মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এক বছর আগে বলেছিলেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া রাজাকারদের তালিকা আসবে ২০২৪ সালের মার্চে। বছর ঘুরে সেই মার্চে এসে মন্ত্রী জানালেন, রাজাকারের কোনো তালিকা তার মন্ত্রণালয় এখনো করে উঠতে পারেনি।
মোজাম্মেল হক বলেন, এটার (রাজাকারের তালিকা) জন্য আগের সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান সাবেক মন্ত্রী জনাব শাহজাহান খান সাহেবের নেতৃত্বে একটা কেবিনেট কমিটি করে দেওয়া হয়েছে এবং আরো অনেক আছেন। উনাকে আহ্বায়ক করে এটা করা হয়েছে যে, রাজাকারের সংজ্ঞা এবং তালিকা প্রণয়নের জন্য। আমি যতটুকু জানি, অদ্যাবধি আমাদের কাছে উনারা তালিকা হ্যান্ডওভার করেননি, হস্তান্তর করেনি। কোনো লিখিত তালিকা আমরা এখন পর্যন্ত পাইনি। সেজন্য তালিকার বিষয়ে সর্বশেষ অবস্থা বলতে পারছি না। আমি মনে করি, শাহজাহান খানের কাছ থেকে এই বিষয়ে আপনারা শুনলে ভালো হয়। খবর বিডিনিউজের।
গতকাল রোববার দুপুরে মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে শহীদ বুদ্ধিজীবীর চতুর্থ পর্বের তালিকা প্রকাশ করে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে একাত্তর সালের রক্ষিত তালিকা আছে। কিন্তু মানেন না তো। আপনারা সাংবাদিকরা সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন।
মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের কাছে নতুন তালিকা প্রণয়নে সমস্যার কথাও তুলে ধরেন মন্ত্রী। তিনি বলেন, একাত্তর সালের তালিকা একটা রক্ষিত আছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। নতুন তালিকা বানানোর অর্থ এটা ফেব্রিকেটেড হতে পারে। তালিকা যদি আমি আজকে তৈরি করি, আমি আপনাকে অপছন্দ করি, আপনার নাম ঢুকিয়ে দিতে পারি। আবার উনাকে পছন্দ করি, উনি একজন রাজাকার দ্য গ্রেট ছিল; তো উনি আমার ভগ্নিপতি, আপনি বাদ। এ রকম সমস্যা তো হতে পারে।
২০১৯ সালের বিজয় দিবসের আগের দিন সংবাদ সম্মেলন করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী ১০ হাজার ৭৮৯ জন ‘স্বাধীনতাবিরোধীর’ তালিকা প্রকাশ করেন। ওই তালিকায় গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের নাম আসায় ক্ষোভ আর সমালোচনার প্রেক্ষাপটে সংশোধনের জন্য ওই তালিকা স্থগিত করা হয়। পরে রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনীসহ স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা তৈরির সুযোগ রেখে ২০২২ সালের ২৯ আগস্ট ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন’ সংসদে পাস হয়।
ওই তালিকা প্রকাশের প্রসঙ্গ টেনে মন্ত্রী বলেন, ইয়েস আই ডিড ইট। বাট আমাদের অ্যাপোলজি করে প্রত্যাহার করতে হয়েছে। আপনি ডকুমেন্ট দেখেন। সেই ডকুমেন্ট আমাদের তৈরি না। একাত্তর সালের ডিসি স্বাক্ষর করা সাইন, এসডিও স্বাক্ষরিত সাইন। একাত্তর সালে হোম মিনিস্ট্রির কাছে যে কাগজ আছে সেগুলো আমাদের কাছে আছে।
রাজাকারের তালিকা তৈরিতে কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরে মোজাম্মেল হক বলেন, অনেকের নাম লিখে দিয়েছে, তারা হয়ত অ্যাক্টিভলি পার্ট করেনি, কাজ করেনি। পরবর্তীতে দেখা গেল তারা হয়ত অ্যাক্টিভলি গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। জীবন বাঁচানোর জন্য তারা হয়ত নাম লিখে রাখছে। তখন ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার–চেয়ারম্যানদের বলেছে, তালিকা দাও। বানানোর জন্য বলেছে, বানাও।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী তার বিবেচনায় সে সময়ের বাস্তবতা তুলে ধরে বলেন, সেখানে তো দুই ধরনের লোক ছিল। এক ধরনের মানুষ জীবন বাঁচানোর জন্য হয়ত তালিকাভুক্ত হয়েছে। আরেক ধরনের লোক পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার জন্য করেছে। সেটাই হচ্ছে মূল সমস্যা। আমাদের কাছে একাত্তর সালের তালিকা আছে, কাগজ আছে।
মন্ত্রী বলেন, আমাদের কাছে পাকিস্তানিদের ডকুমেন্ট আছে, আমাদের না। একাত্তর সালে কি আমরা সরকার চালাইছি? কেউ না কেউ চালাইছে তো। তাদের তালিকা আছে না? তারা বেতন দিছে না? তারা অস্ত্র দিছে না? তাদের রেকর্ড আছে না? হোম মিনিস্ট্রিতে সেই রেকর্ড আছে। আমার কাছে সেটা একটা কপি নিয়ে আসছে।
এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ে অভিযোগ পেলে আমরা সেটা চারবার খতিয়ে দেখি। আপনাকে যদি দায়িত্ব দেওয়া হয়, আপনি কি করবেন? কারো না কারো উপরে আপনাকে ডিপেন্ড করতে হয়। বগুড়ায় কে ছিল বা গাজীপুরে কে ছিল? আপনার পক্ষে সম্ভব?
মোজাম্মেল হকের ভাষ্য, দেখুন, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমার থানায় আমার সাথে যারা যুদ্ধ করছে অথবা আমি যাদের অধীনে যুদ্ধ করেছি অথবা আমার অধীনে যারা যুদ্ধ করেছে এদেরকে আমি চিনি। আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কমিটি করে দিয়েছি। সেখানে অনেক বাদ–প্রতিবাদ হয়েছে, আপনারাও লিখেছেন। আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ আসার পর সেগুলো যাচাই–বাছাই করেছি। আমি যা পেয়েছি, যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তারা যে রিপোর্ট দিয়েছেন সেটা আমি একসেপ্ট করে দিয়েছি, এটুকু আমি বলতে পারি।
মন্ত্রী বলেন, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার বিষয়ে এখনো আমরা কাছে অভিযোগ পেলে যেটা যাচাই করি। তাই আমাদের আন্তরিকতা, চেষ্টা ও সদিচ্ছার কোনো অভাব নেই।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ২১ বছর ক্ষমতায় থাকা বিভিন্ন সরকারের সময় মুক্তিযুদ্ধের অনেক দালিলিক প্রমাণ নষ্ট করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন মন্ত্রী। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিলেন সেখানে আপনার জামায়াতের ইসলামের যারা রেজ্যুলেশন করে দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল, তারা ক্ষমতায় ছিল। সেই সমস্ত দালিলিক প্রমাণ কি তাদের সুযোগ ছিল না নষ্ট করার? এবং তারা যে করেন নাই এ কথা মনে করব কেন? রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ওই যারা ছিলেন, তারা অনেক দালিলিক প্রমাণাদি… যেহেতু তাদের স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে সস্পৃক্ততা ছিল, তারা সেগুলো ধ্বংস করেছে, নষ্ট করেছে। ডিসি অফিসে, এসডিও অফিসে, সার্কেল অফিসারের অফিসে ছিল, যারা সরকারের পক্ষে ওইসব মেনটেইন করেন, তাদের কাছ থেকে সেইসব দালিলিক প্রমাণ আমরা পাইনি। আমাদের মনে রাখতে হবে, জামায়াতের মতিউর রহমান নিজামী, মুজাহিদরা ক্ষমতায় ছিল।