রাশিয়ার তেল কূটনীতি ও বিশ্ব পরিস্থিতি

দিলরুবা আক্তার চৌধুরী | মঙ্গলবার , ২৬ জুলাই, ২০২২ at ৪:৪৬ পূর্বাহ্ণ

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙনের পর রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধের শৈথিল্য লক্ষ্য করা যায়। যার প্রমাণ ন্যাটো ও রাশিয়ার মধ্যে ২৮ মে ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত ‘ফাউন্ডিং এ্যাক্ট’ নামের চুক্তি। চুক্তি স্বাক্ষরের পর ইয়েলেৎসিন ঘোষণা দেন, ‘ন্যাটোভুক্ত সকল দেশের বিরুদ্ধে রাশিয়া তার তাক করে রাখা পারমানবিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো প্রত্যাহার করে নেবে’। এতে বলা চলে না যে স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। কারণ রাশিয়া ও আমেরিকার স্বার্থ কখনো এক হবে না। যার প্রমাণ বর্তমান পরিস্থিতিতে ইউক্রেন রাশিয়ার আগ্রাসনের জেরে পশ্চিমাদের সাথে মস্কোর সম্পর্কের অবনতি। রাশিয়ার উপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দেশটিকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করে পশ্চিমারা অর্থনৈতিক যুদ্ধ ঘোষণা করেছে বলে মনে করেন ভ্লাদিমির পুতিন। এই প্রেক্ষাপটে রাশিয়া, চীন ও ভারতের সাথে সখ্যতা বাড়াবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।
রাশিয়া বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ জ্বালানী তেল রপ্তানিকারক দেশ। বিশ্বের বাজারে রাশিয়ার তেলের যোগান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জ্বালানী তেলের দাম হু হু করে বাড়ছে। এ অবস্থায় তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো সৌদি আরবসহ ওপেকভুক্ত দেশগুলোর প্রতি তেলের উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধি করার অনুরোধ জানিয়েছে। এই লক্ষ্যেই জো বাইডেনের সৌদি আরব সফর। রপ্তানি করা গ্যাসের মূল্য রুবলে পরিশোধের নির্দেশনা নিয়ে বিরোধের জেরে পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়ার পর প্রতিবেশী ফিনল্যান্ডের গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে রাশিয়া। রাশিয়া থেকে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের প্রধান পাইপলাইন নর্ড স্ট্রিম-১ দিয়ে ধারণ ক্ষমতার ৪০% গ্যাস জুনের মাঝামাঝি কমিয়ে দেয় রাশিয়া। জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে রক্ষণাবেক্ষণ কাজের কারণে ১০দিনের জন্য এই পাইপলাইন বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে রাশিয়া। জার্মান অর্থমন্ত্রী রবার্ট হেবেক শঙ্কা প্রকাশ করেছেন এই সাময়িক বন্ধ স্থায়ী হতে পারে। রাশিয়ার গ্যাসের উপর জার্মানী নির্ভরতা ৫৫% থেকে কমিয়ে ৩৫% করেছে এবং নরওয়ে ও নেদারল্যান্ডস থেকে বেশি গ্যাস কিনছে। রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহ বন্ধের কারণে সংকটে পড়েছে ইতালিও। তেলের দামের উর্ধ্বগতির কারণে হু হু করে বাড়ছে পুরো বিশ্বে নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর, দেখা দিয়েছে চরম মুদ্রাস্ফীতি। যুক্তরাষ্ট্রকে গত চার দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি মোকাবেলা করতে হচ্ছে। গত দুই দশকের মধ্যে প্রথম বারের মতো ইউরোর দাম পড়ে গিয়ে মার্কিন ডলারের সমান হয়েছে। মূল্যস্ফীতি আর জ্বালানী সরবরাহের অনিশ্চয়তায় পুরো ইউরোপে মন্দার আশঙ্কায় ইউরোর এই দর পতন।
বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির সাথে ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের প্রেক্ষিতে ওপেকের ইসরাইলকে সমর্থনকারী পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি তেল নিষেধাজ্ঞা প্রণিধানযোগ্য। আরব দেশগুলোর এই তেল নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে ইসরাইলের উপর চাপ সৃষ্টি করে রাজনৈতিক সমঝোতা ও দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের অবসান হবে বলে তারা মনে করেছিলেন। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে তাৎক্ষণিকভাবে গোটা বিশ্বে বিশেষ করে শিল্পোন্নত দেশ সমূহের ব্যাপক জ্বালানী সংকটসহ নানা অর্থনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। যার ফলে বেকারত্ব সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করে ও মানুষের জীবন যাত্রা ব্যয়সাধ্য হয়ে পড়ে। আরবদের তেল নিষেধাজ্ঞার ফলে সংকটের মুখে বৃটেন তার বিমান বহরের জন্য বরাদ্দকৃত তেল ১৭% কমিয়ে দেয় এবং তেল ব্যবহার হয় এমন সব বিনোদন ও প্রমোদভ্রমণ নিষিদ্ধ করা হয়। একইভাবে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশের বিমান বহরের জন্য বরাদ্দকৃত তেল ২৫% কমিয়ে ফেলে। গাড়ির চাহিদা কমে যাওয়ায় ফ্রান্সের বিখ্যাত সিটরোন কোম্পানী সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। একইভাবে আমেরিকার বিখ্যাত ফোর্ড কোম্পানী, জেনারেল মোটরস ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ইতালির সরকারি ছুটির দিনে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার বন্ধ করে দেয়। পোপ পল নিজেই গাড়ির পরিবর্তে ঘোড়ার গাড়ি করে রোমের গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেন। আমেরিকার শেয়ার বাজারের মারাত্মক ক্ষতি হয়। আমেরিকার সরকার তার অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল কমিয়ে দেয়। তেলবিহীন রাষ্ট্র জাপান অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়। ফ্রান্স ও পশ্চিম জার্মানী ঘোষণা করে মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে তারা নিরপেক্ষ থাকবে। আরবদের তেল কুটনীতির কারণে আমেরিকাসহ ইসরাইলের পৃষ্ঠপোষক দেশগুলো প্যালেস্টাইন সম্পর্কে নতুন চিন্তাভাবনা করে। পিএলও প্রধান ইয়াসির আরাফাত প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশগ্রহণ ও বক্তৃতা করার সুযোগ পায়।
কোভিডের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে ধস নেমেছে যার প্রেক্ষিতে বেকারত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে, আর ইউক্রেনের উপর রাশিয়ার আগ্রাসন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বিভিন্ন শিল্পে উৎপাদন মারাত্নকভাবে ব্যহত হচ্ছে গ্যাস বিদ্যুৎ সংকটের কারণে। বাংলাদেশে আমদানী ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ কমে যাওয়ায় ডলারের দাম বেড়ে রেকর্ড হয়েছে, টাকার মান কমেছে। এমন পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বের সাথে সাথে বাংলাদেশ সরকার গত জুন থেকে খরচ কমানোর জন্য কৃচ্ছ্বতার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের ব্যয় স্থগিত, বিদেশ সফর স্থগিত, বিলাসদ্রব্য আমদানী নিরুৎসাহিত করা, আমদানীর ক্ষেত্রে এলসির মার্জিন বাড়িয়ে দেওয়া, জ্বালানী সংকট মোকাবেলায় ডিজেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন স্থগিত, সপ্তাহে একদিন পেট্রোল পাম্প বন্ধ, শপিং মল রাতটার আটটার পর বন্ধ, এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং, অফিসের সময়সূচী কমানো ও অফিসের সভা ভার্চুয়ালী করাসহ নানা পদক্ষেপ। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমান বৈশ্বিক এই সংকটে আমাদের সরকারের নির্দেশনা আন্তরিকভাবে মেনে চলতে হবে। অপ্রয়োজনে বিদ্যুতের ব্যবহার কমাতে হবে, অনুষ্ঠানে আলোকসজ্জা বন্ধ রাখতে হবে, গাড়িসহ অন্য ক্ষেত্রে তেলের ব্যবহার কমাতে হবে, বিলাসিতা সাময়িক পরিহার করতে হবে অন্যথায় সামনে আমাদের কঠিন দিনের সম্মুখীন হতে হবে।
লেখক: উপাধ্যক্ষ, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমোহিতলাল মজুমদার : কবি ও সাহিত্য সমালোচক
পরবর্তী নিবন্ধবায়তুশ শরফ দরবারের প্রতিষ্ঠাতা শাহছুফি মীর মোহাম্মদ আখতার