নিজেকে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে ভাষা একটি প্রধান মাধ্যম। কিন্তু তৎকালীন সরকার এই অধিকার হরণ করতে গিয়ে বাংলার মানুষের মধ্যে যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিরাজ করছিল তার মূলেই আঘাত করেছিল। বাংলা সংস্কৃতির গৌরবান্বিত এই ঐতিহ্যকে রক্ষা করার জন্য দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এক হয়ে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। একুশের স্মৃতি বয়ে নিয়ে এই সংস্কৃতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আজঅবধি নানা আয়োজন চলেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে যদি আমাদের দেশীয় সংঙ্গীত যেমন জারি, সারি, পল্লীগীতি, লোকগীতি, মুর্শিদী, মারফতী, ভাওইয়া, ভাটিয়ালি ইত্যাদি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয় তখন তারা কেমন যেন নির্বিকার থাকে। এখানে উল্লেখ্য পাকিস্তান আমলে এদেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির নাম হত বাংলায়। আর এখন বেশির ভাগ স্কুল-কলেজের নাম ইংরেজীতে। শিক্ষার মাধ্যমও কেমন যেন মিশ্র। বাংলা কিংবা ইংরেজী কোন ভাষারই সঠিক ও শুদ্ধ চর্চা হয় না। ১৯৫২ সালের এ দিনে আমরা সবাই সত্যিই বাঙালি হয়ে উঠেছিলাম । আমরা যদি নিজেরাই নিজেদের ভাষাকে লালন না করি তাহলে এক সময়ে অন্য ভাষা ও অন্য সংস্কৃতির আগ্রাসনে ধীরে ধীরে বিকৃত ও বিলুপ্তি ঘটতে পারে।
আমাদের দেশের যে সব বিদেশী-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে যেমন- ব্রিটিশ কাউন্সিল, আমেরিকান সেন্টার, আলিয়ঁস ফ্রসেজ ইত্যাদি, সেখানে কর্মরত সদস্যরা তাদের ভাষায় শুদ্ধ ও সুন্দরভাবে কথা বলে। কোনো ধরনের মিশেল অথবা বিকৃত উচ্চারণ তারা ভাবতেই পারে না। একুশের ভেতর আমরা শুধু বায়ান্নর একটি ঘটনাকে দেখি না, অথবা শুধু বায়ান্নর মাধ্যমে মাতৃভাষার অধিকার নিয়ে আমাদের বিজয়ের কাহিনী স্মরণ করি না, একুশের ভেতর দিয়ে বাঙালির অব্যাহত সংগ্রামের রচিত গাথা আমরা দেখি। শহীদ মিনারের সূর্যোলোকে আমরা এক নতুন প্রভাতের আমন্ত্রণ পাই। বহু স্বপ্ন নিয়ে আমরা সেই প্রভাতের অপেক্ষায় থাকি যাতে সব দুঃখ কষ্টগুলো দূর হয়ে আনন্দের ক্ষণগুলো কাছে এসে ধরা দেয়। হয়ত সেই প্রভাত কখন আসবে তা আমরা নিশ্চিত করে জানি না। তবু আমরা প্রতি নিয়তই এই মিনারের কাছে এসে আমাদের স্বপ্নের বিবরণ জানিয়ে যাই। যদিও স্বপ্নের সারিরা বার বার আমাদেরকে নতুন নতুন স্বপ্ন দেখায় তবুও আমাদের কোন ক্লান্তি নেই। আমরা জানি, রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এই শহীদ মিনার আমাদের নতুন আগামীর সাক্ষী। একুশের চেতনা আমাদেরকে আত্মমর্যাদাশীল করেছে। ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’ চিরকালের এ স্লোগান তাই আজও সমহিমায় ভাস্বর, যেখানে ২৪ কোটির বেশি মানুষ এই ভাষায় কথা বলে এবং বাংলা ভাষা বিশ্বের ৪র্থ ভাষা হিসেবে গণ্য সেখানে আমাদের উদাসীনতা বাংলা ভাষার ঐতিহ্যকে বিকৃত ও বিলুপ্তির পথে ধাবিত করবে। শুধুমাত্র কাগজে-কলমে রাষ্ট্র-ভাষা বাংলা হিসেবে নয় সর্বস্তরে বাংলাকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার দায়িত্ব আমার, আপনার ও আমাদের।
‘রাষ্ট্র চলবে বাংলায়, না চলা অন্যায়’- মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের এই স্লোগানে বাংলার প্রতিটি জনপদ যেন দৃঢ় প্রত্যয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ। বাংলা আমাদের রাষ্ট্রীয় ভাষা হলেও বাস্তবে এই ভাষার প্রচলন খুবই হতাশাজনক। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা কার্যকরী করার যে সমস্ত উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে তার সব গুলোই তেমন কার্যকরী হচ্ছে না শুধু মাত্র মনমানসিকতার অভাবে। আমাদের মাঝে একটি বিরাট অংশ ইংরেজী শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে শিশুদেরকে প্রভাবিত করে থাকি। বাংলা কেন শিখবে?- এই ধরনের মনমানসিকতার ফলে শুরুতেই ইংরেজীকে প্রাধান্য দিয়ে থাকি। ফলে এদেশের অধিকাংশ শিশুই শুরুতেই বাংলা ভাষার প্রতি অনীহা দেখিয়ে আসছে। ফলে অভিভাবক ও শিক্ষকবৃন্দ শিশু শিক্ষার্থীদেরকে বাংলার চেয়েও ইংরেজী শিক্ষাতে গুরুত্ব দিয়ে আসছে। আমি এখানে ইংরেজী শিক্ষাকে অনুৎসাহী করছি না। কারণ ইংরেজী একটি আন্তর্জাতিক ভাষা যে ভাষা বিশ্বব্যাপী গৃহীত। তাছাড়া এই বিশ্বায়নের যুগে ইংরেজী শিক্ষা ছাড়া বাস্তব জীবনে চলা অসম্ভব। প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশেষ করে চাকুরি ও ভর্তির ব্যাপারে ইংরেজী জ্ঞানকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। তাই বলে আমার নিজের ভাষা, আমার মাতৃভাষা, আমার ভাইয়ের বিনিময়ে পাওয়া ভাষাকে বাদ দিয়ে নয়। ছোটকালে যখন থেকে অ, আ, ক, খ চেনা শুরু হয়েছিল তখন থেকেই বাবা ও মায়ের মুখে একটি শ্লোক শুনে এসেছি ‘বাল্য শিক্ষা ধারাপাত। ইবা পইড়লি ম্যাট্রিক পাশ।’ বাংলা ভাষা শিখার ক্ষেত্রে এই বইটি একটি উপযুক্ত মাধ্যম হিসেবে সকলের কাছে বেশ জনপ্রিয় ছিল। এক সময় শিশু শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবন শুরু হত এই বইয়ের মাধ্যমে। বাংলা বর্ণমালার প্রতিটি শব্দ ও বর্ণকে নানাভাবে ব্যবহার করে শিশুদের ভিত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই বইয়ের কোন তুলনা ছিলনা। কিন্তু বর্তমানে এই ধরনের বইয়ের সম্পর্কে অনেক অভিজ্ঞ শিক্ষক ও বর্তমান প্রজন্মের মা-বাবার কোন ধারণাই নেই। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা তাই এই ভাষা সহজাতভাবে বাংলার শিক্ষার্থীরা শিখবে- এই ধারনা থেকেই বাংলা শিক্ষা শুরু হয়। কিন্তু বাংলা ভাষা যে একটি ঐতিহ্যময় ভাষা এবং এই ভাষাতে যে কতটুকু গভীরতা আছে তা অনেকেই জানে না, জানতেও চায় না। শুধু মাত্র পরীক্ষা পাসের জন্য পড়া হয়ে থাকে।
একুশের চেতনায় সমৃদ্ধ করার জন্য আধুনিক প্রজন্মকে শুধু ইতিহাসের জ্ঞানের উপর নির্ভর না করে সরাসরি সম্পৃক্ত করে অনেক উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। ভাষা শহীদদের জানবার ও বুঝবার জন্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি শহীদদের স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও নিদর্শনগুলো প্রদর্শনের মাধ্যমে সত্যিকারের জ্ঞান অর্জন সম্ভব।
একুশের প্রেরণা বাঙালির কাছে চির প্রেরণার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। শোক-বিহ্বলতা, বেদনা আর আত্মত্যাগের অহংকারে দেদীপ্যমান ভাষা আন্দোলনের সেই শপথ যুগে যুগে বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধে, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে, সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আলোকবর্তিকার মতো মূর্ত হয়ে ওঠে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ভাষা আন্দোলন জাতির বীরত্বপূর্ণ ঐতিহ্যের পরিচয় তুলে ধরে। সারা বিশ্ব যখন আমাদের শহীদ দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে তখন আমাদের উপরও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এসে পড়ে। তা হলো নিজের ভাষার মর্যাদাকে আরো উন্নত করে তোলা। এ জন্য প্রয়োজন বাংলা ভাষা নিয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা ও অনুশীলন।
লেখক : কলামিস্ট ও অধ্যাপক, ইংরেজী বিভাগ, ডাঃ ফজলুল-হাজেরা ডিগ্রী কলেজ