গত ৬ জুন সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণের মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধের যেকোনো একটি দিনে অনুষ্ঠিত হবে। এই ঘোষণার ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের বিস্তারিত রোডম্যাপ দেবে বলেও জানান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, আমি বারবার বলেছি এই নির্বাচন ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। এই সময়ের মধ্যে দেশে নির্বাচন উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির জন্য যা যা করা দরকার, সরকার তাই করছে।
ইতোমধ্যে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি প্রভৃতি প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান এক বিবৃতিতে প্রধান উপদেষ্টার নির্বাচনের দিন ঘোষণায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, এই ঘোষণায় জাতি আশ্বস্ত হয়েছে এবং ঘোষিত সময়ের মধ্যেই একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে জাতি আশা প্রকাশ করছে।
তিনি আরও বলেন, জাতির তীব্র আকাঙ্ক্ষার সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন এই তিনটি বিষয়ের ভিত্তিতে এবং ‘জুলাই সনদ’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশকে একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবেন।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল–জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব এবং সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন বলেছেন, পুরো জাতির সঙ্গে আমরাও গভীর মনোযোগ ও গুরুত্বের সঙ্গে ভাষণটি বিবেচনায় নিয়েছি। ভাষণে সংস্কার ও জাতীয় সনদ, নির্বাচন, এবং গণহত্যার বিচার অনুষ্ঠানের ঘোষণা গণঅভ্যুত্থানের অভিপ্রায় পূরণের লক্ষ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি।
জেএসডি মনে করে, একটি অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের জনগণকে তাদের রাজনৈতিক অভিপ্রায় প্রকাশের সুযোগ করে দেওয়ার মধ্য দিয়েই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা সুদৃঢ় হয়।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম মনে করেন, এ ঘোষণায় কিছু রাজনৈতিক দল আশ্বস্ত হলেও মূল চাবিকাঠি এখনো রয়ে গেছে “জুলাই সনদ“-এর মধ্যে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, নির্বাচন আয়োজনের আগে প্রয়োজন কাঙ্ক্ষিত সংস্কার ও নিরপেক্ষ বিচার নিশ্চিত করা। তাই সরকারকে এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে সেসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ওপর।
অন্যদিকে, প্রধান উপদেষ্টার জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণ দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপিকে ‘ক্ষুব্ধ’ করেছে এবং পাশাপাশি দলটি মনে করে ‘নির্বাচনকে বিলম্বিত করার সুযোগ তৈরির জন্যই‘ এপ্রিল মাসে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। ওই ভাষণে ড. ইউনূস ‘শব্দ চয়নে রাজনৈতিক ভব্যতার সীমা অতিক্রম’ করেছেন এবং একটি ‘বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠীর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন’– এমন অভিযোগ তুলেছে দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, নির্বাচনের যে সময় প্রধান উপদেষ্টা দিয়েছেন সেটি ‘বাস্তবতার নিরিখেই‘ তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, গণতন্ত্রে উত্তরণ বিলম্বিত হলে সংকট ঘনীভূত হবে। প্রধান উপদেষ্টা ও তার উপদেষ্টামণ্ডলী নিরপেক্ষ চরিত্র হারিয়েছেন। এপ্রিল কোনোভাবেই নির্বাচন আয়োজনের জন্য যথাযথ সময় নয়।
এক প্রতিক্রিয়ায় বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ সম্পর্কে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ও জনগণের মতামত এবং আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। বাস্তবে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ সম্পর্কে জনদাবি উপেক্ষিত হয়েছে। তিনি বলেন, ডিসেম্বরে কেন জাতীয় নির্বাচন করা যাবে না– ভাষণে তার যেমন সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নেই, তেমনি জাতীয় নির্বাচন কেন আগামী বছরের এপ্রিলে নিতে হবে তারও গ্রহণযোগ্য ও যুক্তিগ্রাহ্য কোনও কারণ উল্লেখ নেই।
আসলে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণটি খুবই তাৎপর্যবহ। যেহেতু আগামী নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সেকারণে এই নির্বাচন ডিসেম্বরে হবে নাকি এপ্রিলে হবে– সেই বিতর্কের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো একটি অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান। কেননা অনেক বছর ধরে জনগণ ভোট দিতে পারে নি–এমন অভিযোগ হরহামেশা করা হচ্ছে। যেই নির্বাচনে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ যেন স্বেচ্ছায় ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিতে পারেন; যার মাধ্যমে হতে পারে সত্যিকার অর্থে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন। এমন নির্বাচন বাঞ্চনীয়। তবু আমরা মনে করি নির্বাচনের তারিখ নিয়ে একটা ঐকমত্যে পৌঁছানো দরকার। নির্বাচনের রোডম্যাপ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একটা আলোচনায় বসা যেতে পারে, যেখান থেকে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটা সুন্দর নির্বাচন আয়োজন অসম্ভব নয়।