চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়ার চিরিঙ্গায় পার্বত্য অববাহিকার মাতামুহুরী নদীর ওপর নির্মিত ছয় লেনের সেতুটি যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এনেছে। প্রতীক্ষিত এই সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে জনগণের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নপূরণ হয়েছে। কিন্তু প্রতিদিন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত বাড়ার সাথে সাথে আতঙ্ক দেখা দেয় এই সেতু দিয়ে যাতায়াতকারী ছোট ছোট যানবাহনের যাত্রীসহ সাধারণ পদচারীদের মাঝে।
সেতুটির আশপাশের একাধিক বাসিন্দা ও সেতু ব্যবহারকারী অনেক ভুক্তভোগী বলছেন, ছয় লেনের এই সেতুটির কাজ শতভাগ কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর যানবাহন চলাচলের জন্য ইতোপূর্বে সেতুটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকে এই সেতুটি হয়ে উঠে অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য। বিশেষ করে সেতুটির প্রস্থের দুই পাশে লোকাল যাত্রীদের জন্য নির্মিত লেন দুটি দিয়ে যাতায়াত একেবারেই অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। রাত বাড়ার সাথে সাথে এই দুই লেন দিয়ে যাতায়াতকারী যাত্রী–সাধারণ প্রতিনিয়ত ডাকাতি, ছিনতাই ও হামলার শিকার হচ্ছেন। সেতুটি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার পর থেকে অন্তত শতাধিক ছিনতাইসহ চলাচলকারী যাত্রী–সাধারণের কাছ থেকে সর্বস্ব ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এমনকি চালককে কুপিয়ে ও পিটিয়ে অসংখ্য মোটর সাইকেল, ইজিবাইকও (টমটম) ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে ইতোপূর্বে।
দৃষ্টিনন্দন মাতামুহুরী সেতুর লোকাল যাত্রীদের জন্য নির্মিত প্রস্থের দুই লেন কেন অনিরাপদ হয়ে উঠেছে? দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে যাতায়াতকারী বিভিন্ন ছোট যানবাহনের চালক, যাত্রীসহ পথচারীরা দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘এই সেতুটির উপরিভাগের সীমানা রেলিংয়ে নেই কোনো ধরনের লাইটিং ব্যবস্থা। তাছাড়া আইন–শৃক্সখলা বাহিনীর তেমন তৎপরতা না থাকায় সংঘবদ্ধ ডাকাত–ছিনতাইকারীর দল তাদের অপকর্ম সংঘটিত করার জন্য রাতের আঁধারে উপযুক্ত স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছে এই মাতামুহুরী সেতুটিকে। এতে দৃষ্টিনন্দন মাতামুহুরী সেতুটিই এখন অপরাধের স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিণত হয়েছে।’
সেতুর কাছের বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী মো. আরমানুল হক তারেক দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘ছয় লেনের এই মাতামুহুরী সেতুটি অনেকের কাছে বিনোদনের স্পট হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সময় পেলেই পরিবারের সদস্যরা ছুটে যান সেতুর ওপরে দাঁড়িয়ে নির্মল হাওয়ায় নিজেকে উজাড় করে দিতে। কিন্তু এই সেতুটি সন্ধ্যার পর থেকে ডাকাত–ছিনতাইকারীদের অভয়ারণ্য হয়ে ওঠে। তারা সুযোগ বুঝেই সংঘবদ্ধভাবে ডাকাতি, ছিনতাই করে যাত্রী–সাধারণের সর্বস্ব লুট করে নিচ্ছে। এতে সন্ধ্যার পর থেকে ডাকাত–ছিনতাইকারী আতঙ্কে একেবারেই অনিরাপদ হয়ে পড়েছে এই সেতুটি।’
এই বিষয়ে জানার জন্য সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহে আরেফিন এর নাম্বারে অসংখ্যবার কল করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন না ধরায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
অবশ্য সড়ক ও জনপথ বিভাগ চকরিয়া কার্যালয়ের উপ–বিভাগীয় প্রকৌশলীর দায়িত্বপ্রাপ্ত মো. রাহাত আলম দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘সেতুটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা হয়েছে ক্রস বর্ডার রোড ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের আওতায়। মূলত জাইকার অর্থায়নে সেতুটি নির্মিত হয়েছে। তাই সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর নতুন করে এই সেতুর ওপর স্ট্রিট লাইট বসানোর কাজ করবে না। তবে যেহেতু সেতুটি পৌরসভা এলাকায় পড়েছে, সেহেতু পৌরসভা কর্তৃপক্ষ চাইলে সেতুর ওপরে স্ট্রিট লাইটিংর ব্যবস্থা করতে পারে।’
মাতামুহুরী সেতুর ওপর যাত্রী–সাধারণের চলাচল নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করার কথা জানিয়েছেন কক্সবাজার–১ আসনের সংসদ সদস্য অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক।
তিনি দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘মাতামুহুরী নদীর ওপর নির্মিত দৃষ্টিনন্দন সেতুটিতে কোনো ধরনের লাইটিংয়ের ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিনিয়ত অপরাধকর্ম সংঘটিত হওয়ার বিষয়টি আমার নজরেও এসেছে। তাই আগামী মাসের উপজেলার আইন–শৃক্সখলা ও উন্নয়ন সমন্বয় সভায় এই বিষয়ে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। শুধুমাত্র লাইটিং ব্যবস্থা না থাকার কারণে কোনো অবস্থাতেই আইন–শৃক্সখলার অবনতি ঘটুক তা হতে দেওয়া হবে না।’
থানা ও হাইওয়ে পুলিশের তৎপরতা : এদিকে ঈদকে সামনে রেখে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়া উপজেলার ৩৯ কিলোমিটারের মধ্যে ৮ পয়েন্টে থানা ও হাইওয়ে পুলিশ চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালনাসহ সর্বসাধারণের ঈদ যাত্রা নির্বিঘ্ন করতে রাতভর চকরিয়া অংশে মহাসড়কজুড়ে টহল ব্যবস্থাও জোরদার করা হয়েছে। তন্মধ্যে চকরিয়ার দক্ষিণাংশের খুটাখালী, মেদাকচ্ছপিয়া, জাতীয় উদ্যান এলাকা, ফাঁসিয়াখালীর রিংভং এলাকা, মাতামুহুরী সেতুর পূর্বাংশে জিদ্দাবাজার এলাকা, বরইতলীর আমতলী এলাকা, উত্তর হারবাংয়ের ভাণ্ডারির ডেবা ও আজিজনগর এলাকায় পৃথক চেকপোস্ট বসিয়ে অপরাধ কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে চকরিয়া থানা এবং চিরিঙ্গা ও মালুমঘাট হাইওয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে।
এই বিষয়ে চকরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘শুধু ঈদকে সামনে রেখে নয়, প্রতিনিয়তই হাইওয়ে পুলিশের পাশাপাশি থানা পুলিশের মোবাইল টহলদল মহাসড়কে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করছে। যানবাহনে চলাচলরত যাত্রীরা যাতে নিরাপদে যাতায়াত করতে পারে সেজন্য বাস থামিয়ে যাত্রীদের অভয় দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট বসিয়ে ডাকাত–ছিনতাইকারী ধরতে পুলিশের তৎপরতা অব্যাহতভাবে চলছে।’
ওসি জানান, ইতোপূর্বে মাতামুহুরী সেতুর ওপর সংঘটিত অপরাধীদের অনেককে শনাক্তপূর্বক তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি লুণ্ঠিত মালামালও উদ্ধার করা হয়েছে।
মহাসড়কের চকরিয়ার চিরিঙ্গা হাইওয়ে থানা পুলিশের ওসি মো. মাহবুবুল হক ভূঁইয়া ও মালুমঘাট হাইওয়ে থানা পুলিশের ইনচার্জ মো. মোজাম্মেল হক জানান, হাইওয়ে পুলিশের দুটি টিম দিনে ও রাতে মহাসড়কে টহল দিয়ে যাচ্ছে। মহাসড়কে কোনো ধরনের বিশৃক্সখলা, যানজট ও দুর্ঘটনা যাতে সংঘটিত না হয় সেজন্য এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তারা জানান, মহাসড়কে যাতে কোনো ধরনের তিন চাকার যানবাহন চলাচল না করে সেজন্য প্রতিনিয়ত সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।