রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার আলোকেই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের খসড়া তৈরি হবে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। গতকাল রোববার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি। ঘোষণাপত্র নিয়ে কাজ শুরুর কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আগামীতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথাবার্তা হবে। সেই আলোকে ঘোষণাপত্রের খসড়া (ড্রাফটিং) হবে।‘ কবে থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা–এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এখনো সুনির্দিষ্ট সময় নির্ধারিত হয়নি। খবর বিডিনিউজের।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৫ জানুয়ারির মধ্যে ঘোষণাপত্র দেওয়ার দাবির প্রসঙ্গে এক প্রশ্নে প্রেস সচিব বলেন, আমরা বলেছিলাম কিছুদিনের মধ্যে। সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। জুলাই ঘোষণষাপত্র নিয়ে মানুষের মনোভাব জানতে সারা দেশে যৌথভাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির জনসংযোগের কর্মসূচির মধ্যে এ ঘোষণাপত্র প্রণয়ন নিয়ে সরকারের অগ্রগতির তথ্য সামনে এল। ৬ থেকে ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত এ জনসংযোগ কর্মসূচি চলবে। জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের ঘোষণা দিয়ে সরকার পতনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও নাগরিক কমিটি কর্মসূচি দিয়েছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসের গতিপথ বদলে দেওয়া ২০২৪ সালের শেষ দিন
৩১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জমায়েতের ওই কর্মসূচি হওয়ার কথা ছিল। সেই অনুযায়ী প্রস্তুতিও নিয়েছিল সংগঠন দুটি। এ কর্মসূচি নিয়ে নানা জল্পনা কল্পনার মধ্যে প্রথমে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, এ ঘোষণাপত্রের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের সম্পর্ক কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু এক দিনের ব্যবধানে কর্মসূচির আগের সন্ধ্যায় ৩০ ডিসেম্বর সরকারের পক্ষ থেকে একই ধরনের ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেন তিনি। এরপর ওইদিন গভীর রাতে জরুরি বৈঠক শেষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘোষণা দেয়, অন্তর্বর্তী সরকার যেহেতু ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে, তারা তাতেই সমর্থন দেবে।
হাসিনাকে ফিরিয়ে আনা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার : ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনা সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হিসেবে তুলে ধরে প্রেস সচিব বলেন, তাকে ফিরিয়ে এনে বিচারের সম্মুখীন করা, এটা আমাদের দায়। এতে এক ইঞ্চিও পিছপা হবে না। সে যে আকাম–কুকাম করেছে, চোরতন্ত্র জারি করেছিল, সেগুলোর জন্য, গুম ও খুনের জন্য তাকে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। হাসিনা তার বাবার খুনিদের পার্সু করে অনেক জায়গা থেকে ফিরিয়ে এনে বিচার করেছিল। তিনি তার বাবার খুনিদের ফিরিয়ে আনতে যেভাবে পার্সু করেছেন, আমরা তার দ্বিগুণ পার্সু করে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের সম্মুখীন করা হবে।
শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনতে সরকার কতটুকু আশাবাদী–এমন প্রশ্নে প্রেস সচিব বলেন, আমরা আশাবাদী। অনেক বেশি আশাবাদী। পৃথিবীতে কেউ কোনো খুনিকে জায়গা দিতে চায় না। হাসিনার হরর যে স্টোরি, যে ভয়ানক কাণ্ড সে করেছে, ভারতীয় গণমাধ্যমের অনেকই জানতই না। ইদানীং অনেকেই লেখা শুরু করেছেন। পুরো পৃথিবী যখন জানবে, কী ধরনের হত্যাকাণ্ড, অনাচার, ডিকটেটরশিপ সে জারি করেছিল। বিষয়টি জানবে, চাপটা তৈরি হবে। আমরা তাকে ফিরিয়ে আনার চাপ আমরা অব্যাহতভাবে রাখব। তাকে বিচারের সম্মুখীন হতেই হবে।
তিনি বলেন, আমাদের অংশীজন আমাদের রাজনৈতিক দল, তারা ক্ষমতায় এলে তারাও এই কাজ করবেন। যদি না পারি, পরে যারা ক্ষমতায় আসবেন তারা করবেন। তাকে বিচারের আওতায় আনা। এটা জাতির একটা আকাঙ্ক্ষা।
সরকার পতন আন্দোলনে নিহত ছয় সাংবাদিক হত্যার বিচারের বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা আমাদের অগ্রাধিকার। অপরাধীদের বিচারের সম্মুখীন করা হবে। ৫ আগস্টের পরে আওয়ামী লীগ নেতাদের পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি সরকার তদন্ত করছে বলেও তুলে ধরেন তিনি। বিষয়টি সৎ তদন্ত কর্মকর্তাদের দিয়ে করাব। আগের (আওয়ামী লীগ সরকার) সরকরের তদন্ত কর্মকর্তারা তদন্ত করলে ভালো ফলাফল পাব না।
সাইবার সুরক্ষা আইনের বিষয়ে টিআইবির সমালোচনার বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা সমালোচনাকে ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করি। এটা নিয়ে আসিফ নজরুল সাহেব কথা বলবেন। গুম কমিশন ভালো কাজ করছে মন্তব্য করে শফিকুল আলম বলেন, দুই–একটা আয়নাঘরে আপনাদের (সাংবাদিক) পরিদর্শনের ব্যবস্থা করব। সেখানে কী ভয়াবহভাবে গুম করা হতো সেই চিত্র দেখতে পারবেন। হাসিনার আমলে পাপাচারের শেষ নেই। এ সময় তিনটি নির্বাচন, শাপলা চত্বরের ঘটনা, টাকা পাচারের ঘটনা তুলে ধরেন তিনি।
সাগর–রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্তের বিষয়ে তিনি বলেন, এ ঘটনার বিচারের দাবিতে আমরা (সাংবাদিক) আন্দোলনে ছিলাম। এ বিষয়ে কাজ চলছে। তথ্যগুলো যাচাই–বাছাই চলছে। যে সময়টা নষ্ট হয়েছে তা মেকআপ করে দ্রুত সময়ের মধ্যে তদন্ত করতে কাজ করছে পিবিআই। বিষয়টি আজকে (রোববার) পিবিআই প্রধানের সঙ্গে কথা হয়েছে। কারণ তারা ত্রিশ বছর আগের খুনের তদন্তও সফলভাবে করেছে। তাই তাদের সক্ষমতা আছে। বিষয়টি কষ্টসাধ্য হলেও প্রচুর সময় দিচ্ছেন বলে আমাদের জানিয়েছেন।
বিটিভি ও বাসসের স্বাধীন সাংবাদিকতা নিশ্চিতে সরকার উদ্যোগ নেবে কিনা–এমন প্রশ্নে প্রেস সচিন বলেন, পৃথিবীর সব দেশেই রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম আছে। এটা খুবই গুরুত্ব কাজ। অন্যান্য দেশে এ সংস্থাগুলোর ব্যাপ্তি বড় আকারে থাকে। তাই আমরা সরকারি সংস্থাগুলোকে আরও বড় ও ক্ষমতাশালী করার চেষ্টা করছি। এরই মধ্যে বিটিভি সংবাদ পরীক্ষামূলক চালু হয়েছে। তা আরো বড় করার পরিকল্পনা সরকারের আছে। যাতে দেশের সমস্ত সংবাদ মানুষ দেখতে পারে।
তিনি বলেন, বিটিভি ও বাসসকে স্বাধীনতা দেওয়া আছে। নিজ নিজ ভূমিকা অনুযায়ী প্রেস ফ্রিডম ব্যবহার করতে পারবেন। গত পাঁচ মাসে দেশের গণমাধ্যম যতটা স্বাধীন ছিল, তা বাংলাদেশের ইতিহাসে ছিল না। আওয়ামী লীগ আমলের দুর্নীতির চিত্র বাসসের সংবাদে উঠে আসবে কিনা–এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা তাদের ব্যবস্থাপনায় হস্তক্ষেপ করি না। আমরা আশাকরি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনাকে ধারণ করে প্রোগ্রামগুলো করবেন।
উপ প্রেস সচিব আজাদ মজুমদার বলেন, বুলগেরিয়া ভিসা সেন্টার ভারত থেকে ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামে হস্তান্তরের কথা আগেই জানিয়েছে। ১২২ জন বাংলাদেশি ছাত্রকে তারা ভিসা দিয়েছে। ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডের দূতাবাস থেকে ভিসা দেওয়ার কথা জানিয়েছে রোমানিয়া। কাজাকিস্তান জানিয়েছে ব্যাংকক থেকে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ভিসা দেবে। এছাড়া অন্যান্য দেশের সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপিয়ান ডেস্ক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বলে তুলে ধরেন তিনি।
ব্রিফিংয়ে আরো উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার সহকারী প্রেস সচিব আশরোফা ইমদাদ ও সুচিস্মিতা তিথি।