দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক পরিবেশ পর্যালোচনায় আত্ম সমালোচনা–আত্মবিশ্বাস–আত্মশুদ্ধির অপরিসীম অবজ্ঞা অনুমেয়। পারষ্পরিক সমঝোতা–সৌহার্দ–সম্প্রীতির বিপরীতে সহিংসতা–চক্রান্ত–ষড়যন্ত্র–অসহিষ্ণু আচরণ নানামুখী বিভ্রান্তি তৈরি করছে। মানুষের মর্যাদা সুদৃঢ় করার জন্য প্রয়োজনীয় নাগরিক স্বাধীনতা অপরিহার্য। জাতিরাষ্ট্রের সকল জনগণের সামগ্রিক সুযোগ–সুবিধা অবারিত ভোগ করার মধ্যেই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ। আধুনিক সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় মুক্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জনগণের অধিকার প্রয়োগ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গতিশীল করে সমাজের স্বয়ম্ভরতা অর্জনে মুক্তচিন্তার অবাধ প্রকাশ এবং সাংস্কৃতিক বিবেকের জাগরণ একান্ত প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচ্য। ধারাবাহিকতায় একুশ শতক ছিল সবচেয়ে সৃষ্টিশীল শতক যা বিশ্বের প্রায় সকল মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে স্পন্দিত এবং তা অর্জনে প্রচন্ড শক্তি যুগিয়েছিল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক মনীষী এরিস্টটল বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বস্তুবাদী দর্শনের ঐতিহ্যিক মাত্রায় শুধু জীবনের প্রয়োজনে নয়, বরং উত্তম জীবন সচল করার প্রয়োগিক তাগিদে রাষ্ট্রের উৎপত্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। ব্যক্তিকে সর্বোৎকৃষ্ট জীবনের দিকে পরিচালিত করার লক্ষ্যে মানুষ সকল সামাজিক সম্পর্ক এবং শক্তির বন্ধনে জাগতিক ও সামষ্টিক মূল্যায়নে রাষ্ট্র গঠন নিশ্চিত করেছে। এজন্যই রাষ্ট্র মানুষের পরিপূর্ণ জীবনপ্রবাহের গতিময়তায় একটি অনিবার্য প্রতিষ্ঠানরূপেই প্রতিভাত। মানবসত্তার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ বা পরিবার–সমাজের পর্যাপ্ত স্বাধীনতা, নিরাপত্তা–মঙ্গল প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার সার্থকতা সর্বজনবিদিত।
মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গ্যাব্রিয়েল অ্যালমন্ড সর্বপ্রথম রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রত্যয়টি ব্যবহার করেন। তাঁর মতে, ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতি হল রাজনৈতিক ব্যবস্থার সদস্যদের রাজনীতি সম্পর্কে মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির রূপ ও প্রতিকৃতি।’ কোন একটি দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার গতি–প্রকৃতির প্রবাহমানতায় সে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি উদ্ভাসিত। রাজনীতি নিয়ে সমাজের চিন্তাচেতনা–ধ্যানধারণা, রাজনৈতিক মূল্যবোধ–বিশ্বাস–মতাদর্শ, জ্ঞানগত কার্যকলাপ–আগ্রহের পরিমাপ–মূল্যায়নমূলক অভিযোজনে নির্ধারিত হয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাবলীল উত্তরণ। জনগণ সম্যক অবগত আছেন, রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি পারষ্পরিক সম্পূরক–পরিপূরক। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি হচ্ছে সমাজে বসবাসরত ব্যক্তিবর্গের উন্নয়ন ও সমষ্টিগত মূল্যবোধ সৃষ্টিসোপান। ব্যক্তি স্বাধীনতার পাশাপাশি পুরো সমাজ উন্নয়নে পরিমার্জিত পারস্পরিক শ্রদ্ধা–ভালোবাসা–পরমতসহিষ্ণুতা–অপরের বক্তব্যকে অবজ্ঞা না করার প্রবণতা রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে উঁচুমাত্রিকতায় নির্দেশিত করে।
রাজনৈতিক সংস্কৃতি, উপ–সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সর্বত্র জনদুর্ভোগ লাঘব ও জনসাধারণের অধিকার–স্বার্থ–নৈমিত্তিক প্রয়োজনে রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ সমূহের সৃজন–মননশীল বিকাশধারা নিশ্চিত করা। সমাজপ্রগতির সাথে ভারসাম্য ও পরিবর্তনশীলতার আনুষ্ঠানিক উপাদান সমূহের কার্যকর অনুশীলনে রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাবলীল সৌকর্য উদ্ভাসিত হয়। জ্বালাও–পোড়াও–ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে দেশবাসীকে জিম্মি করে কদর্য পন্থায় অধিকার আদায় রাজনৈতিক উপ–সংস্কৃতিকে কখনো পরিশুদ্ধ করে না। বিভিন্ন শান্তিপূর্ণ সভা–সমাবেশ–সেমিনার–সিম্পোজিয়াম–মানববন্ধন–প্রতিবাদী মিছিল–র্যালী শোভিত কর্মসূচি কেন্দ্রিক জনগণকে উদ্বুদ্ধকরণই গঠনমূলক রাজনীতির সুন্দরতম ভাষা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশভারত–পাকিস্তানি শাসন–মহান মুক্তিযুদ্ধ–স্বাধীনতা পরবর্তী দেশ পুনর্গঠন–৭৫ পরবর্তী সেনা ও স্বৈর শাসনামল–একযুগের বেশি সময় ধরে বিগত সরকারের অধীনে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিত পর্যালোচনা আবশ্যক। দুর্নীতি–স্বজনপ্রীতি–সাম্প্রদায়িকতা–সামাজিক ও রাজনৈতিক সহিংসতার মোড়কে রাষ্ট্রের পর্যুদস্ততা–জনগণের অসহায়ত্ব ইত্যাদি মনুষ্যত্ব–মানবিকতা বিচ্যুত অশুভ শক্তি কিভাবে জাতিরাষ্ট্রের চরিত্রকে কলুষিত করেছে তারও ব্যাখ্যা প্রয়োজন। রাজনীতির আবরণে অর্থ–ক্ষমতালিপ্সু কথিত রাজনীতিবিদদের নরপশুতুল্য বিবেকবর্জিত অবৈধ বাণিজ্য–ভূমি দখল–প্রভাব বিস্তারে প্রান্তিক পর্যায়ের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শহর–নগরের প্রতিটি অলি–গলিতে প্রোৎসাহিত হিংস্র বাহিনীর তান্ডব–দুর্ধর্ষ কর্মকাণ্ডে জনজীবন নিস্প্রভ–নিরীহ–প্রাণস্পন্দনহীন রূপ পরিগ্রহ করেছিল।
যেকোন জাতিরাষ্ট্রের উন্মেষ ও চলমান প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি–প্রতিষ্ঠান–সমাজের সার্বিক চিত্রপট মানবকল্যাণের জটিল মিথস্ক্রিয়ায় নির্মিত হয় রাজনৈতিক রীতি–নীতির পাঠ্যক্রম। একনায়ক–সামরিক–স্বৈর–গণতান্ত্রিক গতিধারায় গ্রহণ–বর্জনের নানাবিধ পন্থায় পরিচালিত হয় স্বকীয় সত্ত্বার রাষ্ট্র ব্যবস্থা। আদর্শের ঘাত–প্রতিঘাতে উম্মোচিত হয় দল–উপদল–দলীয় নেতৃত্ব ও কর্মীর আচার–আচরণ। দল গঠনের প্রণিধানযোগ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে; ধর্ম–বর্ণ–দলমত–অঞ্চল নির্বিশেষে সমগ্র জনগোষ্ঠীর পরিপূর্ণ মঙ্গল চরিতার্থে মাটি ও মানুষের প্রতি মমত্ববোধের প্রতিফলন। আদর্শিক ভিন্নতায় বিরোধ–বিচ্ছেদ, প্রতিযোগিতা–প্রতিহিংসা–পরশ্রীকাতরতা নিধন করে সংগত–সংযত সমাজস্বীকৃত আচরণবিধির অনুশীলন–জনমনজয়ী চরিত্র গঠনের মাধ্যমে দেশ ও দেশবাসীকে উপকৃত করার ইস্পাতকঠিন ব্রত গ্রহণের মধ্যেই নেতৃত্বের পরিশীলিত গ্রহণযোগ্য বিকাশ। উল্লেখিত বিষয়সমূহ বা ঐতিহ্য–শিক্ষা–অভিজ্ঞতা–সততা–ন্যায়পরায়ণতা–মনন ও সৃজনশীলতার দৃশ্যমান অবগাহনে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দৃঢ়তা নির্ভর করে।
মূলত সপ্ত–অষ্টাদশ শতকে ব্রিটেনের বুর্জোয়া বিপ্লব–ফরাসী বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে রাজতন্ত্র–স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিপরীতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার মধ্যেই আধুনিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির বীজ বপিত হয়েছিল। সুদূরঅতীতে উদ্ভুত সংস্কৃতি–উপসংস্কৃতির প্রভাব সমাজকাঠামোর উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনে সমধিক সার্থক না হলেও; সামাজিক উন্নতি–প্রগতি–পরিবর্তনশীলতা অনেকাংশে রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য মোড়কে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। ধারাবাহিকতায় উন্নয়ন–অনুন্নয়নের মানদন্ডে মূখ্য বিষয় হিসেবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সকল প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকবৃন্দের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে পছন্দের জনপ্রতিনিধি নির্বাচনই রাজনৈতিক সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ব্যক্তি–শ্রেণী বা দলীয় স্বার্থ রক্ষার যে ধারণা তথা স্বৈরতন্ত্র–অভিজাতন্ত্রের পরিবর্তে মানুষ প্রতিষ্ঠা করেছে জনন্যায়তন্ত্র বা গণতন্ত্র। স্বাধীনতা–সাম্য ও মৈত্রী প্রতিষ্ঠার যে বিশ্বজনীন চেতনা ইউরোপে রেনেসাঁ বা ফরাসী বিপ্লবের মত অন্যান্য বিপ্লবের পিছনে কার্যকর ছিল।
পরবর্তীতে উল্লেখ্য শক্তিমানতাই গণতন্ত্রের ভিত রচনায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। রাষ্ট্র প্রায় সকল ক্ষেত্রে জনগণের চরিত্র, আশা–আকাঙ্ক্ষা, আর্থ–সামাজিক পরিবেশ, পারিপার্শ্বিক ও ভৌগোলিক অবস্থানের বিষয়সমূহ প্রাধান্য দিয়ে মুক্ত সমাজ গঠন প্রক্রিয়াকে সুস্পষ্ট করেছে। এটিই গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক ইতিহাসের ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্য। বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধান পরিপূর্ণ প্রতিপালনে যথাসময়ে প্রান্তিক পর্যায়ের বিভিন্ন পর্ষদ থেকে শুরু করে শহর–নগর ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন জনপ্রশাসনের একটি অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়। শুধু ক্ষমতা পরিবর্তনের জন্য নয়; জনগণের কল্যাণে নিবেদিত ব্যক্তিত্বের অনুসন্ধান সাধারণত নির্বাচনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। রাষ্ট্র পরিচালনায় এর ব্যতিক্রম কোনো পন্থা অবলম্বন করা হলে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের স্খলন ও অবৈধ–অনৈতিক সেনা–স্বৈরশাসন উন্মেষের সুযোগ তৈরি হয়।
গণতন্ত্রের প্রাথমিক মূল্যবোধ হচ্ছে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ অর্থাৎ ব্যক্তির মৌলিক স্বাধীনতার তথা চিন্তা–বাক–সংগঠনের স্বাধীনতা, ভোটাধিকার প্রয়োগ, দলগঠন এবং অংশগ্রহণ, প্রার্থী হওয়া–নির্বাচনে অংশগ্রহণ–অভিযোগ উপস্থাপনের স্বাধীনতা অর্থাৎ সার্বিকভাবে জীবনধারণ–পরিবার গঠন–নিরাপত্তা বিধান–আইনের আশ্রয়–স্বাধীন মতামত প্রকাশ–নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা বিরোধিতার অধিকার ইত্যাদি সকল কিছুকেই অন্তর্ভূক্ত করে। যে কোন সামাজিক প্রক্রিয়ায় ব্যক্তির স্বাভাবিক ব্যক্তিত্ব ও সৃজনশীল প্রতিভার উন্মেষ একমাত্র গণতান্ত্রিক পন্থায় সম্ভব। এজন্যই বিশ্বের সকল সভ্য দেশ, বিবেকবান–মানবতাবাদী মানুষ গণতন্ত্রের ভাবধারায় বিশ্বাসী। গণতন্ত্রের যৌক্তিক বিশ্লেষণে নিজের ইচ্ছার সাথে অন্যের ইচ্ছার সমন্বয় ঘটানো বা অধিকাংশের ইচ্ছা বা আগ্রহকে গুরুত্বসহকারে নিজের বা ব্যক্তির অধিকারে সন্নিবেশন। ভল্টেয়ার বলেছেন, “তোমার মতের সাথে আমি একমত নাও হতে পারি, কিন্তু তোমার মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে রক্ষার জন্য প্রয়োজন হলে প্রাণ দেব”।
পবিত্র সংবিধান সম্মত বিধিবিধান যথার্থ অনুসরণে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইতিবাচক প্রতিযোগিতায় সকল দলের অংশগ্রহণ আবশ্যক। জনগণের পবিত্র ভোটাধিকার প্রয়োগে সরকার গঠনকল্পে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে সুস্থ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন করার জন্য স্বাধীন নির্বাচন কমিশনকে সর্বোতভাবে সহযোগিতাই একান্ত কাম্য। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির উৎকৃষ্ট চর্চাই হউক রাজনীতির আদর্শ। মোদ্দাকথা দল–মত–ধর্ম–বর্ণ–নির্বিশেষে সকল প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক–দলীয় নেতা কর্মী আত্মশুদ্ধিতে পরিশুদ্ধ–বলীয়ান হয়ে দুর্যোগপূর্ণ সময়কালকে অতিক্রম করে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার অঙ্গীকার নিঃসঙ্কোচে ব্যক্ত করবেন – এটিই প্রত্যাশিত।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ–অপরাধবিজ্ঞানী








