রাজার দুঃখ

জুয়েল আশরাফ | বুধবার , ৫ জানুয়ারি, ২০২২ at ১০:৫৫ পূর্বাহ্ণ

এক ছোট্ট দেশ। ছোট্ট মানে খুবই ছোট্ট। সেখানে মোট জনসংখ্যা পাঁচ হাজার তিনশ বাইশ জন। যখন রাজ্য আছে, জনসংখ্যা আছে, রাজা তো অবশ্যই থাকবে। সামান্য দেশের সামান্য রাজা। এমন একটি দেশেও কিন্তু সেনাবাহিনী, মন্ত্রী, উজির-নাজির সবই আছে।
এই রাজ্যেও আদালত আছে। বিচার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সেখানকার রাজা এবং প্রজারা সবাই শান্তিপ্রিয় ছিল। কখনও কারোর সঙ্গে ঝগড়া হয়নি। অতএব, আদালত অর্থের অপচয় হিসাবে বন্ধ ছিল। রাজার তার প্রতিবেশী রাজ্যগুলির সঙ্গে খুব বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। সুতরাং সেনাবাহিনীর নামে মাত্র একশ-দেড়শ সৈন্য ছিল। কিন্তু কারোর হাতে তরবারি ও বন্দুক ছিল না। প্রত্যেকের হাতে ছিল একটি বেত। এই বেতই শান্তি বজায় রাখার জন্য যথেষ্ট ছিল।
একবার রাজা এক অদ্ভুত সমস্যায় পড়ল। রাজ্যে প্রথমবারের মতো কেউ চুরির জন্য কারোর বাড়িতে ঢুকেছে। ঘটনাক্রমে সেখানে মারামারি হলো। চোরের হাতে একজন মারাও গেল। সৈন্যরা চোরকে ধরে রাজার কাছে নিয়ে এলো।
রাজা মন্ত্রিসভার বৈঠক ডাকল। চিন্তা শুরু হল যে, চোরের শাস্তি কী হওয়া উচিত? একজন মানুষকে চোরের হাতে খুন করা হয়েছে। অনেক ভেবেচিন্তেও কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া গেল না। কারণ এর আগে এমন অপরাধ কেউ করেনি। এই কারণেই, কেউ বুঝতে পারছিল না যে, চোরকে কী শাস্তি দেওয়া উচিত?
হঠাৎ একজন মন্ত্রী বলল, রাজা মহাশয়, প্রতিবেশী রাজ্যে আদালত আছে। অবশ্যই সেখানে এরকম মামলা থাকবে। এই চোরকে শাস্তির সিদ্ধান্ত নিতে পাশের রাজ্যে পাঠানো উচিত।
এই পরামর্শ রাজার পছন্দ হলো। প্রতিবেশী রাজাকে অনুরোধ করা হলো, চোরকে সেখানে পাঠিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। রাজার দুঃখ শেষ হয়ে গেল। কিন্তু দুদিন পর চোরের সঙ্গে রাজার ঝামেলা আবার ফিরে এল। সেখানকার আদালত রায় দিল, যেহেতু এই চোর খুন করেছে। তাই এর শিরচ্ছেদ করা উচিত।
এখন রাজার কোনো জল্লাদ ছিল না। যখন সৈন্যদের জিজ্ঞাসা করা হলো, তারা একটি পরিষ্কার উত্তর দিল, আমরা এভাবে কাউকে হত্যা করতে শিখিনি। তারপর আমরা এই কাজের জন্য কোনো যন্ত্রপাতিও রাখিনি। আমাদের তরবারি এমনকি ছুরিও নেই।
রাজা বিচলিত হয়ে আবার মন্ত্রিসভার বৈঠক ডাকল। বেশ কিছু দিন ধরে মস্তিষ্কচর্চা চলল। শেষ পর্যন্ত সবাই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হল যে, এই চোরের সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে রূপান্তরিত হোক। রাজার দুঃখ আবারও কমে গেল।
কিন্তু রাজ্যে এমন কোনো জেল ছিল না যেখানে দোষী সাব্যস্ত অপরাধীকে রাখা যাবে। সুতরাং একটি জেল তৈরি করা হলো। চোরকে সেখানে রাখা হলো। একজন প্রহরী নিযুক্ত করা হলো। সে চোরকে দেখতো। সে চোরের জন্য প্রাসাদ থেকে খাবারও আনতো।
রাজ্যের আয় ছিল খুবই নগণ্য। রাজার এই প্রহরীর খরচ বহন করা খুব কঠিন ছিল। এখন কীভাবে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়? রাজা চিন্তিত হলো। আবার মন্ত্রিসভার বৈঠক ডাকল।
প্রহরীকে সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। যেখানেই চোর যেতে চায় চলে যাক। এই ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় এটাই।
পরদিন যখন চোরের ঘুম ভাঙল, তখন দেখল সেখানে কোনো প্রহরী নেই। দরজাও খোলা ছিল। যখন অন্য কেউ তার খাবার নিয়ে আসেনি, তখন সে নিজেই প্লেট নিয়ে প্রাসাদে পৌঁছাল।
তারপর এটি তার দৈনন্দিন কাজ হয়ে উঠল। রাজভবন থেকে খাবার নিয়ে আসে। তারপর খাওয়া-দাওয়া শেষে চোর শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে। এই ব্যয়ের কারণে রাজার দুঃখ আবার বেড়ে গেল। সে চোরকে বলল, এখন তুমি স্বাধীন। যেখানে খুশি পালিয়ে যাও। কেউ কিছু বলবে না।
কিন্তু চোর উত্তর দিল, পালিয়ে এখন আমি কোথায় যাব? মানুষ আমাকে দেখলেই গালি দেবে। আমাকে মারতে দৌড়াবে। কেন আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়নি?
রাজার দুঃখ বেড়ে গেল, তাই সে আবার মন্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ করল। মন্ত্রীরা ভেবেচিন্তে বলল, রাজা মহাশয়, চোরের খাবার ও পানি বন্ধ করুন। যদি খাবার না পাওয়া যায়, তাহলে সে নিজে কোথাও চলে যাবে।
কিন্তু চোরও যেতে রাজি ছিল না। সে ক্ষুধার্ত এবং তৃষ্ণার্ত থাকতে শুরু করল। চোর মানুষের কাছে অনুনয়-বিনয় করল। সেখানকার লোকেরা মনে করলো যে, এই চোরকে এভাবে ক্ষুধার্ত রাখা সত্যিই রাজার প্রতি অবিচার। লোকজন রাজাকে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করল। রাজা নিজের সমস্যার কথা বলল।
অনেক আলোচনার পর লোকেরা রাজাকে বলল, রাজা মহাশয়, একটা সমাধান আছে। আপনি এই চোরকে খাবার দিতে আপত্তি করবেন না। সে যে অনিচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ড করেছিল তাও প্রায়শ্চিত্ত হবে। মানুষ এটাকেও সম্মান করবে।
রাজা খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করল, সেটা কী?
লোকজন বলল, রাজা মহাশয়, গত দুই বছরে আমাদের ভালো বৃষ্টি হয়নি। এ কারণে রাস্তার ধারের অধিকাংশ গাছ শুকিয়ে গেছে। যাতায়াতে মানুষ অনেক কষ্ট পায়। রাস্তার পাশে ছায়াময় ও ফলের গাছ লাগানো উচিত। বিনিময়ে সবাই ফল খেতে পাবে এবং পুরো রাজ্য উপকৃত হবে। এমনকি লোকেরা চোরকে এই মহৎ কাজটি করতে দেখে তাকে গালি দেবে না। তাকে সম্মান করবে। এই কাজের জন্য তার মনে আবার কখনও অপরাধ না করার অনুভূতি জাগিয়ে তুলবে।
রাজা এবং তার মন্ত্রিসভা এই পরামর্শে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হলো। চোরও এটা পছন্দ করল। কাজ পেল, খাবার পেল, মানুষের ভালোবাসা পেল। রাজাও একটা বড় ঝামেলা থেকে মুক্তি পেল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে এগিয়ে যাবে ছাত্রলীগ
পরবর্তী নিবন্ধসততা