রাত নামার সাথে সাথে রেসিং ট্র্যাক, ‘ভয়ংকর আনন্দ’ উপভোগ

মোটরসাইকেল চালানোর অনুমোদন দেওয়া আত্মঘাতী হবে : বিশেষজ্ঞ

হাসান আকবর | রবিবার , ১০ নভেম্বর, ২০২৪ at ৪:২০ পূর্বাহ্ণ

মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় দুই যুবকের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে এই বাহন নিষিদ্ধ করার পরামর্শ এসেছে। এক্সপ্রেসওয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি পথ ঝুঁকিমুক্ত রাখতে এই সড়কে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ রাখার আহ্বান জানিয়েছেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ।

পরীক্ষামূলক যান চলাচল শুরু হওয়ার পর থেকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে মোটরসাইকেল চলাচল করছে। প্রতিদিন রাত নামার সাথে সাথে এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে ওঠে ‘রেসিং ট্র্যাক’। শুক্রবার রাতের মর্মান্তিক ঘটনার পর গত রাতেও এক্সপ্রেসওয়েতে প্রচুর মোটরবাইক দেখা গেছে। সিডিএ বলেছে, মোটরসাইকেল চালকেরা জোর করে এক্সপ্রেসওয়েতে উঠে যাচ্ছেন। তাদের ঠেকানোর মতো লোকবল সিডিএর নেই। সিডিএর পক্ষ থেকে বিষয়টি দেখার জন্য পুলিশকে চিঠি দেওয়া হবে বলে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, পুলিশ বা মন্ত্রণালয় থেকে বন্ধ করা না হলে সিডিএ মোটরসাইকেলের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। শহরের যান চলাচলে গতি আনতে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় পতেঙ্গা থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত সাড়ে ১৬ কিলোমিটারের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। শহরের প্রথম এই এক্সপ্রেসওয়েকে মুরাদপুর ফ্লাইওভারের সাথে যুক্ত করায় এটির দৈর্ঘ্য দাঁড়িয়েছে প্রায় ২২ কিলোমিটার। ২৮ আগস্ট এক্সপ্রেসওয়েতে পরীক্ষামূলক যান চলাচল শুরু হয়েছে। এরপর থেকে প্রতিদিন শত শত মোটরসাইকেল চলাচল করছে। এদের মধ্যে অনেকে প্রয়োজনে এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করেন, অনেকে স্ত্রীসন্তান বা বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে যান। তবে রাতে অগুনতি মোটরসাইকেল এক্সপ্রেসওয়েতে উঠে রেসিং শুরু করে। এরা বেপরোয়া গতিতে রেসিং করে। বাইকের গতি ১৩০/১৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত ওঠে। রাত বাড়ার সাথে সাথে এদের দাপট বাড়তে থাকে। অনেক সময় রাতে এক্সপ্রেসওয়েতে চলাচলকারী প্রাইভেটকারের সাথেও মোটরসাইকেলকে পাল্লা দিতে দেখা গেছে।

রাতের বেলা বাইকের বেপরোয়া চলাচল এক্সপ্রেসওয়েকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে মন্তব্য করে বিশেষজ্ঞসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ বলছেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে মোটরসাইকেল চালানোর মানেই হয় না। শহরের স্বল্প দূরত্বে চলাচলকারী মোটরসাইকেলগুলো নিচের সড়ক ব্যবহার করে অনায়াসে চলাচল করতে পারে। তারা বলেন, রাতের বেলা যেসব মোটরসাইকেল এক্সপ্রেসওয়েতে গতির ঝড় তোলে সেগুলো কোথাও যাওয়ার জন্য ঘর ছাড়ে না, এক্সপ্রেসওয়েতে চালানোর ‘ভয়ংকর আনন্দ’ উপভোগ করতেই পথে নামে।

এক্সপ্রেসওয়েতে মোটরসাইকেল চালানোর ব্যাপারে প্রশাসনকে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তারা বলেছেন, জীবন বাঁচাতে কঠোর হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। এখন স্বল্প সংখ্যক যান চলাচলের মাঝে এভাবে দুর্ঘটনা ঘটলে পুরোদমে যান চলাচল শুরু হলে প্রতিদিনই প্রাণহানির ঘটনা ঘটবে বলে আশঙ্কা তাদের।

ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট চট্টগ্রামের সাবেক চেয়ারম্যান ও নগর পরিকল্পনাবিদ ইঞ্জিনিয়ার দেলোয়ার মজুমদার বলেন, মোটরসাইকেল সড়ক দিয়ে চলাচল করতে পারে। এগুলো খুব বেশি আইনকানুন মানে না। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমোদন দেওয়া হলে বিপদ বাড়বে। এক্সপ্রেসওয়ের বেশ কিছু সমস্যার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটির স্পিডব্রেকারগুলোতে সমস্যা আছে। আঁকাবাঁকা হওয়ায় বিপরীত দিকের গাড়ির লাইটের আলো অপর পাশের চালকের চোখে পড়ে। গতি তোলার জন্য এক্সপ্রেসওয়ে উপযুক্ত জায়গা নয়। এখানে মোটরসাইকেল চালানোর অনুমোদন দেওয়া আত্মঘাতী হবে।

কলেজ শিক্ষক আতিক উল্ল্যাহ চৌধুরী নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, কয়েকদিন আগে রাতের বেলা এক্সপ্রেসওয়েতে মোটরসাইকেলের যে ভয়ংকর চলাচল দেখেছি, তখন আমার মনে হয়েছিল এখানে রক্ত ঝরবে।

ব্যবসায়ী কামরুল হাসান বলেন, মোটরসাইকেল চালকেরা আইনকানুনের ধার ধারেন না। তাদের যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে চালান। নিচের রাস্তায় যেভাবে চলাচল করে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে সেভাবে চলাচল করলে প্রতিদিনই দুর্ঘটনা ঘটবে।

দীর্ঘদিন মোটরসাইকেল চালানো অভিজ্ঞ একজন সাংবাদিক নাম প্রকাশ না করে বলেন, গতিসীমা মেনে মোটরসাইকেল চালালে কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সিংহভাগ বাইকার নিয়ম মানেন না। এ ধরনের একটি বাহনকে এক্সপ্রেসওয়েতে চলাচলের অনুমোদন দেওয়ার মানে হচ্ছে তাদের মৃত্যু উপত্যকায় ছেড়ে দেওয়া।

সিডিএ চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ নুরুল করিম আজাদীকে বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে মোটরসাইকেল চলাচল নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে আমরা পুলিশকে চিঠি দেব। বিষয়টি মন্ত্রণালয়কেও জানানো হবে। সরকারের পক্ষ থেকে যেভাবে সিদ্ধান্ত আসবে আমরা তা কার্যকর করব।

শুক্রবার রাতের দুর্ঘটনার পর গতকালও প্রচুর মোটরসাইকেল এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে রেসিং করেছে। সিডিএর নিয়োগকৃত একজন গার্ড জানান, মোটরসাইকেলওয়ালাদের উঠতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। অনেকে বললেন, মরলে আমরা মরব, আমরা যাবই। অনেক বাইকার গতকাল জোর করে এক্সপ্রেসওয়েতে উঠেন বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে সিডিএ চেয়ারম্যান জানান, মোটরসাইকেল বাধা দেওয়ার মতো লোকবল আমাদের নেই। আমরা এ ব্যাপারে পুলিশের সহায়তা চাইব। তবে মোটরসাইকেল যাতে এক্সপ্রেসওয়েতে না উঠে সেজন্য দুই প্রান্তে সাইনবোর্ড লাগাব।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচকবাজারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জমায়েত কর্মসূচি আজ
পরবর্তী নিবন্ধগণহত্যাকারী বা নিষিদ্ধ সংগঠনের কর্মসূচির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি আসিফ মাহমুদের