেছে, ফলে এ বিভাগটির খুব বড়সড় সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। তারপর উপজেলা কোর্ট, জেলা কোর্ট, হাইকোর্ট সুশাসনের এসমস্ত জায়গাগুলোতে কী পরিমাণ যে ভোগান্তি আছে তা একমাত্র ভুক্তভোগীরা জানে। আশা করছি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিষয়গুলো গভীরভাবে চিন্তা করবেন। রাষ্ট্র সংস্কারের সবচেয়ে প্রধানতম অন্তরায় হতে পারে দুর্নীতি। পূর্ববর্তী কোনো রাজনৈতিক সরকারই আমাদের দেশের রন্দ্রে রন্দ্রে থাকা দুর্নীতিকে কঠোর হস্তে দমন করতে সফল হননি। ওইসময়গুলোতে প্রসাশনিক দুর্নীতির বাইরে নেতা কর্মিরাও দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। অনেকেই হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন উন্নত দেশগুলোতে। এমন জঘন্য এবং দেশবিধ্বংসী অনিয়ম থেকে আমাদের বের হতে হবে সহসাই। কারণ দুর্নীতি দমন করতে না পারলে কখনই দেশের সাধারণ মানুষ শান্তিতে থাকতে পারবে না। দেশের উন্নতিও বাধাগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো থেকে হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বসে আছে দেশের গুটিকয়েক শিল্পপতি। এদের ঋণ আদায় বিষয়ে কিছু বলাও যাচ্ছে না কারণ এরা সবসময় দেশের বড়বড় রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকে। তাছাড়া এদের শিল্পকলকারখানাগুলোর স্বার্থে এদের কিছু করাও যাচ্ছে না। এদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইন প্রয়োগ করে টাকা ফিরিয়ে নেয়া জরুরি। এরা হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিলাসি জীবন যাপন করছে আর একজন কৃষক সামান্য ৬ হাজার টাকার কৃষি ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করতে না পারায় তাকে কোমরে দড়ি বেঁধে পুলিশ নিয়ে যাচ্ছে আদালতে। এটা কী ধরনের আইন। আইন কি তাহলে ধনিদের জন্য একটা আবার গরীবদের জন্য আরেকটা? দেশের এসব বড়বড় ব্যাংক ডাকাতদের আগে ধরুন। তারপর দুর্নীতির সাথে জড়িত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারিদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিন। প্রয়োজনবোধে নতুন করে আইন করুন এসব লাগামহীন দুর্নীতিবাজদের থামাতেই হবে। না হয় দেশ পিছিয়ে যাবে। দুর্নীতির আরেকটি সহজ মাধ্যম হচ্ছে ঘুষ। আমাদের দেশে যেকোনো অফিসে যেকোনো কাজে ঘুষ যেনো নিয়মে পরিনত হয়েছে। ঘুষ ছাড়া এরা কোনো কাজই করে না এসব ঘুষ খোরদের দ্রুত চিহ্নিত করে চাকরি থেকে বহিষ্কার করতে হবে। মূলতঃ যেখানেই দুর্নীতি, ঘুষ দেখা যাবে সেখানে সাথে সাথেই পদক্ষেপ নিতে হবে তাহলেই এসব দুর্নীতিবাজ এবং ঘুষখোরেরা থামবে। আশা করছি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিষয়গুলো বিবেচনা করবেন।
লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক।