রাজাদিত্যর প্রামাণ্যচিত্র ‘ওয়াটারওয়ালা’

শৈবাল চৌধূরী | সোমবার , ২৮ এপ্রিল, ২০২৫ at ১১:১৫ পূর্বাহ্ণ

আমাদের শৈশবে বাসায় পানির সংযোগ ছিল না। পাড়ায় একটা কুয়ো ও কয়েকটি নলকূপ বা চাপকল ছিল। বড় পাড়াটির দুই প্রান্তে পৌরসভার দুটি কল ছিল, যার একটিতে পানি পড়তো টিপ টিপ করে। বাসার মহিলাদের পক্ষে এসব জলাধারে যাওয়া সম্ভব ছিল না কুয়োটা ছাড়া। সব মিলে একটা জলকষ্ট দেখতাম শহরজুড়ে। অবশ্য ধনী বা উচ্চবিত্তদের বাসাবাড়িতে গভীর নলকূপ থেকে পানি তুলে ঘরের ভেতরে সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল। উপরের বৃত্তান্ত মধ্যবিত্তনিম্নবিত্তদের। কিছু পাড়ায় পুকুর ছিল, যেগুলি পানির সরবরাহ মেটাতো।

ফলে তখন একমাত্র ভরসা ছিল ‘পানিওয়ালা’ বা ‘ভারী’। এরা কাঁধে বাক ও বাকের দুটিকে দুটি বড় টিন নিয়ে বাসায় বাসায় পানি সরবরাহ করতেন। প্রতিটি পাড়ায় কয়েকজন করে ভারী থাকতেন। যাদের কাজ চলতো কাকভোর থেকে সন্ধ্যারাত পর্যন্ত। এদের অনেকে হোটেল রেস্তোরাঁ ও বিভিন্ন দোকানপাটেও পানি সরবরাহ করতেন। বেশ একটা রমারমা ছিল তাদের। যদিও খুব দরিদ্রই ছিলেন তারা, যা তাদের বেশভূষা ও কথাবার্তায় সে বয়সেও বুঝতে পারতাম। বিয়েশাদি বা বড় কোনো নেমন্তন্ন অনুষ্ঠানে এদের কদর বাড়তো পানির প্রয়োজনে। তাদের পরিবার থাকতো কাছের কিংবা দূরের গ্রামে তারা এখানে দলব্‌েধে বাসা নিয়ে থাকতেন, যেগুলি খুব একটা বাসোপযোগী ছিল না। অনেক সময় খুঁজতে গিয়ে দেখেছি, যখন তারা হয়তো হঠাৎ অনুপস্থিত থাকতেন। দেখতাম অসুস্থ, বিকল্প ঠিক করে দিতেন কাউকে। আর সেটা সম্ভব না হলে আমরা রীতিমতো আতান্তরে পড়ে যেতাম। ওয়াসা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অনেক পরে ঘরে ঘরে পানির সংযোগ আসার পর পানির সংকট কমলো বটে, পানিওয়ালাদের সংকট বেড়ে গেল। কর্মসংস্থান হারিয়ে তারা বেকার হয়ে পড়লেন। দোকানপাটেও পানির সংযোগ নেয়া হচ্ছিল। দুচারজন রিকশাচালক, মুটে, রাজমিস্ত্রির সহকারী বনে গেলেন। তবে বেশিরভাগই গ্রামে ফিরে গিয়ে নানা দুর্দশায় পড়লেন। মাঝে মধ্যে পুরোনো গ্রাহকদের বাসায় এসে সাহায্য সহায়তা চাইতেন। অনেকে অকালে মারা গেলো দুঃখে কষ্টে রোগে শোকে।

পুরোনো এসব কথা নতুন করে মনে পড়ে গেল রাজাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘ওয়টার ওয়ালা’ দেখে। ৫৬.১৮ মিনিটের এই অভিনব প্রামাণ্য চলচ্চিত্র সমাজের প্রান্তিক, অবহেলিত ও হতদরিদ্র জনশ্রেণি ‘পানিওয়ালা’ ‘ভারী’ ভিস্তি বা ‘ওয়াটারওয়ালা’দের প্রায় মানবেতর জীবনযাপন ও কর্মতৎপরতা তুলে ধরেছেন চলচ্চিত্র নির্মাতা রাজাদিত্য বন্দোপাধ্যায় তাঁর দীর্ঘ গবেষণালব্ধ আন্তরিক কুশলতায়। ‘আন্তরিক’ শব্দটি বলার কারণ, চলচ্চিত্রকার কেবলমাত্র তাঁর ডকুমেন্টরির একটি অভিনব বিষয় হিসেবে নয়, তাঁর শৈল্পিক দায়িত্ববোধ থেকে প্রায়বিলুপ্ত এই শ্রমজীবী শ্রেণিকে বেছে নিয়েছেন। একটি প্রামাণ্যচলচ্চিত্রের সুদূরপ্রসারী ও সুদূরপ্রভাবী দীর্ঘ স্থায়িত্ব থাকে যার মধ্য দিয়ে উপস্থাপিত বিষয়ের আর্কাইভ তৈরি হয়। বাড়িতে বা দোকানে পানি ফেরি করা এই শ্রমজীবী শ্রেণির অস্তিত্ব বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। এখন সর্বত্র পানি সরবরাহের সরকারি ও ব্যক্তিগত সংযোগ বিদ্যমান থাকে এই শ্রমজীবীদের উপযোগিতা প্রায় শেষের পথে। যে দু’চারজন এখনও দেখা যায়, এরা চলে গেলে এই শ্রমজীবিকার সমাপ্তি ঘটবে। নতুন করে কেউ আর এ পেশায় আসছেন না। পানির সংযোগের বিস্তার ও সহজলভ্যতাই এর একমাত্র কারণ নয়, শিল্পকারখানার প্রসার, নিত্যনতুন পেশার আবির্ভাব ও বিস্তৃতি এবং জীবন যান্ত্রিকতার কারণে ভিস্তি বা ভিস্তি ওয়ালার অত্যন্ত কষ্টকর ও সীমিত পারিশ্রমিকের পেশায় কেউ আর আগ্রহী নন। পুরোনো কয়েকজন রয়ে গেছেন অভ্যাসবশত। তাছাড়া সামাজিক নানা প্রতিবন্ধকতাও একটি কারণ। মশক তৈরি হয় ছাগলের চামড়া দিয়ে। ফলে অনেকে চামড়ার মশকে ভরা জল পান বা ব্যবহার করতে অনাগ্রহী। অবশ্য এ বঙ্গে মশকের পরিবর্তে টিনের বড় পাত্র ব্যবহৃত হতো। জাতপাত ও ধর্মের ব্যাপারটিও উঠে আসতে থাকে। এক ধর্মের ভারীর জল অন্য ধর্মের লোকেরা ব্যবহার অনুপযোগী ভাবতে শুরু করলেন না যা প্রথম দিকে দীর্ঘসময় ছিল না। সবশেষের বড় প্রতিবন্ধকতা ‘মিনারেল ওয়াটার’। বোতলজাত এই জল সর্বত্র সুলভ ও সহজপ্রাপ্য হওয়ার পর থেকে বিশুদ্ধতার কথা ভেবে এই জলের উপর নির্ভরশীলতা বেড়ে যায়। দোকানপাট অফিস আদালত এমনকি বাসাবাড়িতেও অনেকেই বড় বোতল বা ক্যানে মিনারেল ওয়াটার নিতে শুরু করেন। যা এখন নিত্য নৈমিত্তিক নিয়ম। ফলে ওয়াটারওয়ালাদের কদর ও প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে কালের নিয়মে। এই যে এতসব আখ্যান, অভিজ্ঞতা, এসবের প্রামাণিক ও মর্মস্পর্শী দলিল হলো রাজাদিত্য বন্দোপাধ্যায়ের প্রামাণ্য চলচ্চিত্র-‘ওয়াটারওয়ালা’। উপরে বর্ণিত প্রতিটি অভিজ্ঞতার চিত্র আমরা এ ছবিতে দেখতে পাই। কলকাতার ওয়াটার ওয়ালারা মূলত মুসলমান এবং বিহারের কাটিহার জেলা থেকে আগত। প্রধানত মধ্য কলকাতায় এদের কাজ ও বাস। একাদশ শতাব্দীতে এদের পেশাগত জীবনের শুরু উত্তর ভারতে মোগল আমলের অব্যবহিত পরপর। কলকাতায় আগমন ইংরেজ আমলে। কলকাতা শহরের পতন (১৬৯০ সাল) হওয়ার পর। তখন সারা কলকাতায় তিন হাজার বেশি ভিস্তি পানি সরবরাহ করতেন। ২৫ বছর আগেও শ দেড়েক ভিস্তি । এখন হাতে গোনা দুয়েক জন। তবে ভারী আছেন বেশ ক’জন এখনও। এরাও মহাসংকটে রয়েছেন। বাসাবাড়িতে জল দেয়া বন্ধ। কিছু দোকান পাটে টুকটাক কিছু কাজ রয়েছে। ভিস্তি এং ভারীরা মূলত মিঠাপানি সরবরাহ করেন যার দাম দূরত্বভেদে ৫ থেকে ১০ টাকা। যা পরিশ্রমের তুলনায় নিতান্তই নগণ্য। এসব তথ্য আমরা পেয়ে যাই রাজাদিত্যর ‘ওয়াটারওয়ালা’য়। ‘ওয়াটারওয়ালা’ প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের গাঁথুনি খুব সুগ্রথিত। পরিচালক নিজেই সাক্ষাৎকারগুলি নিয়েছেন। ধারাবর্ণনার মধ্যে গল্পের বা আড্ডার একটা আমেজ পাওয়া যায়। ফলে প্রায় ৫৭ মিনিটের এ ছবিটি তরতর করে এগিয়ে চলে। ছবির মেকিং ডিজাইনটাও বেশ চিত্তাকর্ষক। মহালয়ার ভোরের আবহে ছবির শুরু। গঙ্গার ঘাটে ও শহরের পথে পথে মহালয়ার তর্পন সংক্রান্ত নানা ডিটেলস পরিচালক ছবির শুরুতে দেখিয়ে দেন এবং ধারাবর্ণনায় এসবের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন যার ফলে মহালয়া ও তর্পন বিষয়ে অনাবগত দর্শকদের কাছে পুরো বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। টাইটেল সিকোয়েন্সটিও চমৎকার। পানির ট্যাপের ক্লোজ শট দিয়ে শুরু। পানি পড়ার টুপটাপ শব্দ শোনা যায় আবহে। এই সিকোয়েন্সেই পানির বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হন পরিচালক। চিত্রনাট্য বাহুল্যহীন এবং টানটান। এই গতিশীলতা ধরে রাখতে যোগ্য সঙ্গত করেছে সুমন্ত সরকার, সুমন সিত, সুদীপ বড়াল ও শুভজিৎ রায়ের যৌথ নান্দনিক চিত্রগ্রহণ এবং সুমন্ত সরকারের দ্যুতিময় সম্পাদনা। যৌথভাবে সুপ্রযুক্ত ও শ্রুতিমধুর আবহ সংগীত নির্মাণ করেছেন ব্যাকবেঞ্চার। মধ্যকলকাতার পারিপার্শ্বিকতা দেখাতে পরিচালক এ অঞ্চলের পথজীবনের নানা চিত্র তুলে এনেছেন বিশ্বস্ত ও কষ্টসাধ্য চিত্রগ্রহণের মাধ্যমে যা প্রায় প্রতিটি দৃশ্যে অনেক ডিটেলস তৈরি করে । অনেক চমৎকার মোটিফ ও সিম্বলের প্রয়োগও লক্ষ্যণীয়। পত্রহীন বৃক্ষ, টানা রিকশা, ভোরের গঙ্গা, পাখির কলতান, পথের মানুষের ভোর ও সকালের জীবনযাত্রার ছোট ছোট দৃশ্যগুলি মোটিফ পাশাপাশি ভোরের কলকাতার চমৎকার অনেক ডিটেলসও তৈরি করে নিয়েছে। সব মিলে সিনেমার ভাষার অনেক বুদ্ধিবৃত্তিক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন পরিচালক তাঁর যত্নসাধ্য প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে। মহালয়ার ভোরে ছবি শুরু হয়ে বিসর্জনের সন্ধ্যায় শেষ হয়। ফলে শারদীয়া উৎসবের একটি ডকুমেন্টেশনও মূল আখ্যানের পাশাপাশি পাওয়া যায়। রাজাদিত্য বন্দোপাধ্যায় কলকাতার মেধাবী একজন চলিচ্চত্রকার অভিনেতা, কবি এবং কথাসাহিত্যিক। তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘ ডিসেম্বর রেন ও কবিতামাখা চুল’ ২০২৪ এ প্রকাশিত হয়েছে চট্টগ্রামের খড়িমাটি থেকে। বাবা দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রয়াত প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও সম্পাদক। দীর্ঘদিন সম্পাদনা করেছেন শিশু কিশোর পত্রিকা ‘আনন্দমেলা’। বড় ভাই বাষ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায় অকালপ্রয়াত প্রখ্যাত লেখক ও চলচ্চিত্রকার যার ছবি হাউসফুল, শিল্পান্তর, কাঁটাতার, কাল, এলার চার অধ্যায়, সম্প্রদান বাংলাদেশেও প্রদর্শিত এবং প্রশংসিত হয়েছে। মোহরা ব্রিজ ছবির চিত্রায়নের সময় অসুস্থ হয়ে তিনি অল্প বয়সে প্রয়াত হন। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর রাজাদিত্য এস্তোনিয়ার রাজধানী তালিনের বল্টিক ফিল্ম এন্ড মিডিয়া স্কুল থেকে ফিল্ম মেকিংএ ডিপ্লোমা করেছেন। দুটি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ফিচার ফিল্ম ও আটটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন এ পর্যন্ত। বাবার গল্প অবলম্বনে প্রথম ফিকশন ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ বহু আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছে।

দ্বিতীয় ফিকশন ‘শিবরাত্রি’ ও বাবার লেখা গল্পে তৈরি এবং মুক্তির প্রতীক্ষায়। রাজার প্রামাণ্যচলচ্চিত্রগুলিও সাড়া জাগানো এবং বিভিন্ন উৎসবে প্রশংসিত লস্ট ফর ওয়ার্ডস, ডেথ অফ ডেথ, অচ্ছুৎদ্য আনটাচেবল, ডাইয়িং আর্ট অফ দ্য বহুরূপিজ অফ বেঙ্গল, ড্যাম? ড্যামড? ক্র্যাকিং দ্য গ্লাস সিলিং, দ্য আদার ইন্ডিয়া এবং ওয়াটারওয়ালা। গড়ে তুলেছেন আন্তর্জাতিক নাট্যগোষ্ঠীব্যাকবেঞ্চার্স। জীবনের দুই দশকের বেশি সময় কাটিয়েছেন ইউরোপের নানান দেশে, মূলত ফিনল্যান্ডে, যেটি তার সেকেন্ড হোম। রাজাদিত্যর আগ্রহ মূলত প্রামাণ্যচিত্রে। চলচ্চিত্রের সবচেয়ে সিরিয়াস প্রকরণ প্রামাণ্যচিত্র, যার তৈরির নেপথ্যে সামাাজিক একটি দায়বদ্ধতা কাজ করে। এই দায়বদ্ধতার কারণেই রাজাদিত্য একের পর প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করে চলেছেন বৈচিত্র্যময় নানান বিষয় নিয়ে। বিলুপ্তপ্রায় সাংস্কৃতিক ও উপজৈবিক অনেক উপাদান তিনি তাঁর প্রামাণ্যচিত্রে তুলে রাখেন। আশা করি তাঁর এই আন্তরিক প্রয়াস সামনের দিনগুলিতেও অব্যাহত থাকবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসেহি্‌ঝল ইরহাম শেহরাজ এর পঞ্চম জন্মদিনে শোকগাথা
পরবর্তী নিবন্ধরোটারি ক্লাব অব চিটাগং রেইনবোর নিয়মিত সভা